‘কঠোর লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শ্রমিকদেরকে কারখানায় আনার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে, কিন্তু কারখানা মালিকরা অধিকাংশই পরিবহনের ব্যবস্থা করেননি। তবে শ্রমিকদের অধিকাংশকেই পায়ে হেঁটে নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে দেখা গেছে। এতে তাদের শারীরিক ও সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে না। ফলে তাদের আক্রান্তের হার বাড়তে পারে, এজন্য সরকারিভাবে করানো টেস্ট এবং একই সঙ্গে তাদেরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার দাবি জানান শ্রমিক নেতারা। গতকাল শনিবার সিপিডি এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস আয়োজিত ভার্চুয়াল এক আলোচনা সভায় শ্রমিক নেতারা এসব কথা বলেন। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও বিলসের মহাসচিব ও নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলাম খান সংলাপে সূচনা বক্তব্য রাখেন।
সৈয়দ মনজুর এলাহীর পরিচালনায় সভায় গবেষণা উপস্থাপন করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। মূল প্রতিবেদনে তিনি বলেন, এই সঙ্কট কালীন সময়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা এবং আলোচনার ফলে শ্রমিকদের এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের পক্ষে ঝুঁকি মোকাবেলা এবং সঙ্কট থেকে পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সীমিত সাফল্য নিশ্চিত হয়েছে। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদী নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের আগ্রহ নিশ্চিত করার বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা এবং একটি যৌথ বিবৃতি প্রয়োজন। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা নীতির উপর ভিত্তিকরে, ট্রেডইউনিয়ন গুলোতে শ্রমজীবী বয়সের লোকেরা, সামাজিকভাবে বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলো, একটি খাদ্য স্থানান্তর কর্মসূচী, এবং সাশ্রয়ী মূল্যের সামাজিক বিধানের আওতায় শ্রমিক এবং তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সহায়তা ব্যবস্থাগুলি চিহ্নিত করতে হবে। সরকার, নিয়োগকারী এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক শ্রম ও মানবাধিকার সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষর করতে একত্রে কাজ করা উচিত।
শ্রমিক নেতা আমিনুল হক আমিন বলেন, শিল্পের উন্নয়ন ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়নে সোশ্যাল ডায়লগের কথা বলা হয় কিন্তু সোশ্যাল ডায়লগ যখন হয় সেখানে সরকারি প্রতিনিধি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং মালিকপক্ষ থাকলেও শ্রমিক নেতাদের উপেক্ষা করা হয়। আবার কোনো কোনো অনুষ্ঠানের শ্রমিক নেতাদের ডাকা হলেও শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সেভাবে দেয়া হয় না। এমনটা হলে কীভাবে সোশ্যাল ডায়লগ অনুষ্ঠিত হয়? এটাকে কি ডায়লগ বলা হবে?
তিনি বলেন, গত বছর কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলি। শ্রমিকদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য সেখানে আমরা ন্যূনতম ৮ হাজাট টাকার সহায়তার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে দাবি জানাই, কিন্তু বিজিএমইএ থেকে সেখানে মাত্র তিন হাজার টাকা করে শ্রমিকদের জন্য সহায়তা চান। এখানে মালিক এবং শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দুই ধরনের সহায়তার কথা এসেছিল, তাহলে কীভাবে বেশি পাওয়া যাবে। সেখানে শ্রমিকদেরকে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। কারণ এ অর্থ আসছে সহায়তা হিসেবে। আমাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে জার্মান সরকার এবং বায়ারদের পক্ষ থেকে সহায়তা এসেছে শ্রমিকদের জন্য, কিন্তু শ্রমিকদের সহায়তার জন্য সেখানে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা হয় না। অথচ শ্রমিক প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এই অর্থসহায়তা আসলো, এটা দুঃখজনক।
শ্রমিকনেতা হামিদা হোসেন বলেন, কঠোর লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, শ্রমিকদেরকে কারখানায় আনার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করতে হবে, কিন্তু কারখানা মালিকরা অধিকাংশই পরিবহনের ব্যবস্থা করেননি। এতে শ্রমিকরা দূর-দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে কারখানামুখি হচ্ছেন। তাদের মধ্যে শারীরিক এবং সামাজিক দূরত্ব নেই, একসঙ্গে অনেকেই পায়ে হেঁটে আসছেন, এতে তাদের কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগহারে বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। সরকারের কাছে দাবি জানাই, প্রতিটি শ্রমিককে বিনামূল্যে করোনা টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা হোক। একই সঙ্গে শ্রমিকদেরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার দাবি জানাই।
শ্রমিক নেতা আহসান হাবীব বুলবুল বলেন, সরকার পাঁচ বছরের পরিকল্পনা করে, এসডিজি বাস্তবায়নে পরিকল্পনা করছে, কীভাবে এসডিজি গোল অর্জন হবে তা নিয়েও পরিকল্পনার শেষ নেই। কিন্তু অবাক করার বিষয়, এখানে কোনো শ্রমিক প্রতিনিধিকে রাখা হয় না। এখানে শ্রমিক প্রতিনিধি এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি রাখতে হবে, সবার কথা শুনতে হবে। একইভাবে মালিক-শ্রমিক উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেখানে যে সকল প্রোগ্রাম করা হয় সেখানে সরকারি প্রতিনিধি, মালিকপক্ষ থাকে, অথচ শ্রমিক প্রতিনিধিদের রাখা হচ্ছে না। তাহলে কীভাবে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক উন্নয়ন হবে।
শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমালোচনা করে বলেন, আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধ না। একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন হয় অথচ আমরা কথা বলতে পারি না, আমাদের দাবির পক্ষে একমত হতে পারি না। এজন্য আমরা সব জায়গায় উপেক্ষিত হই। মালিক-শ্রমিক উন্নয়ন এবং দেশের শিল্পের উন্নয়নের জন্য আমাদের সব শ্রমিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সব ফেডারেশনকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।
শ্রমসচিব কে এম আব্দুস সালাম বলেন, করোনা পরিস্থিতি শুধু আমাদের দেশের একার না, এটা একটা বৈশ্বিক মহামারি পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী অনেক দক্ষতার সঙ্গে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, যা বিশ্বে সমাদৃত। আমরা প্রতিটি আলোচনায় কারখানা মালিক এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একসঙ্গে বসে প্রতিটা শ্রমিক প্রতিনিধিকে আমরা রাখতে চেষ্টা করি এবং রাখি। এরপরও যদি আমাদের বলা হয় শ্রমিক প্রতিনিধিরা প্রোগ্রামগুলোতে উপেক্ষিত হন তাহলে কষ্ট লাগে। এখন আমরা যখন এখানে আলোচনায় অংশ নিচ্ছি ঠিক একই সময়ে খুলনাতে ৩০০ শ্রমিকের মাঝে রিলিফ দেয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন