বাংলাদেশেও লকডাউন, আর নরওয়েতেও লকডাউন। কত আকাশ পাতাল তফাৎ। বাংলাদেশের লকডাউন তো আপনারা এই কয়দিন দেখলেন। অফিস-আদালত চলছে, শিল্প-কারখানা চলছে। শুধুমাত্র দোকানপাট আর বাস সার্ভিস বন্ধ ছিল। বাস মালিক আর শ্রমিকদের চাপে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাস সার্ভিস চালু করা হয়। বাকী থাকলো দোকানপাট। সেগুলোও দোকান মালিক এবং কর্মচারীদের চাপে সাময়িকভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া রাস্তায় প্রাইভেট কার, সিএনজি এবং রিক্সার ভিড়ে নিত্যদিনের মতই যানজট চলছে।
এর পাশে নরওয়ের লকডাউন তো পরের কথা, স্বাস্থ্যবিধি কেমন কঠোরভাবে পালন করা হয় সেটা দেখুন। করোনাভাইরাসের কারণে জারিকৃত বিধিনিষিধের কারণে নিজের ৬০তম জন্ম বার্ষিকী পালন করছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী অর্না সোলবার্গ। তিনি একটি পাহাড়ি রিসোর্টে জন্মদিন উপলক্ষে একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সরকারি বিধিনিষেধে বলা হয়েছে যে, এ ধরনের অনুষ্ঠানে ১০ জনের বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গের ঐ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন ১৩ ব্যক্তি। অর্থাৎ বিধিনিষেধের চেয়ে অতিরিক্ত ছিলেন ৩ ব্যক্তি। সরকারি বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে অতিরিক্ত ৩ ব্যক্তি অংশ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্ষমাও চান। তারপরেও বিধিনিষেধ ভঙ্গের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পুলিশ জরিমানা করেছে। জরিমানার পরিমাণ ২০ হাজার নরওয়েজিয়ান ক্রোন। ১ নরওয়েজিয়ান ক্রোন সমান বাংলাদেশি ১০ টাকা। নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী আর্না সোলবার্গকে জরিমানা করা হয়েছে ২০ হাজার ক্রোন। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ২ লক্ষ টাকা। প্রিয় পাঠক, চিন্তা করুন, নরওয়ের পুলিশ আর বাংলাদেশি পুলিশের। আরও চিন্তা করুন, নরওয়ে সরকার আর বাংলাদেশ সরকারের কথা। আমাদের সংবিধানে লেখা আছে, বাংলাদেশে চলবে আইনের শাসন। আমাদের আইনের শাসন হলো কাজীর গরু। এটি কেতাবে আছে, গোয়ালে নাই। আর তাদের আইনের শাসন? ওপরের উদাহরণ থেকে দেখুন, আইনের শাসন কাকে বলে, কত প্রকার এবং কী কী।
দুই
এই এপ্রিল মাসেরই ৮ তারিখে সংক্রমণ হয়েছে ৭ হাজার ৬২৬ এবং ১০ তারিখে মৃত্যু ৭৭ জন। এটি বিগত ১৩ মাসে সর্বোচ্চ। কেন এমনটি হলো? এটি কি একদিনে হয়েছে? আকস্মিকভাবে হয়েছে? না, এর জন্য দায়ী করোনা ব্যবস্থাপনায় সীমাহীন শৈথিল্য। গত নভেম্বর ডিসেম্বরে যখন করোনা নিচের দিকে নামতে থাকে, তখন কর্তৃপক্ষ এবং জনগণ উভয়েই ধরে নেন যে, করোনার বুঝি অবসান হয়েছে। সরকারের একজন মন্ত্রী তো বলেই বসলেন যে, করোনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ফলে চতুর্দিকে বিয়ে শাদীর ধূম লেগে যায়। কক্সবাজার, বান্দরবান, কুয়াকাটা, সিলেট প্রভৃতি পর্যটন স্পটগুলোতে উপচে পড়ে ভিড়।
গত ২ এপ্রিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো। সেকি উপচে পড়া ভিড়। পরীক্ষার্থী দেড় লাখ, তো তাদের গার্জিয়ান দুই লাখ। এই সাড়ে তিন লাখ লোক থুকবুক করেছে। সেই বিশাল জনস্রোত থেকে কতজনের মাঝে করোনা সংক্রমিত হয়েছে, সেটা কে জানে? ঐ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা কি না নিলেই চলত না? এর মধ্যে আবার বিসিএস পরীক্ষাও নেওয়া হলো। মেডিক্যাল এবং বিসিএস কি স্থগিত রাখা যেত না? রাখলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হতো? যে দেশে করোনার কারণে বিশেষ শ্রেণির ছাত্রদেরকে অটো প্রমোশন দেওয়া যায় সেই দেশে সাময়িকভাবে মেডিক্যাল বা বিসিএস পরীক্ষা স্থগিত রাখা যায় না কেন?
অক্টোবর নভেম্বর থেকে শুরু করে জানুয়ারি মাসে দেশে এমন কান্ড কারখানা শুরু হলো যে মনে হলো, এদেশে করোনা যেন কোনো দিন ভিজিট করেনি। মাস্ক পরার বালাই নাই, হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করার গরজ নাই, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বের কোনো খবর নাই। জনগণ ফ্রি ফর অল। আর সরকারও অন্য সব পলিটিক্যাল এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত। এর মাঝে হামাগড়ি দিয়ে কখন যে করোনা এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে গেছে সেটি কেউ খেয়াল করেনি। যখন দেখা গেল, সংক্রমণের সংখ্যা ৩০০ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, তখন মনে হলো, কর্তৃপক্ষের হুঁশ ফিরেছে। যখন হুঁশ ফিরলো তখন গত ২৯ মার্চ সোমবার। তারা একটি ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করলেন। বিশেষজ্ঞরা এই ১৮ দফা দেখে বললেন, অনেক দেরী হয়ে গেছে। তারপরেও যে ১৮ দফা পরিপত্র জারি করা হয়েছে, সেটি সুনির্দিষ্ট নয় এবং অস্পষ্টতায় ভরা।
তিন
এই ১৮ দফা সরকারি ফরমান দেখে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ব বিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সাইদুর রহমান বলেন, ‘অনেক দেরী হয়ে গেছে। এখন আর এসব ফরমান জারি নয়। যেভাবে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা উল্লম্ফন গতিতে বাড়ছে, সেটি প্রতিহত করতে এখন কারফিউ দিতে হবে। যেসব জায়গায় করোনা রোগীর সংখ্যা বেশি, সেসব জায়গাকে দেশের অবশিষ্ট অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত ঐ ১৮ দফা গেজেট নোটিফিকেশনে বলা হয়, জনসমাবেশ সীমিত করতে হবে। কিন্তু এই সীমিত মানে কী? কতজন হলে সীমার বাইরে যাবে? সংক্রমণ রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর রোদওয়ানুর রহমান বলেন, সরকারের এই ১৮ দফায় বিজ্ঞান অনুপস্থিত। তিনি বলেন, সরকার জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, বইমেলা এবং কক্সবাজার-বান্দরবানের মতো পর্যটন স্পটগুলো খোলা রেখে ১৮ দফা নির্দেশনা কোন কাজে আসবে? তিনি ঢাকা চট্টগ্রামসহ কোভিডের হটস্পটগুলিতে অবিলম্বে সর্বাত্মক লকডাউনের সুপারিশ করেন। এসব সুপারিশ আজ থেকে ১৩ দিন আগে অর্থাৎ ৩১ মার্চ সরকারকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি।
কাকে দোষ দেবেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর নাকি সরকারকে? গত ৪ এপ্রিল পত্রিকান্তরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক মুজাহেরুল হক একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান যে, গত বছর চীনা বিশেষজ্ঞরা এসে কিছু সুপারিশ করেছিলেন। সেইসব সুপারিশ এখনো ফাইল বন্দি আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন মহাপরিচালক সেটি পড়েও দেখেননি। তাঁকে এ সম্পর্কে কেউ জানায়ওনি।
আজকের এই লেখাটি করোনা ভাইরাসের ওপর। স্বভাবতই অত্যন্ত সিরিয়াস বিষয়। বিষয়টিকে হাল্কা করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেভাবে একের পর এক ভুল করে যাচ্ছে সেগুলো দেখে গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা হেমন্ত মুখার্জীর সুর দেওয়া সুজাতা চক্রবর্তীর গাওয়া সেই গানটির কথা মনে পড়লো:
ভুল সবই ভুল
এই জীবনের পাতায় পাতায়
যা লেখা সে ভুল
ভুল সবই ভুল।
সরকার প্রথমে ১৮ দফা দিল। কেউ সেগুলো মানলো না। আর কর্তৃপক্ষও সেগুলো মানাবার আন্তরিক চেষ্টাও করলো না। আমি গতবারের কথা তুলছি না। এবারের কথা বলছি। প্রথম ভুল হলো সবকিছু ওপেন করে দেওয়া। তারপর হলো বোধদয়। কিন্তু বিলম্বিত বোধদয়। ১৮ দফা ছিল পরবর্তী ভুল। তখন উচিৎ ছিল সর্বাত্মক এবং কঠোর লকডাউন। অবশেষে সেই লকডাউন হলো। কিন্তু কেমন লকডাউন? ‘দৈনিক ইনকিলাব’ এই লকডাউন সম্পর্কে গত ৭ এপ্রিল বুধবার প্রথম পাতায় প্রধান সংবাদ করেছে এবং বড় বড় হরফে লাল কালি দিয়ে শিরোনাম দিয়েছে, ‘তামাশার লকডাউন’। সঠিক শিরোনাম। লকডাউন যখন ঘোষণাই করা হলো, তখন মানুষজনকে গ্রামের বাড়ি বা দেশের বাড়িতে যেতে দেওয়া হলো কেন? দুই দিন ধরে দেখা গেল, দেশের বাড়িতে যাওয়ার জন্য লঞ্চ, স্টিমার, ট্রেন এবং বাসে সেকি উপচে পড়া ভিড়। টুকরীতে করে ফেরিওয়ালারা ফার্মের মুরগী নিয়ে অলিগলিতে ফেরি করে বেড়ায়, তেমনি গণ পরিবহনে দেখা গেল দু’দিন ধরে গাদাগাদি আর ঠাসাঠাসি। করোনার বংশ বিস্তারের সেকি সুবর্ণ সুযোগ! একই কান্ড ঘটেছে গত বছর। একবার দুবার নয়, তিন তিন বার। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খুলে দেওয়া হয়, আবার বন্ধ করা হয়। খোলা বন্ধের সেকি খেলা!
অবশেষে ৭ দিনের যে লকডাউন এলো সেটি ছিল অভিনব। ডেইলি স্টারে বলা হয়েছে, খড়পশফড়হি না ঈযধড়ং? অর্থাৎ লকডাউন না অরাজকতা? সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের অনুজীব বিজ্ঞানী ড. বিজন কুমার শীল বলেছেন, গত বছরের ভাইরাসের তুলনায় এ বছরের ভাইরাস অনেক বেশি শক্তিশালী। মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন স্ট্রেইন বা রূপ ধারণের পারঙ্গমতা এবারের ভাইরাসের অনেক বেশি।
চার
গত ৬ জানুয়ারি সনাক্ত হয়েছে বৃটিশ ভ্যারিয়েন্ট বা
স্ট্রেইন। তরপর শনাক্ত হয়েছে সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর এবং সিলেট ওসমানী আন্তার্জাতিক বিমানবন্দরে ঐসব দেশ থেকে আগত যেসব যাত্রীর করোনা পজিটিভ হয়েছে তাদের ভাইরাসের জেনম সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে। তখনই ধরা পড়েছে বৃটিশ বা দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ধরনের করোনা। আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, যাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্তত ৮ জন টিকা নেওয়ার একমাস পর আক্রান্ত হয়েছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না হয়েছে টিকা নেওয়ার ৩১ দিন পর। আমার আপন ছোট বোন টিকা নেওয়ার ২৮ দিন পর। ভাস্তি এবং জামাই টিকা নেওয়ার ৩৩ দিন পর। বেয়াই এবং তার ডাক্তার মেয়ে টিকা নেওয়ার ৪৫ দিন পর। আমার মেয়ে জামাই টিকা নেওয়ার ১ মাস ২৩ দিন পর সংক্রমিত হয়েছে। আর কত উদাহরণ দেব? তবে আশার কথা হলো এই যে, এরা সকলেই সুস্থ হয়ে উঠেছেন বা সুস্থ হওয়ার পথে। তাদের সুস্থ হওয়ার কারণ অবশ্যই মহান আল্লাহতায়ালা। তাঁর উছিলায় করোনার টিকা নেওয়া।
পাঁচ
কিন্তু সেই টিকার সরবরাহেও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসের কোটা ৫০ লাখ ডোজের মধ্যে এসেছে মাত্র ২০ লাখ ডোজ। সেখানে পাওনা রয়েছে ৩০ লাখ ডোজ। মার্চ মাসে কোনো ডোজ আসে নাই। সেখানে পাওনা রয়েছে ৫০ লাখ। মোট পাওনা ৮০ লাখ ডোজ। এপ্রিলের আজ ১৩ তারিখ। এপ্রিলের হিসাব পাওনার মধ্যে আনিনি। এপ্রিলের হিসাব ধরলে পাওনা হয় ১ কোটি ৩০ লাখ ডোজ। ভারতে এখন দৈনিক গড় সংক্রমণ দেড় লক্ষ মানুষ। সেরাম বলছে, আগে তারা ভারতের চাহিদা মেটাবে। তারপর অন্যদের কথা চিন্তা করবে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, Do not put all your eggs in one basket. তোমার সমস্ত ডিম একটি ঝুড়িতে রেখো না। শুধু ভারত থেকেই কিনতে হবে কেন? চীনের ‘সিনোভ্যাক’, ‘সিনোফার্ম’, ‘রাশিয়ার স্পুটনিক-৫’ ক্রয়ের আলাপ আলোচনা এখনই শুরু করা উচিৎ। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের বিশেষ দূত জন কেরি বলেছেন, আমেরিকা বাংলাদেশকে টিকা দিতে প্রস্তুত। তাদের ‘জনসন অ্যান্ড জনসন’ সিঙ্গল ডোজের টিকা। এটা নাকি কারোনাতেও কার্যকর। কাল বিলম্ব না করে তাদের সাথেও আলাপ আলোচনা শুরু করা উচিত।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন