বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

তারল্য সঙ্কট মোচনে সচেষ্ট হতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। দিনে দিনে এ পাহাড় স্ফীত হচ্ছে। বিনিয়োগ না হওয়াই যে এর মূল কারণ, তা বলাই বাহুল্য। করোনাকালে বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে ব্যাংকগুলো টাকা নিয়ে মারাত্মক বিপাকে পড়েছে। করোনাকালের আগেও অনেক দিন ধরে বিনিয়োগে খরা চলছিল। গত বছর মার্চ থেকে করোনাকাল শুরু হলে এই খরা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। এই করোনাকালেই বিগত কয়েক মাস অর্থনীতিকে সচল বা চাঙ্গা করার প্রয়াস চালানো হয়। করোনাসংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। অনেকেই এ ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ার পর সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেছে। এখন করোনা ক্রমাগত ভয়ংকর রূপ পরিগ্রহ করছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। পরিস্থিতির এত দ্রুত অবনতির বিষয়টি কারো কল্পনাতেও ছিল না। এহেন বাস্তবতায় বিনিয়োগের সম্ভাবনা সম্পর্কে শংকিত হওয়ার সঙ্গত অবকাশ রয়েছে। ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সম্পর্কিত এক রিপোর্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানু-মার্চ) হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো প্রকাশ করেনি। তবে কর্মকর্তাদের ধারণা, ব্যাংকখাতে তারল্য সংকট এ সময়ে আরো বেড়েছে। তারল্য সংকটে ব্যাংক আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাংক আমানত রেখে আমানতকারীদের সুদ দিয়ে থাকে। আবার আমানতলব্ধ অর্থ অন্যকে ঋণ হিসাবে দিয়ে সুদ পেয়ে থাকে। আমানত ও সুদের হারের মধ্যে যে ব্যবধান, সেটাই ব্যাংকের লাভ। এই লাভ দিয়ে ব্যাংক তার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করে। যখন ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দেয়, ঋণ দেয়ার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়, তখন তার পক্ষে কার্যনির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে।

ব্যাংকের তারল্য সংকটে দেশেরও অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অর্থের প্রধান উৎস ব্যাংক। শিল্পস্থাপন কিংবা ব্যবসাবিকাশে ব্যাংকঋণের বিকল্প নেই। কিন্তু তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হয়ে ঋণ নিতে তখনই রাজি হবে, যখন বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজ করবে এবং তা তাদের কাক্সিক্ষত লাভের ভাগীদার করবে। শিল্প-ব্যবসায়ে বিনিয়োগ দেশের জন্য অপরিহার্য। কারণ, তা পণ্যের নিশ্চয়তা দেয়, রফতানি বাড়ায় এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। ‘বিনিয়োগ ও রফতানি করো, না হয় ধ্বংস হয়ে যাও,’ এমন একটি প্রবাদও চালু আছে। এ প্রবাদের মর্মকথা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। একটি দেশের বস্তুগত ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে হলে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতেই হবে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ সেটাই করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে না। করোনাকালের আগে সৃষ্ট বিনিয়োগ বাধা দূর করার তাকিদ বহুবার বহু উপলক্ষে উচ্চারিত হলেও তেমন একটা ফল পাওয়া যায়নি। বরং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ্যাত্ব লক্ষ্য ও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। দেশি বিনিয়োগের মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগে ধস নেমেছে। আর বিদেশি বিনিয়োগ দিনকে দিন কমেছে। করোনার প্রাদুর্ভাবে এই পরিস্থিতির অবিশ্বাস্য অবনতি ঘটেছে। করোনাকারণে সবদেশের অর্থনীতিই ব্যহত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি পড়েছে গত শতকের ৩০-এর দশকের মহামন্দার চেয়েও কঠিন মন্দায়। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এই কঠিন মন্দা উত্তরণের উপায়, যে কোনো মূল্যে বিনিয়োগ বাড়ানো ও ব্যবসার প্রসার ঘটানো। বস্তুত এই তাকিদ থেকেই বিশ্বের দেশে দেশে করোনার মধ্যেও ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন করে শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে দেয়ার ফল শুভ হয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এর ওপর কালো ছায়া বিস্তার করেছে।

করোনা কোনো একক দেশের সমস্যা নয়। এটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এমন এক সমস্যা যার শিকার অতীত মানব জাতি কমই হয়েছে। অতিমারি বা মহামারি অতীতে বহু দেখা গেছে। অসংখ্য মানুষ তাতে আক্রান্ত ও মারা গেছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এত কম সময়ে কোনো মহামারি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েনি এবং এত মানুষের জীবন কেড়ে নেয়নি। করোনার ধরন ও প্রকৃতি এর মধ্যে এতবার পরিবর্তিত হয়েছে, যে অন্য কোনো ভাইরাসের ক্ষেত্রে সেটা দেখা যায়নি। আমাদের দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতিতে আফ্রিকান ভেরিয়েন্ট নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কবে এই নাজুক পরিস্থিতির সহজে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে, কেউ তা বলতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বড় রকমের বিপর্যয় আসন্ন। ফের সবকিছু স্থবির এবং শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়ন কার্যাবলী বন্ধ হওয়ার বা অতি সীমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, কী করণীয় তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, এ মুহূর্তে করোনাসংক্রমণ ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউন ও স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি অনুসরণ এবং টেস্ট ও চিকিৎসাসুবিধা সম্প্রসারণ জরুরি। টিকাদান কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। অতঃপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো, অর্থনৈতিক কার্যক্রম, উৎপাদন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কাজ সচল রাখতে সচেষ্ট হওয়া বা থাকা। যে কোনো ফলপ্রসূ বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। বিনিয়োগে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের যেমন তৎপর হতে হবে, তেমনি ব্যাংকগুলোকেও বিনিয়োগ-সহযোগীর ভূমিকায় জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমবে, ব্যাংক বাঁচবে। একই সঙ্গে দেশ ও দেশের মানুষ উপকৃত হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন