করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ মোকাবিলায় সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধে ৪৯ শতাংশ নারীই নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না। কোভিডকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে ঘরে এবং বাইরে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এমন সংকট তৈরি হয়েছে। গতকাল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘সরকারের আর্থ-সামাজিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা : নারীরা কতটা উপকৃত হয়েছে’ শীর্ষক আয়োজিত ওয়েবিনারে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন তার প্রবন্ধে এসব তথ্য উপস্থাপনা করেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সিপিডির ফেলো প্রফেসর ড. রওনক জাহান ওয়েবিনার সংলাপটি পরিচালনা করেন। সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদ, পারসোনার সিইও কানিজ আলমাস ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রমুখ।
ফাহমিদা খাতুন তার উপস্থাপনায় বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে ৪৯ শতাংশ নারী ও বালিকা বলছে লকডাউন পরিস্থিতিতে তারা নিজেকে নিরাপদ মনে করেন না। কারণ কোভিড পরবর্তী সময়ে ধর্ষণ ও অভ্যন্তরীণ নারী নির্যাতন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক নারী ও বালিকা পর্যায়ে ভায়োলেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদন তুলে ধরার সময় ফাহমিদা বলেন, করোনা মহামারি গরীব এবং নি¤œ আয়ের নারীদের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নারীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ নারী লকডাউনকে অনিরাপদ মনে করেন। বাল্যবিবাহ বেড়েছে ৫৮ শতাংশ এবং অকালে গর্ভধারণ বেড়েছে ৩০ শতাংশ। গ্রামের মাত্র ২ শতাংশ শিশু অনলাইনে শিক্ষা প্রোগ্রাম দেখেছে।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে ৫৪ শতাংশ গৃহকর্মী কাজ হারিয়েছেন। এ সময় গার্মেন্টসের ১৯ শতাংশ নারীকর্মী চাকরি হারিয়েছেন। ফাহমিদা বলেন, সরকার ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যা জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এই প্রণোদনা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না।
৫৪ শতাংশ গৃহকর্মী এবং ১৯ শতাংশ গার্মেন্টসের ১৯ শতাংশ নারীকর্মীর কাজ হারানোর তথ্যের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, আপনাদের প্রতিবেদনের তথ্য আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। তিনি বলেন, আপনারা ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৪ শতাংশ গৃহকর্মী ও ১৯ শতাংশ গার্মেন্টসকর্মী কাজ হারিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এরপর ৫-৬ মাস চলে গেছে। আমার ধারণা এ সময়ে অনেক রিকভারি হয়েছে। এই পরিমাণ নারী কাজ হারিয়েছে এটা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে আমি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সঙ্গে বসব। পরিকল্পনামন্ত্রী প্রশ্ন তোলার পর প্রফেসর ড. রওনক জাহান বলেন, বেশিরভাগ গৃহকর্মী চাকরি হারানোর কারণ বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে লকডাউনে আছে এবং অনেকে ভয় পাচ্ছেন এদের (গৃহকর্মী) কারণে কোভিড বাড়িতে ঢুকে যাবে। গৃহকর্মীদের প্রটেকশন আমরা দিতে পারছি না। কারণ তারা পাঁচটা বাড়িতে কাজ করছে। এরা সব থেকে প্রান্তিক। এদের বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের একটা দায়িত্ব আছে।
কানিজ আলমাস বলেন, আমাদেরকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সেটা যেন টিকে থাকে, সেজন্য সরকারের সহযোগিতা চাই। অনেক পার্লার বন্ধ হয়ে গেছে। পুনরায় চালু করার জন্য ঋণ নিচ্ছেন না অনেক পার্লার মালিক। কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন, ব্যবসা চালু হবে কি না। অন্যদিকে ঋণ নিতে যে বিভিন্ন কাগজপত্রের নামে ব্যাংকগুলো থেকে চাহিদাপত্র থাকে, তা কাটিয়ে অনেকেই ঋণ নিতে আগ্রহী নন।
তিনি বলেন, আমি নিজে এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে আমাদের অনেকক্ষুদ্র পার্লার ব্যবসায়ীকে সরকারের প্রণোদনা হিসেবে ঋণের বিষয়টি বলেছি। অধিকাংশ আমাকে বলেন, শুধু চার শতাংশ কেন, বিনা সুদে হলেও ঋণ নেবেন না। তারা ঋণ চান না, প্রকৃত অর্থে প্রণোদনা চান।ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা আছেন, তাদের প্রনোদনা দিলে ব্যবসা চালু করতে পারবেন।
পার্লার ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে কানিজ আলমাস আগামী তিন বছরের ভ্যাট ও কর মওকুফ করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ন্যুনতম বাসা ভাড়া দিয়ে হলেও অনেকে পার্লার ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু ভ্যাট ও কর দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করা অনেকেরই সম্ভব হবে না। এছাড়া ১৫ শতাংশ ভ্যাট এর বিষয়েও নতুন করে বিবেচনা করার প্রয়োজন আছে।
কানিজ আলমাসের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাংলাদেশে ৭৮ ভাগ নারী ইনফরমাল অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি দেশের জন্য ভালো সংবাদ। তিনি (কানিজ আলমাস) কিছু দাবি করেছেন। ভ্যাট ও কর মওকুফের বিষয়টি আমি সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করব।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক লীলা রশীদ নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয়ার বিষয়ে বলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে প্রণোদনার মধ্যে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ন্যুনতম বরাদ্দ ছিল পাঁচ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ৭২ শতাংশ ঋণ ছাড় করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ দশমিক ১০ শতাংশ নারীদের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ৬২ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো দিয়েছে। বাকি ২৮ শতাংশ দিয়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলো। এখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ঠিক করে ঋণ দিয়েছে। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো সরকারের উদ্দেশ্য পূরণে নারী উদ্যোক্তা মূলত ঋণ দিয়েছে।
তিনি বলেন, কাগজে কলমে নারী উদ্যোক্তা হলেও প্রতিষ্ঠান চালান পুরুষ উদ্যোক্তা। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী বা মার নামে প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। আসলে মূলত নারী উদ্যোক্তাদের সুবিধা নেয়ার জন্য কাগজে-কলমে রাখা হয়েছে। সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের নারী প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া, ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেন ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন