‘ধনীদের দখলে রোড, গরিবের দখলে ঢাকার ফুটপাথ, এই হলো রাজধানীর লক+ডাউন’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবেই গত কয়েক দিনের লকডাউনের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ ৪ এপ্রিল ১১ দফা নির্দেশনা জারি করে লকডাউন দেয় ৫ এপ্রিল থেকে। এর আগে সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ১৮টি নির্দেশনা জারি করা হয়। কিন্তু সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা এবং স্ববিরোধী নানা সিদ্ধান্তে ঘোষিত লকডাউন কার্যত তামাশার লকডাউনে পরিণত হয়। বইমেলা ও বাংলাদেশ গেইম চালু রেখে গণপরিবহন ও মার্কেট বন্ধ রাখায় ব্যবসায়ীরা রাজপথে নামে। সরকার পরে গণপরিবহন চালু এমনকি মার্কেটও চালুর ঘোষণা দেয়। অথচ বিশেষজ্ঞরা প্রথম থেকেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোরভাবে একটানা ১৪ দিন লকডাউনের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি প্রতিদিনই আগের দিনের চেয়ে আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। সংক্রমণ শনাক্ত ও মৃত্যুর দৈনিক সংখ্যা বাড়ছে টানা ৬ সপ্তাহ ধরে। বাড়ছে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হারও। বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ নিয়ে মার্কিন এক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থার প্রক্ষেপণ (করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির হার নিয়ে গবেষণা) বলছে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশে করোনা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণ পরিস্থিতি চূড়ায় উঠতে সময় নিতে পারে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ অবস্থায় কঠোর লকডাউনের বিকল্প নেই। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সব কিছু লক করে লকডাউনের বিকল্প নেই। এ অবস্থায় গতকাল জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জানিয়েছেন, আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে ৭ দিনের জন্য ‘কঠোর লকডাউন’ দেয়া হবে। এ সময় জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি-বেসরকারি সব অফিস বন্ধ থাকবে। অথচ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সপ্তাহ লকডাউনের বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন দিতে হয় কমপক্ষে দুই সপ্তাহ (১৪ দিন)।
করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমি আগেও বলেছি লকডাউন কঠোরভাবে কমপক্ষে ১৪ দিন করতে হবে। তারপর পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে বর্তমানে করোনাভাইরাস দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটিই সবচেয়ে বেশি ক্রিয়াশীল। বর্তমানে সংক্রমিতদের ৮০ শতাংশই এতে আক্রান্ত। ভয়াবহ এ ধরনের সংক্রমণের সম্ভাবনা ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ। আমরা যদি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষও কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি, তাহলে নিশ্চিতভাবে করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণ সামাল দিতে পারব। এই ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য প্রতিটি দেশের জীবনব্যবস্থা ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। কঠোর লকডাউন করতে পারলে আমরা উচ্চসংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারব।
জানতে চাইলে আইইডিসিআরের বর্তমান প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, এর আগেও এমন অনেক করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে লকডাউন নিয়ে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অনেকগুলো শর্ত বিবেচনা করে এমন প্রক্ষেপণ করা হয়। এটা করা হয় সাবধানতার জন্য। আপনি যদি সেবা না বাড়ান ও যথাযথ ব্যবস্থা না নেন তাহলে এমনটি হতে পারে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিদিনই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত একই চিত্র দেখা যাচ্ছে। আগে রাজধানী ঢাকায় করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বেশি হলেও এখন জেলা পর্যায়ের শহরগুলোতে সংক্রমণ বেড়ে গেছে। গতকালও দেশে করোনাভাইরাসে একদিনে ৭ হাজার ৪৬২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এ সময় মারা গেছে ৬৩ জন। দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৯৪ জন। আর মারা গেছেন ৯ হাজার ৫৮৪ জন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আগেই জানিয়েছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। সঙ্গে বাড়ছে জনগণের অবহেলা ও উদাসীনতা। দেশের হাসপাতালগুলোতে এখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সারাদেশকে হাসপাতাল বানালেও করোনা রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হবে না। এর আগে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চলমান এক সপ্তাহের লকডাউনে জনগণের উদাসীন মানসিকতার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় সরকার জনস্বার্থে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের বিষয়ে সক্রিয় চিন্তা-ভাবনা করছে।
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গতকাল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সুশীলসমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। সকলের বক্তব্য সরকারের দায়িত্বশীলদের পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত ও কথাবার্তায় লকডাউন তামাশায় পরিণত হয়েছে। কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চাচ্ছেন না। সরকার কঠোর হলে এবং দায়িত্বশীল কথাবার্তা বললে মানুষ লকডাউন মানতে বাধ্য হবে। তারা বলেন, অপ্রিয় হলেও সত্য ক্ষমতাসীনরা দলীয়ভাবে ব্যবহার করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পুলিশের তৎপরতার মুখেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। তবে দেশপ্রেমী সেনাবাহিনীর ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। করোনার ভয়াবহতা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজনে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবিকে মাঠে নামিয়ে লকডাউন বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরামর্শক ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আইএইচএমই বাংলাদেশের বর্তমান করোনার ভয়াবহতা নিয়ে এমন প্রক্ষেপণ করেছে। এসব সংস্থা বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে এমন মন্তব্য করে, যাতে সেসব দেশ সাবধান হয়। বেশ কয়েকটি বিষয়ের সরলরৈখিক বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এমন প্রক্ষেপণ করা হয়। তবে পরিস্থিতি কিন্তু এমন থাকে না। সংশ্লিষ্ট মহল সাবধানতা অবলম্বন করে ব্যবস্থা নিলে অবস্থার উন্নতি হয়।
এদিকে করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমানোর জন্য পরিপূর্ণভাবে অন্তত দুই সপ্তাহের লকডাউনের সুপারিশ করেছে। গতকাল শুক্রবার কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ পরামর্শের কথা জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ৭ এপ্রিল পরামর্শক কমিটির ৩০তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে কমিটি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সারাদেশে উদ্বেগজনকভাবে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত ১৮টি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। পরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ দেয়া হয়। কিন্তু এসব নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হচ্ছে না বলে মনে করে জাতীয় কমিটি। না মানায় সংক্রমণের হার বাড়ছে।
লকডাউন পালনের নির্দেশনা ও বিধিনিষেধ আরো শক্তভাবে অনুসরণ করা দরকার মনে করে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য পূর্ণ লকডাউন ছাড়া এটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলে সভায় মতামত জানান কমিটির সদস্যরা। দেশের সিটি করপোরেশন ও মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় পূর্ণ লকডাউন দেয়ার সুপারিশ করা হয়। দুই সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগে সংক্রমণের হার বিবেচনা করে আবার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে বলেও মতামত দিয়েছে কমিটি। একই সঙ্গে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতিতে হাসপাতালের সাধারণ বেড, আইসিইউ সুবিধা, অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচেষ্ট জানিয়ে কমিটি আশা করছে, ডিএনসিসি হাসপাতাল আগামী সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে। হাসপাতালে রোগী ভর্তির বাড়তি চাপ থাকায় সরকারি পর্যায়ের এই কার্যক্রমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অতি দ্রæত আরো সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে কমিটি মনে করে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, করোনার ভয়াবহতার মডেল করা হয় গাণিতিক বা জ্যামিতিক হারে। এমন প্রক্ষেপণের যে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন আছে এমন নয়। এক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যবস্থা নেয়া না হয় তাহলে এমনটি হতে পারে বলে এসব পরিসংখ্যান দেয়া হয়। মানুষ যদি সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তাহলে এমনটি হবে না।
বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ নিয়ে মার্কিন এক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা আইএইচএমই বলছে, বাংলাদেশে যে হারে করোনা বাড়ছে তাতে মে মাসের মাঝামাঝি সংক্রমণ চূড়ায় উঠবে। তখন দেশের হাসপাতালগুলোয় শুধু করোনা রোগীর জন্যই সাধারণ শয্যার প্রয়োজন পড়বে ৭৪ হাজার। এর মধ্যে আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন হবে ৭ হাজারের মতো। ভেন্টিলেটরের দরকার হবে ১৭ হাজারের কাছাকাছি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার। এসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৬০০। এছাড়া সারা দেশে করোনা রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৩টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ১ হাজার ২২টি ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ৮৯৭টি।
জানতে চাইলে সরকার গঠিত করোনা প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি পরিমর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতায় আইএইচএমইর প্রক্ষেপণ তথা বর্তমান পরিস্থিতিতে ওদের ধারণা ঠিকই রয়েছে। আমরা যদি এখনই কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারি তাহলে এমনটি হওয়া অবাস্তব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন