শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

আইসিইউ’র জন্য হাহাকার

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ছে ব্যাপক হারে। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যু রেকর্ড ছাড়াচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ৭৬২৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুবরণ করেছে ৬৩ জন। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনার প্রকোপ। রাজধানী ঢাকার হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও ভর্তি হতে পারছেন না এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। শুধু সরকারি হাসপাতালই নয়, রাজধানীর বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালেও করোনা রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। একটি আইসিইউ শয্যার জন্য আকুতি এখন অনেকের। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও একটি আইসিইউ বেড খালি পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি সাধারণ শয্যাও মিলছে না অনেক হাসপাতালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণের রাশ টেনে ধরা না গেলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তালিকাভুক্ত রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউতে বেড রয়েছে মোট ৩০৫টি। এর মধ্যে গতকাল সকাল পর্যন্ত ফাঁকা ছিল মাত্র ২০টি বেড। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিকাল নাগাদ সকল আইসিইউ বেডই পূরণ হয়ে গেছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার কারণে হাসপাতালগুলো ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। তবে সঠিক নির্দেশনা মেনে না চললে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। চিকিৎসক এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাসপাতালগুলোর ওপর যে হারে চাপ বাড়ছে, তাতে করোনাভাইরাসের চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালের ওপর চাপ কমাতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের ব্যাপারে জোর দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। সরকারও নামমাত্র লকডাউন বা ১৮ দফা নির্দেশনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সন্দেহ রয়েছে।

রেজিয়া আক্তারের (৫৩) করোনায় ফুসফুসের ৬০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত। রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালেও সাধারণ বেড বা আইসিইউ বেড কোনোটাই ফাঁকা না থাকায় ভর্তি হতে পারেননি। আইসিইউ বেডের জন্য খোঁজ নেন একে একে ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভার কেয়ার, ইউনিভার্সেলসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে। কিন্তু দিনভর খুঁজে কোথাও মেলেনি একটি বেড। রোগীর আত্মীয় নূরুল ইসলাম জানান, উপায় না পেয়ে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে বাসায় সিলিন্ডার কিনেই সেবা দিচ্ছেন রেজিয়া আক্তারকে। ইসমাঈল হোসেন রাসেল নামে আরেকজন জানান, তার বৃদ্ধ নানা মো. আবু মুসার (৭৫) জন্য গত দু’দিন থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ বেড খুঁজছেন। কোথাও মিলাতে পারছেন না একটি বেড। অসুস্থ নানাকে নিয়ে কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না রাসেল। এটা শুধু এই দুই রোগীর ক্ষেত্রে তা নয়; রাজধানীর অধিকাংশ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে একই চিত্র পাওয়া গেছে। কোথাও নেই সাধারণ বেড বা আইসিইউ বেড।

সূত্র মতে, রাজধানীর বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতালে খালি নেই একটিও আইসিইউ। কোনো শয্যা খালি হলে তা পূরণ হতে ১০ মিনিটও লাগছে না। আইসিইউ শয্যার এই সঙ্কট শুধু সরকারি হাসপাতালেই নয়, বেসরকারি হাসপাতালের চিত্রও ঠিক একই রকম। রাজধানীর বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালেই আইসিইউর পাশাপাশি খালি নেই সাধারণ শয্যাও। কয়েকটি হাসপাতালে ফোন দিয়ে পাওয়া গেল একই তথ্য। করোনা রোগীর চাপ এতই বেড়েছে যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড পেতে আগে থেকে সিরিয়াল দিয়ে রাখতে হচ্ছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজ্জাদুর রহমান শুভ জানান, হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় সাধারণ শয্যা বা আইসিইউ শয্যা কোনোটাই ফাঁকা নেই। রোগীদের চাপ সামলাতে বা বাড়তি সেবা প্রদানে বেড বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। তবে অনুমোদন, ডাক্তার, নার্স সঙ্কটসহ নানামুখী কারণে রাতারাতিই বেড বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন এভারকেয়ার হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার জামিল আহমেদ।

ল্যাবএইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-ই-খুদা দীপ জানান, ল্যাবএইড হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসায় ৮২টি সাধারণ শয্যা এবং ৮টি আইসিইউ শয্যা। কিন্তু বর্তমানে ৯০টি শয্যাতেই করোনা রোগীরা সেবা নিচ্ছেন।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের গতকালের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতালের ১৬টি আইসিইউ বেড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ১০টি, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৬টি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০ বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি আছে। কেবলমাত্র শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের ১৬ বেডের মধ্যে দুইটি, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের ১৯ বেডের মধ্যে একটি, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ১০ বেডের মধ্যে ছয়টি, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালের ১৫ বেডের মধ্যে একটি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ বেডের মধ্যে একটি মাত্র আইসিইউ বেড ফাঁকা রয়েছে।

এতদিন অধিদফতরের তালিকাভুক্ত বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড ফাঁকা থাকলেও সেখানেও কমতে শুরু করেছে আইসিইউ বেড। তালিকাভুক্ত আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২২ বেড, আসগর আলী হাসপাতালের ১৮ বেড, ইবনে সিনা হাসপাতালের ৭টি বেড, ইম্পালস হাসপাতালে ৫২ বেড, এ এম জেড হাসপাতালের ১০ বেড আর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ৯টি বেডের সবগুলোতে রোগী ভর্তি রয়েছে।
শুধুমাত্র স্কয়ার হাসপাতালের ১৯ বেডের মধ্যে তিনটি, ইউনাইটেড হাসপাতালের ১৫ বেডের মধ্যে চারটি, এভারকেয়ার হাসপাতালের ২১ বেডের মধ্যে দুইটি বেড ফাঁকা রয়েছে। অর্থাৎ অধিদফতরের তালিকাভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের মোট ৩০৫টি আইসিইউ বেডের মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন ২৮৫ জন আর বেড ফাঁকা রয়েছে মাত্র ২০টি।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, আমরা যদি সংক্রমণ কমাতে না পারি তাহলে বিভিন্ন দেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি সেটা আমাদের দেশেও ঘটবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে কোভিড রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫৬৬টি। আর রাজধানী ঢাকাতে রয়েছে ৩০৫টি আইসিইউ বেড। অধিদফতর জানায়, রাজধানীর বাইরে সারাদেশে এতদিন আইসিইউ বেড ফাঁকা থাকার চিত্র দেখা গেলেও এখন ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম গত মঙ্গলবার বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছেই। আর এমন অবস্থায় বাড়ছে হাসপাতালে রোগীর ভিড়। এভাবে চলতে থাকলে শুধু হাসপাতাল বাড়িয়ে করোনা সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংখ্যা দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে সাধারণ শয্যাও বাড়ানো হবে এ সময়ের মধ্যে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, ইতোমধ্যেই ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এর সুফল দেখা যাবে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও বিভিন্ন হাসপাতালের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সিদ্ধান্ত হয়েছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালেই আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা বাড়ানোর বিষয়ে। মূলত দেশের বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও করণীয় ঠিক করতে বৈঠকটি হলেও এতে হাসপাতালে শয্যার বিষয়েও আলাপ হয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গতকাল বলেছেন, হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ অনেক বেড়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণে আইসিইউ বেড, টেস্ট ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। তবে সঠিক নির্দেশনা মেনে না চললে করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। একই সঙ্গে বর্তমান অবস্থায় সেবা বাড়ালেও অধিক চাপের কারণে অনেকেই করোনায় পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, করোনায় ব্যক্তিগত ক্ষতির পাশাপাশি সরকারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Mamunur Rashid ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৬ এএম says : 0
এখন আর উপদেশ কিংবা নির্দেশনা নয়" স্বাস্থ্যবিধি মানতে এখনই বাধ্য করা উচিত" ভ্রাম্যমান আদালত নয়, পুলিশকে আগের মতো অ্যাকশনে নামানো উচিত।
Total Reply(0)
Morshed Shahed ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৬ এএম says : 0
আইসিইউ নাই,চিকিৎসা ব্যাবস্থার উন্নতি নাই আছে শুধু চেতনা,গর্ব আর সাফল্যের গালগল্প।
Total Reply(0)
Rafiqul Islam ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৭ এএম says : 0
জনগনের করের টাকায় হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হচ্ছে, হাজার কোটি টাকায় শতবর্ষ পালন, আতশবাজি, ডিজিটাল সাইনবোর্ড, লালনীল বাতির ঝলকানিতে সারাদেশে আনন্দের বন্যা এসব আনন্দ ফুর্তি বাদ দিয়ে করোনা রোগীর চিকিৎসা সরঞ্জাম সহ আইসিইউ বেড কিনলে করোনা রোগীদের কষ্ট কিছুটা হলে লাঘব হতো। হে আল্লাহ তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা।
Total Reply(0)
Owahiduzzaman Fakir ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৭ এএম says : 0
হাসপাতালের অবস্থা ভয়াবহ সীট পাওয়া যায় না।
Total Reply(0)
Himel Hussen Himu ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৮ এএম says : 0
অথচ গত এক বছরে হাসপাতালের আইসিওর সংখ্যা বাড়াতে পারতেন সরকার বাহাদুর। তা না করেই চাপাবাজি, গলাবাজি করে বলা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশ্বমানের।।।
Total Reply(0)
Sumon Sps ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৮ এএম says : 0
আল্লাহ বাংলাদেশটাকে রক্ষা করুন, বাংলাদেশের মানুষের ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা খুবই ক্ষীণ হয়ে গেছে, যার কারণে এরকমভাবে সংক্রমণ বাড়তেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ সচেতনতা মেনে না চলবেন ততদিন পর্যন্ত এটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে ।
Total Reply(0)
Md Majedul Islam ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৮ এএম says : 0
আপনারা যারা করোনাভাইরাস নিয়ে উদাসীন তাদের একবার অনুরোধ করবো আপনারা শুধু হাসপাতালগুলোর একটু খবর নেন কি অবস্থা। বর্তমান একটা আইসিইউ বেড যেন সোনার হরিণ। আর বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কি রকম সেটাও আপনাদের বোঝা উচিত তাই এখনই সময় সাবধান হওয়ার
Total Reply(0)
Mohammad Wasim ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৯ এএম says : 0
আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর গর্জন শুনলে মনে হয় যে আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা সিঙ্গাপুরের চেয়ে....ভাল
Total Reply(0)
Rayhan Kabir ৮ এপ্রিল, ২০২১, ১২:২৯ এএম says : 0
দেশ আমার উন্নয়নের চরম শিখরে আইসিইউ সংকট, চিকিৎসা ব্যাবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম এগুলো ডাহা মিথ্যা কথা সব হেফাজতের ষড়যন্ত্র
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন