ড. এম এ সবুর
কুরবানির ঈদ মুসলিম সমাজের ত্যাগের উৎসব। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম সমাজের ত্যাগের পরাকাষ্ঠা পরিলক্ষিত হয় কুরবানি ঈদে। ভোগের উৎসব সবাই করেন কিন্তু ত্যাগের উৎসব শুধু সাধুজনই পারেন। নিজের উপার্জিত অর্থ ত্যাগ করে আনন্দ উৎসব করার দৃষ্টান্ত বিরল। ত্যাগের উৎসব শুধু মুসলিম সমাজেই বিদ্যমান। ‘ভোগে নয়, ত্যাগেই শান্তি’ এ কথার যথার্থতা পাওয়া যায় কুরবানির ঈদে। সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মুসলিমের কুরবানির বিধান ইসলামে আছে। প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর শাররীক কুরবানির জন্য নামাজ, রোজা ও অন্যান্য ইবাদত অপরিহার্য। আর বিত্তশালী মুসলিমের জন্য অন্যান্য ইবাদতের সাথে কুরবানিও অপরিহার্য। এ কুরবানি করা হয় পশু জবেহের মাধ্যমে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্মৃতি ধারণ করার জন্য আল্লাহ তায়ালা উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপর পশু কুরবানি অপরিহার্য করেছেন। তাই মুুসলিমরা প্রতি বছর এ কুরবানি করে থাকেন। তারা এ ত্যাগের জন্য ব্যথিত নন বরং আনন্দ উৎসব করেন। আর ত্যাগের এ উৎসবের নাম কুরবানির ঈদ।
মুসলিম সমাজের পশু কুরবানির ঐতিহ্য অনেক পুরনো। জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.) পশু কুরবানির প্রতিষ্ঠাতা। উম্মাতে মুহাম্মাদীরা ইব্রাহিম (আ.)-এর উত্তরসূরি হিসেবে পশু কুরবানি করে থাকেন। পশু কুরবানির এক লোমহর্ষক ইতিহাস আছে। আল-কুরআনের সূরা সফ্ফাতে বিবৃত ঘটনা থেকে জানা যায় আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিন স্বপ্নের মাধ্যমে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তাঁর প্রিয় বস্তু কুরবানির করার নির্দেশ দেন। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠে হযরত ইব্রাহিম মেষ পালের সবচেয়ে মোটাতাজা মেষটি আল্লাহর রাহে কুরবানি করেন। পরের রাতে আবারও একই স্বপ্ন দেখেন। পরদিন তিনি তাঁর সব মেষ কুরবানি করেন। এতেও কোন ফল হয় না। আবারো প্রিয়বস্তু কুরাবানির জন্য স্বপ্নে আদিষ্ট হলেন ইব্রাহিম। এবার তাঁর বুঝতে বাকি থাকলো না যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল। তাই তিনি সকালে ঘুম থেকে উঠে সুযোগ বুঝে পুত্র ইসমাইলকে ডেকে স্বপ্নের কথা জানালেন। এতে ইসমাইল অত্যন্ত সাহসের সাথে দৃঢ়ভাবে পিতার প্রস্তাবে সায় দিলেন। বললেন, এতো আমার সৌভাগ্য। আল্লাহর জন্য কুরবানি হওয়ার সুযোগ কয় জনের হয়! সুতরাং আল্লাহর আদেশ পালন করুন নির্দ্ধিধায়।
পুত্রপ্রেম কত যে গভীর পিতা মাত্রই জানেন। পুত্রের সুখের জন্য পিতার প্রাণান্ত কষ্ট সবারই জানা। পুত্রের সুখের জন্য এমন কষ্ট নাই যা পিতা করেন না। নিজের জীবন দিয়ে পুত্রের জীবন রক্ষার ঘটনা কম নয়। পুত্র হুমায়ুনের জীবন বাঁচাতে মোঘল সম্রাট বাবরের জীবন বিনিময়ের ইতিহাস অনেকেরই জানা। অসুস্থ পুত্রের জন্য নির্ঘুম রাত অতিবাহিত করেন নাই এমন পিতার সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে না। প্রাণাধিক পুত্র কুরবানির দুঃসাহস কারো হবে না। কীভাবে নিজ হাতে পুত্রকে কুরবানি করবেন ভাবছেন ইব্রাহিম। তাঁর চোখের জল ছল ছল করছে। তবু আল্লাহর নির্দেশ! পালন তাঁকে করতেই হবে। তাই নির্দিষ্ট সময়ে পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করতে সাথে নিলেন তিনি। পিতার করুণ অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় ইসমাইল। তবু আল্লাহর নির্দেশ! অন্যথা করা যাবে না। যেমন পিতা তেমন পুত্র! পিতার মনে দয়ার উদ্রেক হওয়ার আশংকায় ইসমাইল পিতা ইব্রাহিমের চোখ বেঁেধ দেয় আর নিজেকে সপিয়ে দেয় পিতার ধারালো ছুরির তলায়। হায়রে প্রভু প্রেম! আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। জগৎ স্তব্ধ হয়। আকাশে বাতাসে করুণ সুর ধ্বনিত হয়। সাগরের গর্জন বন্ধ হয়ে যায়। থেমে যায় মহাকাশের গতি। ইব্রাহিম পুত্রের গলায় সজোরে ছুরি চালান। ধারালো সে ছুরির আঘাতে পাথর কাটে অথচ ইসমাইলের পশম কাটে না। অস্থির হন ইব্রাহিম। প্রভু প্রেমের কমতি আশংকায় আবারো তিনি অধিক শক্তি ব্যয়ে ছুরি চালান পুত্রের গলায়। এবারো আগের মতোই অবস্থা, ইসমাইলের কোনো পশম কাটে না।
আকাশ থেকে বাণী ভেসে আসে থামো! ইব্রাহিম থামো! প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তুমি। এবার ইব্রাহিম চোখ খুলে পাশেই দেখতে পেলেন এক দুম্বা। পরে আল্লাহর নির্দেশে সে দুম্বাকেই কুরবানি করেন তিনি। সেই থেকে পশু কুরবানি শুরু। আল্লাহর রাহে নিজের প্রিয় বস্তু উৎসর্গের প্রতীক হিসেবে পশু কুরবানি করা হয়। তবে আল্লাহর নিকট পশুর রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছে না। তাঁর নিকট পৌঁছে মানুষের তাকওয়া বা প্রভুভক্তি। আল-কুরআনের ভাষায়, “আল্লাহর নিকট উহার (কুরবানিকৃত পশু) রক্ত-মাংস কিছুই পৌঁছে না বরং তাঁর (আল্লাহর) নিকট পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া” (সূরা হজ্জ: ৩৭)। পশুর রক্ত-মাংস আল্লাহর কোন প্রয়োজনও হয় না। এজন্য পশুর আকৃতি, রং, মূল্য এসব আল্ল¬াহর কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়, শুধু অন্তরের তাকওয়া তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। লোক দেখানো কুরবানি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আল্লাহর ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী কে কত ত্যাগ করে কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা তা পরীক্ষা করেন। তবে বিত্তশালী মানুষের বড় পশু কুরবানি করাই শ্রেয়। এতে তার ত্যাগের পরিমাণ বেশি হয়।
ইসলামী বিধানে ধনী ব্যক্তির জন্য কুরবানির মাংস খাওয়ার অনুমতি থাকলেও তা দুস্থ, দরিদ্র-অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেয়াই ভালো। অত্যধিক মূল্যের কারণে আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষেরা মাংস কিনে খেতে পারে না। মাংস খাওয়ার জন্য তারা কুরবানি ঈদের অপেক্ষা করে। তাই কুরবানির মাংস গরিব-দরিদ্রদের দান করলে তারা মাংস খাওয়ার সুযোগ পায় এবং তাদের প্রতি ধনীদের সহানুভূতিও বৃদ্ধি পায়। কুরবানি পশুর মাংস দরিদ্র-নিঃস্বদের বিতরণ না করে ফ্রিজে ভর্তি করে রাখলে কুরবানির যথার্থতা লাভ করা যায় না। স্বার্থ ত্যাগ করতে না পারলে পশু কুরবানির সফলতা পাওয়া যায় না। শুধু পশু জবেহ করলেই কুরবানি হয় না। বনের পশু জবেহের আগে মনের পশু জবেহ করা দরকার। অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত থাকার পাশবিক মানসিকতা জবেহ করতে না পারলে পশু জবেহ নিরর্থক হয়। কুরবানির মাধ্যমে মানুষের ষড়রিপুর পাশবিক শক্তির বিনাশ করে মানবিক শক্তির বিকাশ সাধন করা হয়। কুরবানির মূল উদ্দেশ্য সর্বাধিক প্রিয়বস্তু ত্যাগের মাধ্যমে আল্ল¬াহর সন্তুষ্টি অর্জন। মনের মধ্যে লুকায়িত হিংসা-বিদ্বেষ এবং সকল প্রকার অসৎ-পাপ চিন্তা নির্মূল করার মাধ্যমে কুরবানির উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়। এ উদ্দেশ্য সাধনে পশু কুরবানি উপলক্ষ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে পশু কুরবানির মধ্যে লুকিয়ে আছে আল্লাহর প্রতি আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও আনুগত্য।
লেখক: আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন গভর্নমেন্ট টিচার্স
ফসধংড়নঁৎ০৯@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন