মাহে রমজানের মহাপূণ্যময় কদর রজনীতে আল্লাহপাক পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন। কোরআনের প্রতি আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে বিশুদ্ধভাবে এর তেলাওয়াত করা। কোরআন হচ্ছে মুমিনের সংবিধান, জীবন পরিচালনার গাইডলাইন। গতকাল রমজানের প্রথম জুমার খুৎবাপূর্বে বিভিন্ন মসজিদের পেশ ইমাম খতিবরা এসব কথা বলেন। কঠোর লকডাউনের মাঝে অধিকাংশ মসজিদে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে প্রচুর মুসল্লি জুমার নামাজে অংশ নেন। মসজিদে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেকে রাস্তার ওপর জুমার নামাজ আদায় করেন। মহাখালিস্থ মসজিদে গাউছুল আজমে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে মুসল্লিরা জুমার নামাজ আদায় করেন। বিভিন্ন মসজিদে করোনা মহামারি থেকে মুক্তি, দেশ জাতির উন্নতি এবং মুসলিম উম্মার সুখ সমৃদ্ধি শান্তি কামনা করে দোয়া করেন পেশ ইমামরা।
ঢাকা বাংলা মটরস্থ বাইতুল মোবারক জামে মসজিদের খতিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামকি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আল্লামা ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ গতকাল জুমার খুৎবাপূর্বে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, মহিমান্বিত রমজান মাসের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম প্রধান কারণ এ মাসে মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। যা মানব জাতিকে সৎপথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরাশদ করেন, রমজান মাসে নাজিল করা হয়েছে আল-কোরআন যা মানুষের দিশারী এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। (সূরা বাকারা, আয়াত নং ১৮৫)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই আমি একে (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদর রজনিতে। (সূরা কদর, আয়াত নং ১)। খতিব বলেন, পবিত্র কোরআন হচ্ছে মুমিনের সংবিধান, জীবন পরিচালনার গাইডলাইন। কোরআনে মহান আল্লাহ মানব জাতির জীবনকে সৎ ও সুন্দরের পথে পরিচালিত করতে নানা উপদেশ দিয়েছেন।
আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, আমি তো তোমাদের জন্য অবতীর্ণ করেছি কিতাব, যাতে আছে তোমাদের জন্য উপদেশ। তোমরা কি তা বুঝবে না? (সূরা আম্বিয়া, আয়াত নং-১০)। খতিব বলেন, কোরআনের প্রতি আমাদের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে বিশুদ্ধভাবে এর তেলাওয়াত করা। নবী করীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। আর প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, কোরআন কিয়ামতের দিন বলবে, হে আমার রব, আমার অধ্যয়নরত থাকায় রাতের ঘুম থেকে আমি তাকে বিরত রেখেছি। তাই তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপারিশ কবুল করো। তিনি (সা.) বলেন, অতপর উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে। (মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং-৬৬২৬)। কোরআন নির্দেশিত পথে জীবন যাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যেই রয়েছে পার্থিব জীবনের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং পরকালীন জীবনের মুক্তি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাজিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। (সূরা আরাফ, আয়াত নং-৩)।
কোরআন তেলাওয়াত আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। মহান আল্লাহ পবিত্র রমজানে আমাদেরকে অধিক পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করার তৌফিক দান করুন। আমীন!
বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেম গতকাল জুমার বয়ানে বলেন, কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে রোজা যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদরে পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা আত্মরক্ষা করতে পার (গুনাহ থেকে এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে)।
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, তোমাদের মধ্যে যে এ মাসে উপস্থিত হয় সে যেন মাসভর রোজা রাখে। (সূরা বাক্বারা ২:১৮৫)। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে যখন মাহে রমজানের আগমন হয় তখন জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। আর শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (সহীহ মুসলমি, হাদীস ১০৭৯)। পেশ ইমাম বলেন, নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করছেনে, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যততি আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলমি)। আল্লাহপাক আমাদেরকে রমজানের হক আদায় করার তৌফিক দান করুন। আমীন!
দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ খতিব মাওলানা রেজাউল করিম গতকাল জুমার বয়ানে বলেন, রমজানকে আল্লাহ তায়ালা এত সম্মানিত করেছেন কেন? কারণ রমজানে কোরআনুল কারীম অবতীর্ণ হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যার সম্পর্ক হয়েছে তাকেই কোরআনুল কারীম সম্মানিত করেছে। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, যারা কোরআন শিক্ষা করে এবং শিক্ষা দেয় তারাই শ্রেষ্ঠ। অনুরূপভাবে কোরআন শরীফ যে পড়বে এবং আমল করবে সেই শ্রেষ্ঠ হবে। সাহাবায়ে কেরাম সর্ব অবস্থায় কোরআনের তেলাওয়াতকে জরুরি মনে করতেন। আজ কোরআন ছেড়ে দেয়ার কারণেই আমাদের এই অধপতন। রমজানুল মোবারকে আমরা প্রত্যেকেই কোরআন যথারীতি তেলাওয়াত করব আর চারটি কাজ রোজা থেকে বেশি বেশি করব। দুইটি এমন যা করলে আল্লাহ খুশি হয়। অর্থাৎ কালেমার জিকির লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও ইস্তেগফার তথা তওবা বেশি বেশি পাঠ করা। আর ২ টি কাজ এমন যা আমাদের একান্ত ভাবে করা উচিত। তথা জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাতুল ফেরদৌস এর প্রার্থনা করা। আল্লাহপাক আমাদেরকে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমীন!
ঢাকার ডেমরার দারুননাজাত সিদ্দীকিয়া কামিল মাদরাসা জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব মাওলানা মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জুমার পূর্বে বলেন, রমজান মাস তাকওয়া অর্জনের মাস। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রতি রোজাকে ফরজ করেছেন আমাদেরকে মুত্তাকী তথা আল্লাহ ভীরু বানানোর জন্য। রমজান মাসে মানুষ যেমন আল্লাহর ভয়ে পানাহার থেকে বিরত থাকে তদ্রুপ সকল পাপ থেকেও তাকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যেভাবে রোজা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের ওপরও সে ভাবে রোজাকে ফরজ করা হয়েছে, যাতে করে তোমরা আল্লাহ ভীরু হতে পারো।
রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও পাপের কাজ পরিত্যাগ করতে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ করায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ আল্লাহ শুধু পানাহার ত্যাগ করাতে খুশি নন বরং তাকে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে রোজার মাসে মিথ্যা কথা, গীবত, চুরি-রাহাজানী, সুদ, ঘুষ, চোগলখুরী, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়া, মানুষের হক নষ্ট করা, মানুষকে হত্যা করা, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, বাজারে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা, সিন্ডিকেট করা, চড়া দামে মাল বিক্রি করা, মদ পান করা, নেশা দ্রব্য সেবন করা, ইত্যাদি পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা।
পেশ ইমাম বলেন, রমজান মাসে যে ব্যক্তি কর্মচারীর কাজের চাপ কমিয়ে দিবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রদান করবেন। গরিবদেরকে দান করা, সদকায়ে ফেতরা আদায় করা, মানুষকে ইফতার করানো, শেষ রাত্রে আল্লাহর কাছে ক্রন্দন করে ক্ষমা প্রার্থনা করা, ইফতারের পূর্ব মুহুর্তে দোয়া করা, ইতিকাফ করা, লাইলাতুল কদর তালাশ করার নিমিত্তে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে ইবাদত করা এ মাসের বিশেষ আমল।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বার আউলিয়ার চট্টগ্রামে পবিত্র মাহে রমজানের গতকাল শুক্রবার প্রথম জুমায় করোনা থেকে মুক্তি পেতে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পবিত্র জুমার নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। কোন কোন মসজিদে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে ভিড় এড়াতে একাধিক জামাত হয়। অনেক মসজিদের ছাদে, বারান্দায় এবং পাশের রাস্তা ও খোলা মাঠে মুসল্লিরা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ আদায় করেন।
রমজানের পবিত্র প্রথম জুমাকে ঘিরে নগরীতে ভিন্ন এক আবহের সৃষ্টি হয়। সকাল থেকে নগরবাসী মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। সরকারি ঘোষণা মেনে বাসায় সুন্নাত নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। জুমার খুতবায় ইমাম ও খতিবগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। সেই সাথে এই মহামারি থেকে নিজেদের সুরক্ষা এবং আপদ থেকে মুক্তি পেতে বেশি বেশি তাওবা, এস্তেগফার করার পরামর্শ দেন। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
জুমার নামাজ শেষে ইমাম, খতিবগণ মুসল্লিদের নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ মোনাজাতে মহামারি থেকে ফানাহ চান। এসময় অনেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। করোনায় যারা ইন্তেকাল করেছেন তাদের মাগফিরাত এবং যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করা হয়। নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ, লালদীঘি জামে মসজিদ, জমিয়াতুল ফালাহ, চন্দনপুরা জামে মসজিদ, মুরাদপুর মসজিদে বেলাল, বহদ্দারহাট জামে মসজিদ, হযরত আমানত শাহ দরগা মসজিদ, আগপাবাদ সিজিএস কলোনী জামে মসজিদসহ নগরীর সব মসজিদে বিপুল সংখ্যক মুসল্লির সমাগম হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন