মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বাসন্তীকে নিয়ে ব্যবসা করছে ৮ এনজিও

উত্তরের নদীর বাঁকে বাঁকে-৯

স্টালিন সরকার (চিলমারী থেকে ফিরে) | প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’। মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের সেই চিলমারীর বন্দর আর আগের মতো নেই। কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের সেই বন্দরে এখন পানসি নৌকা, পাট বোঝাই নৌকা, যাত্রী নিয়ে স্টীমার ভেড়ে না। গোটা ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের বন্দর এলাকা ধু ধু বালুচর। যেদিকে চোখ যায় শুধু বালুর স্তর। পানি প্রবাহের অভাবে যেন মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র নদ।
চিলমারির রমনা মডেল ইউনিয়ন (রেল স্টেশন) পরিষদের সামনে চা খেয়ে রওয়ানা দিলাম ব্রহ্মপুত্র নদের দক্ষিণ অংশ দেখতে। সঙ্গে স্থানীয় সংবাদিক মো. ফয়সাল হকসহ আরো দু’জন। নদ পাড়ের মাঝিপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, রমনা খামার, ব্যাঙ মারা, ভরাট গ্রাম, সাতঘড়িপাড়া, তেলিপাড়া, সাঁখাহাতি, ছলিপাড়া, পুরান বাজার, পাত্রপাড়া ঘুরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলি। মানুষ বলতে সবাই গরির কৃষক-বর্গাচাষি, জেলে। চরের মানুষ নিজেদের দুঃখ দুর্দশা, এক সময়ের যৌবনা ব্রহ্মপুত্র নদের শুকিয়ে যাওয়ার কাহিনী, চিলমারী বন্দরের বালুরাশি ইত্যাদি চালচিত্র তুলে ধরেন। একজন জানালেন, দু’তিন বছর আগেও বন্যার সময় ভারতের আসাম থেকে এই নদ দিয়ে হাতি ভেসে এসেছিল। সে হাতি নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছিল।

এ সময় নতুন বালাজান গ্রামের মো. নজির হোসেনের পুত্র মো. মোখলেছুর রহমান এগিয়ে এসে বললেন, আমার নাম লেখেন। নদে পানি না থাকায় মাছ ধরতে পারি না। এখন ক্ষেতমজুরি দেই। নদের শুকিয়ে যাওয়ায় এই এলাকার যারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন; তাদের শতকরা ৫০ জন পেশা বদল করেছেন। সরকারের উচিত চীন ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করে নদের পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা। নদে পানি থাকলে মাছ পাবই। তবে তিস্তা নদী পাড়ের মানুষের চেয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের মানুষ কিছুটা ভালো আছেন। কারণ চিলমারীর অনেক পরিবর্তন হয়েছে; শিক্ষার হার বাড়ছে; মানুষ চাকরিবাকরি করছে। ব্যাপারী পাড়ার আবুল কালাম জানালেন, আগে মাছ ধরতেন। এখন নদে মাছ পাওয়া যায় না; তাই পুকুরের মাছের ব্যবসা করেন। বিভিন্নজনের পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করেন। আগে মংগা হতো, এখন আগের মতো মংগা হয় না। তবে যারা গরিব তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন, সামনের গ্রামে বাসন্তীর বাড়ি, দেখে যান তার জীবন চিত্র।

আবুল কালামের প্রস্তাব শুনেই ইনকিলাবের চিলমারি সংবাদদাতাকে বললাম, চলো বাসন্তীকে দেখে আসি? সে যেন প্রস্তাবের অপেক্ষায় ছিল। দু’টি বাইক বালুর রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে চললো বাসন্তীদের মাঝিপাড়া গ্রামের দিকে। শ্রীমতি বাসন্তী বালার নাম মনে আছে? ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ট্রাজেডির নাম দেয়া হয়েছিল ‘বাসন্তী’। কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় এক জেলে পরিবারের বাক-প্রতিবন্ধী মেয়ে বাসন্তীর জাল পরে লজ্জা নিবারণের ছবি ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেই বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত ছবির কাহিনী নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এখনো রয়ে গেছে। ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ দাবি করেছিলেন ছবিটি বাস্তব এবং তিনি ছবিটির নাম দিয়েছেন ‘জাল-বসনা বাসন্তী’। কিন্তু সে সময় ক্ষমতাসীন দলসহ অনেকেই বাসন্তীকে পরিকল্পিতভাবে জাল পরিয়ে ছবি তোলা হয়েছে বলে দাবি করেন। তাদের বক্তব্য ছিল ছবিটি সাজানো। যেদিন বাসন্তীর ছবি তোলা হয়, সেদিনও তার পরনে কাপড় ছিল। ছেঁড়া জাল পরিয়ে কৌশলে তাদের ছবি তোলা হয়। বাসন্তীকে নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতা ও নোংরা রাজনীতি হয়েছে বলে প্রচার করা হয়।

সেদিনের বাসন্তীকে নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেই বাসন্তী ৪৬ বছর পর এখন কেমন আছেন সংবাদকর্মী হিসেবে তা দেখতেই মাঝিপাড়া যাওয়া। ধু ধু বালুর মধ্যেই দেশি-বিদেশি গাছ লাগানো মাঠ পেরিয়ে বাসন্তীর বাড়িতে যখন পৌঁছি তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রথমেই চোখে পড়ল টিনের ছোট্ট ঘরে সাইনবোর্ড। লেখা ‘শ্রীমতি বাসন্তী বালা, মাঝিপাড়া, রমনা, চিলমারী, কুড়িগ্রাম। ঘর নির্মাণ ২০ জানুয়ারি ২০১৯ ইং। সাইনবোর্ডে জেলা প্রশাসকের ছবি (নারী)। সাংবাদিক এসেছে শুনে বাক-প্রতিবন্ধী বাসন্তী ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। না! সব ধারণাই মিথ্যা প্রমাণ হলো। ৪৬ বছরেও বাসন্তীর জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ঘরের চৌকি ভাঙা, সেখানে বসার কোনো অবস্থা নেই। যেন পল্লীকবি জসিম উদ্দিনের ‘আসমানী’দের বাসা কবিতার মতোই। পাশের বাড়ি থেকে টুল এসে প্রধান অতিথিকে বসতে দেয়া হলো। অন্যান্য অতিথিরা বসার সুযোগ পেলেন না। শ্রীমতি বাসন্তী এখনো উপোষ থাকেন; তিন বেলা খেতে পারেন না। তার ভাইয়ের স্ত্রী নিরুবালা (বাসন্তীর ভাবি) পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়েই সংসার চলে। সংসার বলতে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। বেশিরভাগ সময় না খেয়েই থাকতে হয়।

বাসন্তী কথা বলতে পারেন না। অতিথিদের দেখে আশপাশের ঘরের বউ-ঝিরা এসে ভিড় করছেন। পাশের ঘরের শ্রী আকাশ চন্দ্র দাসের স্ত্রী সুরবালা নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথা বললেন। তিনি বললেন, নিরুবালা পরের বাড়িতে বাদাম তোলা, কলাই তোলার কাজ করেন। এতে যা পান তা দিয়ে সংসার চলে। বাসন্তীর এক ভাই বেঁচে রয়েছেন। সে অন্যত্র থাকেন তবে কাজ করতে পারে না। সুরবালা জানালেন, বাসন্তী বয়স্কভাতা মাসে ৫শ টাকা পান। তিন মাস পর পর সে ভাতা দেয়ার কথা থাকলেও ৫ মাস পর দেয়া হয়। করোনার সময় গত ভাদ্র মাসে সরকার থেকে ৩ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কথা বলতে না পারায় পরবর্তীতে বাসন্তীর নাম কেটে দেয়া হয়েছে। এতক্ষণ মিলন চন্দ্র দাসের স্ত্রী শ্রীমতি কুমতি রানী দাস অদূরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, হামার কাছে এনজিওর কাহিনী শোনবেন? বাসন্তীকে নিয়ে এনজিওগুলো ব্যবসা করছে। অথচ বাসন্তী ভাত পায় না। তিনি জানালেন, উদ্দীপন, গণশিক্ষা, মহিলাদের যুব সমাজ কল্যান, এসো দেশ গড়ি, সংঘ প্রকল্প, আহা প্রকল্প, দারিদ্র মুক্ত সমবায় সমিতি, আরডিআরএস নামের এনজিও মাঝে মধ্যেই বাসন্তীর খোঁজ খবর নেয়। মাঝে মাঝে ছবি তোলে, কাগজে টিপ নিয়ে যায়। কিন্তু বাসন্তীকে ৫’শ-এক হাজার টাকার বেশি দেয় না। অথচ বাইরে প্রচার এনজিওগুলো বাসন্তীর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছে। নিজের চোখে দেখছেন তো বাসন্তীর ঘরের অবস্থা। বাসন্তীকে নিয়ে এনজিওগুলো ব্যবসা করছে। এই সত্যটা শক্ত করে লিখবেন তো?

বাইকে করে মাঝিপাড়া প্রবেশের সময় এবং রমনা ইউনিয়ন পরিষদের সামনে রাস্তায় বেশ কয়েকটি এনজিওর সাইনবোর্ড চোখে পড়েছে। হ্যাঁ, নিরক্ষর কুমতি রানী দাস যে এনজিওর নামগুলো বললেন সে গুলোরই সাইনবোর্ড। এমনকি বাসন্তীর ঘরে প্রবেশ করতে যে গাছগাছালি পেরিয়েছি সেখানেও গাছে কয়েকটি এনজিওর সাইনবোর্ড ঝুলানো দেখেছি। মাঝি পাড়া গ্রামের গনেশ চন্দ্র দাসের ছেলে শ্রী নয়ন চন্দ্র দাস বললেন, এই গ্রামের সব পরিবারের মাছ ধরা পেশা। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যাওয়ায় এখন মাছ পাওয়া যায় না। অথচ চালের দাম বেশি। সে জন্য অনেকেই পেশা বদল করে শহরে (কুড়িগ্রাম-রংপুর) গেছেন রিকশা চালাতে। অনেকেই কুলির কাজও করেন ঢাকায়। তবে কেউ কেউ এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসাপাতি করছেন। কিন্তু কিস্তি দিতে পারবেন না সে জন্য বাসন্তীকে এনজিও ঋণ দেয় না। অথচ প্রায় তার ছবি তুলে নিয়ে যায়। জগলু দাসের স্ত্রী ফলো রানী দাস জানান, তার স্বামীর পরিবার ও বাপের পরিবার সকলের পেশা নদের মাছ ধরে বিক্রি করা। জন্মের পর থেকে তিনি সেটাই দেখে আসছেন। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নদের পানি শুকিয়ে শত শত চর জেগে উঠেছে। নদের পানি প্রবাহ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়েছে। কম পানিতে মাছ পাওয়া যায় না। তাই পেশা বদলে বাধ্য হয়ে স্বামী এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে রমনা বাজারে চা-পান বিক্রি করে। চালের দাম বেশি হওয়ায় এসে সংসার চলে না। কিন্তু কিস্তি দিতে হয় নিয়মিত।

বাসন্তীর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথেই দেখা হলো দু’জন এনজিও কর্মীর সঙ্গে। তারা পাশের গ্রামের ছেলে। এনজিওতে চাকরি করেন। আবদুল হক নামের যুবক ‘দারিদ্র্য মুক্ত সমবায় সমিতি’র স্থানীয় প্রতিনিধি। আর সুজাউদ্দিন ‘সংঘ প্রকল্প’ এনজিওতে চাকরি করেন। তারা জানালেন, তারা ঋণ দেন; প্রতি সাপ্তাহে ঋণের কিস্তি তোলেন। এছাড়া তারা কিছুই জানেন না। ‘দারিদ্র্য মুক্ত সমবায় সমিতি’র আবদুল হকের গায়ের শার্ট দেখে মনে হলো এনজিওতে চাকরি করায় হয়তো ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ের এই যুকবের দরিদ্রতা কিছুটা হলেও দূর হয়েছে। কিন্তু বাসন্তী এবং তার বাড়ির আশপাশের ঘরগুলোতে যারা বসবাস করেন তাদের কারোই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সবারই জীর্ণ দশা। কিন্তু এনজিওগুলো বাক-প্রতিবন্ধী বাসন্তীকে নিয়ে রমরমা ব্যবসা চালিয়েই যাচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (5)
মুক্তিকামী জনতা ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১১ এএম says : 0
উত্তরাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ইনকিলাবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
Total Reply(0)
রুবি আক্তার ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১২ এএম says : 0
এই ধরনের রক্ত চোষা এনজিওগুলো বন্ধ করা হোক।
Total Reply(0)
তপন ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১২ এএম says : 0
ন;দীনালাগুলো শুকিয়ে গিয়ে হাহাকার বইছে আমাদের অঞ্চলে।
Total Reply(0)
রফিকুল ইসলাম ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১৩ এএম says : 0
সরকারের কাছে নদী উদ্ধারের দাবি জানচ্ছি।
Total Reply(0)
তোফাজ্জল হোসেন ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১:১৩ এএম says : 0
স্টালিক সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানাই । আশা করি সরকার প্রতিবেদনটি আমলে নেবে।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন