মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রক্তাক্ত হয়েছে দেশ। এ দিনে নিহত-আহত ও গ্রেফতার হয়েছে বহু মানুষ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদীর আগমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে এসব হয়েছে। মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে দেশের বাম-ডান-মধ্য তথা বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ও সংগঠন প্রতিবাদমুখর হয়েছিল। তারা মিছিল-মিটিং করেছে, বিবৃতি দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি প্রতিবাদ সমাবেশই বাধা ও লাঠিপেটার শিকার হয়েছে। অনেকে আটক হয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোদীবিরোধী মন্তব্য করায় অনেককে আটক করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও কয়েকদিন বন্ধ ছিল। বিভিন্ন গুজবও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে, ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে। যার সূচনা হয় বায়তুল মোকাররমে। সেদিন জাতীয় মসজিদে জুমা’র নামাজের পর কিছু লোক মোদী বিরোধী বিভিন্ন শ্লোগান দেয় ও মিছিল করার চেষ্টা করে। তাতে পুলিশ ও সরকারের হেলমেট বাহিনী ব্যাপক হামলা, টিয়ারগ্যাস ও গুলি চালায়। বহু লোক আহত হয়। ফলে সারা দেশের হেফাজতপন্থীরা চরম বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে দেশব্যাপী। সে সময় হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়া, মোদী এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হচ্ছে: বায়তুল মোকাররমে আক্রমণ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসা আক্রান্ত না হলে মোদীবিরোধী আন্দোলনে দেশব্যাপী যে ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা হতো না। মোদী বিরোধীরা ২/১ দিন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করে চুপ হয়ে যেত। দেশের রাজনীতিকে যে হিমাগারে ঢুকানো হয়েছে, সেখানেই ঢুকে যেত।
বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত উন্নতির জন্য বিদেশের ব্যাপক সহায়তা তথা বিনিয়োগ, ঋণ ও বাণিজ্যিক সুবিধা প্রয়োজন। সেসব করেও আসছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। তাই তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বলে খ্যাত। তাদের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে কিছু দেশের মধ্যে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, যা প্রকাশ্যরূপও পেয়েছে। বাংলাদেশে চীনের আর্থিক কর্ম বৃদ্ধি পাক তা চাচ্ছে না ভারত। তাতে কিছু ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সাথে চুক্তি হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু সেটা ভারতের আপত্তির কারণে বাতিল করা হয়েছে। সেটা এখন করা হচ্ছে মহেশখালীতে, জাপানের সহায়তায়। চীনের প্রস্তাবিত ও ঋণে নির্মিতব্য ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনারও বিরোধিতা করছে ভারত। এরূপ আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। ভারতের এ আচরণের কারণ চীন-ভারত প্রচন্ড শত্রুতা। এটা সৃষ্টি হয়েছে সীমান্তবিরোধ ও এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। উভয় দেশই এশিয়ার পরাশক্তি হতে ইচ্ছুক। তাই উভয়েই এশিয়ার দেশগুলোকে পক্ষভুক্ত করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ-ভারত গভীর সম্পর্ক রয়েছে স্বাধীনতাত্তোর থেকেই। তাই ভারতের আকাক্সক্ষা, যেহেতু চীন তাদের শত্রু, তাই চীন বাংলাদেশের বন্ধুত্ব হবে কেন? বাংলাদেশ কেন চীনের সুবিধা নেবে? তৎপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ থেকে বহুবার বলা হয়েছে, চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব হলেও বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভীও গত ২৩ মার্চ বলেছেন, ভারত ও চীনের মধ্যে শুধু এক দেশকে বেছে নেবে না বাংলাদেশ। তবুও ভারত বাংলাদেশ-চীনের বন্ধুত্বের বিরোধিতা করেই চলেছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। তাই বন্ধুত্ব কার সাথে করবে, আর কার সাথে করবে না, সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে কারো নাক গলানোর অধিকার নেই। বিশ্বের সব স্বাধীন দেশের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। এটাই বিশ্ব নীতি। দ্বিতীয়ত: ‘খালি মুখে চিড়ে ভেজে না। চিড়ে ভেজার জন্য দুধ কলা লাগে’। গত সেপ্টেম্বের আল জাজিরার খবরে প্রকাশ, ‘চীন বাংলাদেশকে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার সহায়তা এবং ঋণ সহায়তার অঙ্গীকার করেছে, যেখানে ভারত ৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি আর্থিক প্যাকেজের প্রস্তাব দেয়’। চীন তার প্রতিশ্রুত সহায়তা পর্যায়ক্রেম বাস্তবায়ন করছে। উপরন্তু বাংলাদেশের ৮৭টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এসব সুবিধা যদি ভারত বাংলাদেশকে দিত, তাহলে তো চীনের সহায়তা নেয়ার দরকারই হতো না বাংলাদেশের। কিন্তু ভারত তা করছে না। সে সামান্য বিনিয়োগ ও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কয়েক বছর আগে। কিন্তু তারও কিঞ্চিত মাত্র বাস্তবায়ন করেছে। তাও কঠিন শর্তে। সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল ও জনবল নিতে হবে ভারত থেকেই। তাও অধিক মূল্যে। উপরন্তু যেখানে ভারতের লাভ রয়েছে, শুধু সেখানেই বিনিয়োগ করছে তারা। ট্রানজিটের ক্ষেত্রেও তাই। ভারতের যে ট্রানজিট নেয়া দরকার, তার সবই নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে। উপরন্তু সেই ট্রানজিটের মাধ্যমে ভারত সব পণ্যই বহন করছে। কিন্তু বাংলাদেশের ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সে সুবিধা দেয়নি ভারত। মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য নেপাল-বাংলাদেশ চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সেটি তেমনিভাবে কার্যকর হতে পারছে না। ভারত তার ভূখন্ড ব্যবহারের অনুমতি দিচ্ছে না। স¤প্রতি অনুমতি দিয়েছে, তাও শুধু সার নেয়ার জন্য, অন্য পণ্য নয়! কিন্তু কেন? ভারতের ভেতর দিয়ে নেপাল ও ভুটানের সস্তা পানিবিদ্যুৎ নেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ বহুদিন থেকেই। কিন্তু ভারত তার অনুমতি দিচ্ছে না। পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইরানের তেল-গ্যাস নেয়ার চুক্তি করেছে ভারত পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে। এ নিয়ে ত্রিদেশীয় চুক্তি হয়েছে। পাইপ লাইন স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ এতে শরীক হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সফল হয়নি ভারতের আপত্তির কারণে। ভারতের কথা ইরান থেকে সরাসরি তেল-গ্যাস নেয়ার দরকার নেই। সেটা আমাদের নিকট থেকে নিতে হবে। অর্থাৎ ভারত তাতে মধ্যস্বত্বভোগী হিসাবে ব্যাপক লাভ করবে! বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও তাই। ভারতের সব পণ্যই বাংলাদেশে আসছে বিনা বাধায়। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য যেতে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করে রেখেছে ভারত। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ সামান্য। তাই দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি পর্বত সমান, যা ভারতের অনুক‚লে। সর্বোপরি ভারত চুক্তির পণ্য ঠিকমত দেয় না, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ পিয়াজ ও করোনার টিকা। ভারত আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায্য পানি দিচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়নি। এমনকি গত ২৭ মার্চ ঢাকায় হাসিনা-মোদী বৈঠকেও বহুল আকাক্সিক্ষত তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মোদী কিছু বলেননি। ফারাক্কা চুক্তি হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী পানি পাওয়া যায় না। সীমান্ত হত্যার তো ইয়ত্তা নেই। এ নিয়ে দু’দেশের মধ্যে অনেক বৈঠক হয়েছে। তাতে হত্যা বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবুও হত্যা চলছেই। উপরন্তু স¤প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফরকালে বলেছেন, ‘নো ক্রাইম, নো ডেথ’। অর্থাৎ বাংলাদেশের লোক সীমান্তে অপরাধ করে বলেই হত্যার শিকার হচ্ছে। এ ধরনের কথা এ দেশেরও কিছু লোক বলেন। কিন্তু এভাবে হত্যা কি ভারতের অন্য সীমান্তে হচ্ছে? নাকি কোথাও হয়? না, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের মতো নির্বিচারে ব্যাপক হত্যা হয় না কোথাও। ভারতের টিভি চ্যানেলগুলো দেখতে দেখতে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তবুও ভারতীয় চ্যানেলগুলোই দেখছে এ দেশের মানুষ। অথচ, বহু দেন-দরবার করেও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো ভারতে দেখানো যাচ্ছে না। ভারত এ দেশের অভ্যন্তরীন বিষয়ে অনবরত নগ্ন হস্তক্ষেপ করে আসছে স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকেই।
স্বাধীনতাত্তোর থেকে এ পর্যন্ত ভারতের দ্বারা বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অন্য কোনো দেশের দ্বারা হয়নি। এরূপ অবস্থা পার্শ্ববর্তী সব দেশের সাথেই করেছে ভারত। তাই পার্শ্ববর্তী প্রায় সব দেশ ভারতকে ত্যাগ করে চীনের সাথে সুসম্পর্ক করেছে। অর্থাৎ ভারতের দাদাগিরি বুমেরাং হয়েছে। বাকী আছে শুধু বাংলাদেশ। তবে এদেশের বেশিরভাগ লোক ভারতের আধিপত্যবাদের প্রচন্ড বিরোধী। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ভারতের দাদাগিরিকে পাত্তা দেননি। তিনি স্বাধীনতার পরপরই ভারতের সেনাদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, যা ছিল খুবই সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নতুবা ভারতীয় সেনারা জেঁকে বসে থাকতো বহুদিন। সহজে হঠানো যেত না। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রবল বাধা উপেক্ষা করে পাকিস্তানে গিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালে, ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে। প্রেসিডেন্ট জিয়াও ভারতের আধিপত্য মেনে নেননি। দক্ষিণ তালপট্টি থেকে ভারতের দখলদার সেনাকে হঠানোর জন্য সেনা পাঠিয়েছিলেন সেখানে এবং জাতিসংঘে বিচার দিয়েছিলেন। তদ্রূপ মানসিকতা এ দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই, যা সম্প্রতি পুনরায় প্রমাণিত হয়েছে মোদীর সফরকালে। ওদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনার দ্রুত বাস্তবায়ন, তিস্তা চুক্তি সই করাসহ ছয়দফা দাবিতে তিস্তা নদীর দুই পাড়ে দীর্ঘ ১১৫ কিলোমিটার এলাকার হাটবাজারে ১০ মিনিটের ‘স্তব্ধ কর্মসূচি’ পালিত হয়েছে গত ২৪ মার্চ। তাতে অগণিত মানুষ সমর্থন জানিয়েছে (মওলানা ভাসানীও ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী ঐতিহাসিক লংমার্চ করেছিলেন ১৯৭৬ সালে। তাতে সারাদেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ শরীক হয়েছিল)। দল-মত নির্বিশেষে এ দেশের বেশিরভাগ মানুষই ভারতের আধিপত্যবাদের ঘোর বিরোধী। তাই ভারতের অনেক মিডিয়া ও থিংক ট্যাংক বাংলাদেশের গণ আকাক্সক্ষার মূল্যায়ন করার পরামর্শ দিয়েছে দেশটির কর্ণধারদের। অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি কর্ণধাররা। কারণ, তাদের এমনকি দেশটির বেশিরভাগ মানুষের ও সব রাজনৈতিক দলের সার্বক্ষণিক ধ্যান-জ্ঞান পার্শ্ববর্তী সব দেশ নিয়ে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। দীর্ঘকালেও সে মনোবাসনা পূর্ণ হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। কারণ, সব দেশই পূর্ণ স্বাধীন, জীবনের বিনিময়ে হলেও তাদের জনগণ রক্ষা করবে স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সাথে অনেক কারণেই বন্ধুত্ব চায়। তবে সেটা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ও আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে নয়, সম অধিকার ও সম মর্যাদার ভিত্তিতে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন