করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে চলমান লকডাউনের (বিধিনিষেধের) মেয়াদ একই শর্তে আগামী ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু এবং শনাক্ত রোগীর সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতে দেশে চলমান বিধিনিষেধ আরও এক সপ্তাহ বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভা শেষে সচিবালয়ে তথ্য অধিদফতরে নিজ দফতরে প্রধান তথ্য অফিসার সুরথ কুমার সরকার সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
এদিকে, চলমান লকডাউনের ষষ্ঠদিন ছিল গতকাল সোমবার। আগের দিনের মতো গতকালও সবকিছু ছিল ঢিলেঢালা। সড়কে যান চলাচল আগের দিনের তুলনায় ছিল বেশি। মহাসড়কেও যান চলাচল ছিল তুলনামুলক বেশি। সড়কে পুলিশের চেকপোস্ট থাকলেও পুলিশ ছিল না। সে কারণে রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন অবাধে চলাচল করতে দেখা গেছে। সড়ক-মহাসড়কে লকডাউনের কিছুটা চিত্র লক্ষ্য করা গেলেও নগরীর পাড়া মহল্লায় লকডাউনের কোনো চিহ্নই এখন আর নেই। সকাল থেকে সব ধরনের দোকানপাট খোলা থাকছে বাজারগুলোতে। মানুষজনে ঠাসাঠাসিতে বাজারগুলোতে বিধিনিষেধ মানানোর কোনো চেষ্টাও চোখে পড়েনি গত ৬ দিন। সামনের এক সপ্তাহ একইরকম চললে এই লকডাউনের কোনো সুফল মিলবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তারা চান, মানুষ ও যান চলাচল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা হোক।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে আটদিনের কঠোর লকডাউন শুরু হয়ে আগামীকাল ২১ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ বহাল থাকবে। এর আগে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে আন্তঃমন্ত্রণালয় ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত রোববার ৩১তম সভায় সংক্রমণরোধে আরও এক সপ্তাহের জন্য ‘কঠোর লকডাউন’ আরোপের সুপারিশ করে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি লকডাউনের মেয়াদ আরও সাতদিন বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। সাইন্টিফিক্যালি তো ১৪ বা ১৫ দিন লকডাউন না হলে সংক্রমণের চেইনটা পুরোপুরি ভাঙা সম্ভব হয় না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে আগামী ২২ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত আগের শর্ত মেনে লকডাউন কন্টিনিউ অব্যাহত করবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সামারি পাঠানো হয়েছে। তিনি অনুমোদন দিলে প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে যাবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, সংক্রমণ ম্যানেজ করাটা আমাদের উদ্দেশ্য, ব্যবসায়ীরা যাতে ঈদের ব্যবসাটা করতে পারে। সেটা মাথায় রেখেই এখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে পরিস্থিতি কী হয় সেটা বিবেচনা করেই পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা মনে করছি লকডাউন আরও সাতদিন দিলে সংক্রমণটা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেন, তবে এর মধ্যে কঠোর স্বাস্থ্যবিধিটা মানার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মাস্ক পরার অভ্যাসটা সবাইকে গড়ে তুলতে হবে। যতদিন না স্থায়ী সমাধান হচ্ছে ততদিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে বাইরে বের হলে মাস্ক পড়তে হবে। আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অবস্থা দেখছি। স্বাস্থ্যবিধি মানলেই আমরা এটা ম্যানেজ করতে পারব। এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে সারাদেশে আরও এক সপ্তাহ সর্বাত্মক লকডাউন বাড়ানোর হচ্ছে। তিনি বলেন, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সরকার ঈদের আগে লকডাউন শিথিল করার চিন্তাভাবনা করছে। লকডাউন ঘোষণা করে গত ১২ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউনের মধ্যে পালনের জন্য ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, লকডাউনের আটদিন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বন্ধ থাকবে গণপরিবহন। তবে জরুরি সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান-সংস্থাগুলো খোলা রয়েছে। খোলা রয়েছে শিল্প-কারখানা। সীমিত পরিসরে দেয়া হচ্ছে ব্যাংকিং সেবা। এই সময়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া যাবে না। খোলা স্থানে কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যদি কেনা-বেচা করা যাবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়তে থাকায় এর আগে গত ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১৪ এপ্রিল ভোর ৬টা পর্যন্ত লকডাউন বা বিধি-নিষেধ ছিল। তবে গণপরিবহন, মার্কেট খোলা রেখে এই লকডাউন ছিল অনেকটাই অকার্যকর। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় দুই সপ্তাহ পূর্ণ লকডাউনের সুপারিশ করে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। এই প্রেক্ষাপটে নতুন করে কঠোর লকডাউন ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
এদিকে, সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ঘোষিত লকডাউনের ষষ্ঠ দিন ছিল গতকাল সোমবার। গত পাঁচদিনের তুলনায় সকাল থেকে রাজধানীর সড়কগুলোতে যানবাহনের চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো। বেশ কিছু মূল সড়কে ট্র্যাফিক সিগনালে বেশ লম্বা গাড়ির সারি দেখা গেছে। সকালে রাজধানীর পান্থপথ, রাসেল স্কয়ার, কলাবাগান, সাইন্সল্যাব, মিরপুর, ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকায় ব্যক্তিগত পরিবহন, মোটরসাইকেল ও রিকশা বেশি চলাচল করছে। এছাড়াও পণ্যবাহী ও জরুরি সেবা সংশ্লিষ্ট পরিবহনও চলছে।
গণপরিবহন না থাকায় অফিসগামী মানুষ বিকল্প বাহন হিসেবে রিকশা, সিএনজিচলতি অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল ব্যাবহার করছেন। জরুরি প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বেরিয়েছেন তাদেরও ভরসা এসব বাহন। তবে এসব পরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেকেই। এছাড়াও মোটরসাইকেলে দুজন চলাচলে গুনতে হচ্ছে জরিমানা।
ধানমন্ডি ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার জাহিদ আহসান বলেন, গত কয়েকদিনের তুলনায় আজ যান চলাচল বেড়েছে। যারা বের হচ্ছেন অধিকাংশই জরুরি প্রয়োজনে। এর মধ্যে হাসপাতালমুখী মানুষজন বেশি।এছাড়া মোটর সাইকেলে দুজন উঠলে আমরা তাদের কাছে প্রয়োজন জানতে চাচ্ছি। যথাযথ কারণ দেখাতে না পারলে জরিমানা করা হচ্ছে। তাছাড়া মোটরসাইকেলে একজন চলাচলেরও পরামর্শ দিচ্ছি আমরা।
ঢিলেঢালা চেকপোস্ট
চলমান কঠোর লকডাউনের শুরুতে যেমন চেকিং দেখা গিয়েছিল সেটি এবার অনেকটাই ঢিমেতালে চলছে। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন চেকপোস্টে পুলিশ সদস্যদের তৎপর থাকতে দেখা গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি ক্রমেই ঝিমিয়ে আসে। যার ফলে এক সময় পুরো ফাঁকা হয়ে পড়ে চেকপোস্টগুলো। পুলিশ সদস্যরা চেকপোস্টের পাশেই অবস্থান করলেও তাদের চেকিং ছিল না।
গত ৫ দিন বিধিনিষেধ কার্যকরে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে বেশ সক্রিয় দেখা গেছে পুলিশকে। তবে গতকাল সড়কে পুলিশের অবস্থান বেশ নমনীয় দেখা গেছে। এমনকি যেসব জায়গায় প্রতিদিন চেকিং চলতো সেখানেও কোনও কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এই কয়দিন এসব পয়েন্টে সাধারণ মানুষ বাধার সম্মুখীন এবং জেরার মুখে পড়লেও গতকাল তা ছিল না।
রাজধানীর কাওরান বাজার, বাংলামোটর, কলাবাগান, ধানমন্ডি, পান্থপথ, সাইন্সল্যাব, শ্যাওড়াপাড়া এবং পুরান ঢাকার নয়াবাজার এলাকায় দেখা যায়, এসব সড়কে গত কয়েক দিনের তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি, রিকশা, সিএনজি, মোটরসাইকেলের পরিমাণ অনেক বেশি দেখা গেছে। সঙ্গে অপ্রয়োজনে বাসা থেকে বের হওয়া মানুষের আনাগোনাও বেড়েছে। কিন্তু পুলিশ চেকপোস্টগুলোতে কড়াকড়ি কমেছে অনেকখানি। তাছাড়া ধানমন্ডি আবাহনী মাঠের কোণায় এবং মানিক মিয়া এভিনিউতে চেকপোস্টের কার্যক্রম দেখা গেছে। ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ারে ট্রাফিক বক্সের কোণায় চলমান বিধিনিষেধের প্রথম ৫ দিন যথেষ্ট চেকিং দেখা গেলেও গতকাল তা ছিল নীরব। একই চিত্র দেখা গেছে পান্থপথ সিগন্যালে এবং কাওরানবাজার সোনারগাঁও হোটেল ক্রসিংয়ে।
এ বিষয়ে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেন, চেকপোস্টের কার্যক্রম আগের মতোই আছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, চেক পোস্টে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কিছুটা শিথিল আছে। সরকারের বিধিনিষেধ সত্তে¡ও মানুষ অপ্রয়োজনেও বাইরে যাচ্ছে। তাদের কাছে বের হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কিংবা মুভমেন্ট পাস দেখাতে বললেও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে যাচ্ছেন। পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে বলেন, জনগণকে সচেতন করতে মাঠে রয়েছে পুলিশ সদস্যরা। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ ছাড়াও থানা পুলিশ নিজস্ব ভাবে তারা তাদের চেকপোস্ট পরিচালনা করছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন