শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পঞ্চাশ বছরে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের অগ্রগতি

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৪ এএম

করোনা না এলে হয়তো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের দুর্দশার চিত্রটি খুব একটা প্রকাশ হতো না। যেভাবে চলছিলো সেভাবেই চলত। ড্রাইভার মালেক বা শাহেদ-সাবরিনারা দুর্নীতি করে বহাল-তবিয়তেই থাকতো। সরকারকে এতো কথা শুনতে হতো না। হাসপাতালে র‌্যাব-পুলিশ দিয়ে অভিযানও চালাতে হতো না। করোনা বিপর্যয়ের মধ্যে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি ও জালিয়াতিসহ উদ্ভুত নানাবিধ বাস্তবতায় প্রজ্ঞাপন জারি করে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়া লাগতো না।

নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি আমাদের সংবিধানেই রয়েছে। দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। মানুষের স্বাস্থ্য অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে সরকার হাসপাতাল ও নানা ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। স্বাধীনতার পর দেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রধানত রাষ্ট্রায়ত্ত ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিলো। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। এটা শুরু হয় ১৯৮২ সালে দ্য মেডিক্যাল র্প্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২-এর মাধ্যমে। সেই থেকে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত বিকশিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্যসেবার এক-তৃতীয়াংশ সরকারি খাত এবং বাকি দুই-তৃতীয়াংশ বেসরকারি খাতে পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো স্বাধীন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ নেই। দেশের স্বাস্থ্যসেবার কত ভাগ সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা হবে এবং কত ভাগ বেসরকারি ব্যবাস্থাপনায় প্রদান করা হবে সে বিষয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোন সরকার নীতিমালা ঘোষণা করেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতাল বা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, তদারকি ইত্যাদি কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব কাজের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে কী পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তা হাড়ে হাড়ে টের পান ভুক্তভোগীরা। দেশসেরা ছাত্রদের মধ্যে যারা ডাক্তার হন, তাদের অনেকেই এই বাস্তবতায় ডাক্তারি পড়াকে পরিহাস মনে করে। এমবিবিএস পাস করে একজন তরুণ ডাক্তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। তার চাকরিতে প্রবেশকালীন পদ সহকারী সার্জন। স্থানভেদে এটি কখনো মেডিক্যাল অফিসার, লেকচারার অথবা অন্য কোনো নামে পরিচিত। অথচ এই তরুণ ডাক্তারকে ছাত্রজীবনে কঠোর পড়াশোনা এবং কর্মজীবনে যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে, বিভাগীয় সব পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে, পদোন্নতি পেয়ে অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নাজেহাল হতে হয় গুনে-মানে, পদ-পদবিতে তার চেয়ে নিচের লোকদের কাছে।

দেশে সংখ্যায় অনেক ডাক্তার তৈরি হলেও জনসংখ্যা অনুপাতে তা বড় নয়। ১ হাজার ৫৮১ জন লোকের জন্য রয়েছেন একজন নিবন্ধিত চিকিৎসক। গ্রামীণ, প্রত্যন্ত এবং দুর্গম অঞ্চলগুলোতে চিকিৎসক শূন্যতার হার বেশি। অনুপস্থিতিও অনেক বেশি। শুধু বেশি বেতনই একজন চিকিৎসককে তার কর্মস্থলে থাকতে আকৃষ্ট করতে পারে না। সেখানে দরকার ভালো মানের শিক্ষা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এটি অবশ্য বিকেন্দ্রীকরণ উন্নয়ন নীতিমালার মতো বৃহত্তর বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা বর্তমানে অনুপস্থিত। অনেক সরকারি হাসপাতালে সরঞ্জাম পাওয়া গেলেও প্রযুক্তিবিদ বা টেকনিশিয়ানের পদ খালি রয়েছে। এসব পদে নিয়োগ ও তাদের ধরে রাখা দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি প্রয়োজন স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার উন্নয়ন। এমনও অনেক ঘটনা রয়েছে যেখানে স্বাস্থ্য সরঞ্জাম থাকলেও সেগুলো চালানোর মতো সঠিক জ্ঞানস¤পন্ন কাউকে পাওয়া যায় না। ডাক্তারের বাইরে নার্স, মিডওয়াইফ এবং মেডিকেল টেকনোলজির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজেট বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের। যে বাজেট বরাদ্দ করা হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন, বেতন ও ভাতার জন্য ব্যয় হয়। তাই বাজেট বরাদ্দ থেকে রোগীদের জন্য প্রকৃত উপকারিতা কম পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য বাজেটের অপব্যবহারের প্রচলিত একটি খাত হলো সরঞ্জামাদি সংগ্রহ বা প্রকিউরমেন্ট এবং অবকাঠামো নির্মাণ। গত একযুগ জিডিপির ০.৯% কাছাকাছি বরাদ্দ পেয়ে আসছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, এই পরিমাণ বরাদ্দ কাজে লাগানোর সামর্থ্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই। প্রতি বছর বেশ কিছু পরিমাণ অর্থ খরচ না হওয়ায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়। অথচ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামো অনেক সমৃদ্ধ। গোলমালটা ব্যবস্থাপনায়। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে করোনা। মহামারি প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্য বা পাবলিক হেলথ বিভাগের দুর্বলতা মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে এসে স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশিত গড় আয়ুষ্কাল ৭২ পার করেছে। শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, মাতৃমৃত্যু হার কমেছে, টিকাদান কর্মসূচি গতি পেয়েছে ইত্যাদি। এসব অর্জনের পেছনে সরকার, বেসরকারি খাত, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সম্পৃক্তা রয়েছে। অর্জনগুলোকে বলা যায় এমডিজি যুগের অর্জন। আগে আকাক্সক্ষা ছিল সবার জন্য স্বাস্থ্য। এখন ওই আকাক্সক্ষায় নতুন কিছু শব্দ যোগ করতে হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্য সুবিধ্য। সবার জন্য স্বাস্থ্য বলতে বোঝানো হতো দেশের মোটামুটি সব জায়গায় হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানালেই হয়ে গেল। তবে ব্যবস্থাপনা দুর্বলতার কারণে যে আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। আগে মোটামুটি একজন ডাক্তার দেখাতে পারলেই হতো। আর এখন চিকিৎসার মান নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগে মানুষ বেশি মারা যেত ছোঁয়াচে রোগে। সেটি অনেক কমেছে। এখন বেশি মারা যাচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধিতে। খাদ্যাভ্যাস, শহরের পরিবেশ, বাতাসের দূষণ, এসব কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। হাঁপানি ও ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। ডায়াবেটিস,ব্লাড প্রেশারে আক্রান্তের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। আগে মহামারি ছিল কলেরা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি। এগুলো স¤পূর্ণ চলে গেছে তা নয়, চিকিৎসা সহজ এবং নিরাময়যোগ্য হয়েছে। এখন প্রেক্ষিত বদলেছে। নতুন নতুন রোগ মহামারির আকার নিচ্ছে। ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। নতুন রোগ হিসেবে করোনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। এগুলো এসডিজি যুগের মহামারি। এর মাঝেই শোনা যাচ্ছে, সিআরআরিস ছত্রাকের কথা। করোনার আবহে জন্মানো এ ভাইরাস হানা দিলে ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অনুরাধা চৌধুরী ও তার সহযোগিরা।

বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মতো স্বাস্থ্যসেবার পরিষেবা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে প্রসারিত হচ্ছে। তবে এর গুণমান নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উচিত কার্যকরভাবে এই খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করা। স্বাস্থ্যসেবার গুণমান এবং ব্যয় অনেকটা পরিবর্তিত হয় এসব নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের মাধ্যমে। স্বাস্থ্যখাতকে সেবার পরিবর্তে বাণিজ্যে রূপান্তর করেছে। স্বাস্থ্য খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে শুধু দরিদ্র নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও নিঃস্ব হচ্ছে। বৈশ্বিক মান বিবেচনায় নিলে ১০০ টাকা চিকিৎসা ব্যয়ের ৩৫ টাকার বেশি রোগীর পকেট থেকে যাওয়া উচিত নয়। এখন অসুখের ধরনও পাল্টে গেছে। ক্যানসার অথবা ক্রনিক অসুখের কারণে অনেককে ওষুধ খেয়ে যেতেই হচ্ছে। এই ব্যয় বহন করার সামর্থ্য অনেকের নেই। আবার অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করতে দেওয়ার মতো কিছু অনৈতিক বিষয়ের কারণেও মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। স্বাস্থ্য খাতে মানুষের ব্যয়ের বোঝা কমানোর উপায় সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা একটি বিশেষায়িত বিষয়। এক্ষেত্রে সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া বাঞ্চনীয়। তা নাহলে, সুস্থ জাতি গঠন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন