শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অন্তহীন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা এবং মধ্যপ্রাচ্যে নয়া বাস্তবতা

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০১ এএম

মিথ্যা তথ্যের উপর ভিত্তি করে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের দুই দশক পেরিয়ে এসে অবশেষে মার্কিন ও তার জোটসঙ্গীরা পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করতে যাচ্ছে। আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সামরিক জোটের পরাজয় অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। বারাক ওবামা এ বিষয়ে কোনো ডিসাইসিভ সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগেই মধ্যপ্রাচ্য নীতির পরিবর্তন এবং আফগানিস্তান ও ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তার মেয়াদকালে তিনি তা রক্ষা করতে পারেননি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচির মধ্যেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা নিশ্চিত করেছেন। আগামী এগার সেপ্টেম্বরের আগেই সেনা প্রত্যাহার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার কথা বলা হচ্ছে। এটি এখন অনেকটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আফগানিস্তান এবং ইরাকে পশ্চিমা সামরিক আগ্রাসনের আয়োজনটি ছিল পুরোপুরি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে এবং তা সংঘটিত করা হয়েছিল মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ও মুনাফার লক্ষ্যে এবং মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে জায়নিস্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য। যুদ্ধ ব্যয়ের সব হিসাব সরকারি পরিসংখ্যান বা গণমাধ্যমের রিপোর্টে আসে না। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার গোপন তৎপরতা, কলাবরেটর এবং ওয়ার ক›ন্ট্রাক্টরদের ব্যয়ের একটা বড় অংশই থাকে পর্দার অন্তরালে। এ সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট থেকে পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্টে ২০ বছরের আফগান যুদ্ধের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ২.২৬ ট্রিলিয়ন(২ লাখ ২৬ হাজার কোটি) ডলার। আর এ যুদ্ধে মারা গেছে ২ লাখ ৪১ হাজারের বেশি মানুষ। একেকজন মানুষ হত্যার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে এক ডলারের কম। লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক আফগান নাগরিক হত্যার পাশাপাশি আফগান তালেবান ও প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে নিজেদের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। মার্কিন অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং অবশেষে পরাজয়ের গøানি নিয়ে শূন্য হাতেই দেশে ফিরতে হচ্ছে তাদের।

এরই মধ্য দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি আফগানিস্তানে বিশ্বের বৃহত্তম সামারিক-অর্থনৈতিক শক্তির পরাজয়ের ইতিহাস রচিত হল। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন, মার্কিনীদের আফগানিস্তান আগ্রাসনের মাত্র দুই দশক আগে আফগান তালেবানদের হাতে অন্যতম সামরিক পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসি-দখলদার বাহিনীকেও পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হয়েছিল। ইসলামের সুমহান ঐতিহ্য ও ত্যাগের শিক্ষাকে ঐক্যবদ্ধভাবে ধারণ করে বিশ্বের যে কোনো শক্তিকে পরাভুত করা সম্ভব, আফগানিস্তানে এটা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ইরাকি প্রতিরোধ যোদ্ধারাও এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে। আফগানিস্তানের পর ইরাক থেকেও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে যথাশীঘ্র পাততাড়ি গোটাতে হবে মার্কিন বাহিনীর। গত বছরের শুরুতে ইরাকে বাগদাদ বিমান বন্দরে ইরানি সামরিক কমান্ডার কশেম সুলাইমানিকে ড্রোন হামলায় হত্যা করার পর থেকে ইরাকে মার্কিন সেনাঘাটিগুলো ইরাকি গেরিলা গ্রæপগুলোর অব্যাহত টার্গেটে পরিনত হয়েছে। এ সপ্তাহে ইরাকে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি গোপন কার্যালয়ে হামলা করে বেশ কয়েকজন ইসরাইলী গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে ইরাকি গেরিলারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্ব দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে থাকা পূর্ব ইউরোপসহ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং সহযোগী-সমর্থক দেশগুলো, অন্যদিকে ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং তাদের প্রভাব বলয়ে থাকা দেশগুলো। এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর সামরিক পরাশক্তির পরস্পরের দিকে তাক করে রাখা মহাদেশীয় পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্র (আইসিবিএম) দুই বলয়ের মধ্যে একটা তীব্র ¯œায়ুযুদ্ধে পরিগ্রহ করেছিল। বিগত শতকের আশির দশকের শেষ দিকে এসে আফগানিস্তানে সোভিয়েত পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙ্গে গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউনিপোলার বিশ্বের একচ্ছত্র নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকলে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কম্পপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যবসায় ধস নামার আশঙ্কা মাথায় রেখেই একটি নতুন কাল্পনিক শত্রæ তৈরী করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। ইরানের ইসলামি বিপ্লব, কথিত পারমানবিক প্রকল্প, ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পশ্চিমাদের মিত্র এবং সহযোগিতা পেয়ে আসলেও যুদ্ধের ফলাফল পশ্চিমাদের বিপক্ষে যাওয়ার পর তারা প্রথমে ইরাকে কুয়েত আগ্রাসনের ইন্ধন দিয়ে কুয়েত দখলমুক্ত করার অজুহাতে গাল্ফ ওয়ারের সূচনা করে। অতঃপর ওয়েপনস অব মাস ডেস্ট্রাকশনের জায়নবাদী মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইরাকে মার্কিন-ন্যাটো দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

মধ্যপ্রাচ্যে দখলদারিত্বসহ একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের প্লট হিসেবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রের টুইন টাওয়ারে অকল্পনীয় সন্ত্রাসী বিমান হামলার নাটক সাজানো হয়। এই হামলার আগে এবং পরের ঘটনা প্রবাহের আলোকে এটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ ঘটনা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের জায়নিস্টরা আগেই জানত। সে সময় ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের শিডিউল থাকলেও তা স্থগিত করা হয়। টুইনটাওয়ারে অনেক ইহুদির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস থাকলেও হামলার কিছুদিন আগে সে সব অফিসের বেশ কয়েকটা স্থানান্তরিত হয়। বাকি যে সব ইহুদি প্রতিষ্ঠান সেখানে ছিল, হামলার দিন তারা কেউই সেখানে ছিল না। টুইন টাওয়ারের বিমান হামলায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়। তাদের মধ্যে অনেক মুসলমান থাকলেও মার্কিন ইহুদিদের সংখ্যা ছিল অতি নগন্য। এসব বাস্তব পরিসংখ্যান এবং নাইন-ইলেভেন পরবর্তী যুদ্ধের কৌশলগত বেনিফেশিয়ারি হিসেবে বিমান হামলার নেপথ্যে জায়নবাদিদের হাত থাকার বিষয়টিকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। মার্কিন ও জায়নিস্টবিরোধী শক্তির পক্ষ থেকে এ হামলাকে ইসরাইল ও মার্কিন ডিপস্টেট চক্রের ফল্স ফ্লাগ অপারেশন বলে দাবি করা হয়েছে। তবে গত ২০ বছরে বেশ কয়েকটি নিরপেক্ষ তদন্ত এবং বেশ কয়েকজন পশ্চিমা গবেষকের গবেষণায়ও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গেছে। ফরাসি লেখক ও ফিলানথ্রপিস্ট লরা গেইনতের বইয়ে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলাকে ইসরাইলী এজেন্টদের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গেইনত তার গবেষণামূলক গ্রন্থের নাম দিয়েছেন, ‘জেএফকে-৯/১১, ফিফটি ইয়ার্স অব ডিপ স্টেট’। অর্থাৎ ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি হত্যাকান্ড থেকে শুরু করে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলার ঘটনাকে জায়নবাদি শক্তি ও ডিপস্টেটের ফল্স ফ্লাগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এই পশ্চিমা গবেষক। সাসেক্স ইউনিভার্সিটির সাবেক এমিরেটাস প্রফেসর কীস বেন ডার পিল নাইন-ইলেভেন হামলায় সউদি আরব ও আলকায়েদার সম্পৃক্ততার কথা নাকচ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মহল এবং ইসরাইলীরা জড়িত বলে দাবি করেন। এর আগে হামলার ঘটনার পর পর নিউ জার্সি পোয়েট লোরিয়েট আমিরি বারাকা(লেরয় জোনস) নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার সাথে জায়নবাদিদের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরেন।

নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী বিমান হামলা ঘটনার আধাঘন্টার মধেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ একে আল-কায়েদার হামলা বলে উল্লেখ করে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ‘ক্রুসেড’ ও অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দেন। আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তানে আত্মগোপন এবং আল কায়েদার নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে দিতে আফগানিস্তানে নজিরবিহীন সামরিক হামলা ও দখলদারিত্ব চালিয়ে তাদের দাবির সত্যতা প্রমাণ করতে পারেনি পেন্টাগন। আফগানিস্তানে দখলদারিত্বের এক দশক পর ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে মার্কিন মেরিন সেনাদের কমান্ডো অভিযানে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার পর আরো এক দশক ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত রাখতে হলো কেন? কারণ আর কিছুই না, যুদ্ধ বাজেটের নামে মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের শত শত বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্যের স্বার্থ। তবে দুই দশকে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করার পর অন্তহীন যুদ্ধের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকদের পকেট থেকে অন্তহীন অর্থনৈতিক লুণ্ঠনবাজির একটি পর্ব আপাতত বন্ধ হতে চলেছে। আফগানিস্তানে জনসংখ্যা ৪ কোটির কম। সেখানে যুদ্ধ চালাতে প্রতি বছর যে পরিমান অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেটের দ্বিগুণের বেশি। সব সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে ২০ বছর ধরে চলা আফগান যুদ্ধের ইতি টানার ঘোষণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, সন্ত্রাসী তৎপরতার চারণভ’মি হওয়া বন্ধ করার যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। এখন আফগানিস্তানে অন্তহীন যুদ্ধ বন্ধের পালা। দুই দশক আগে হোয়াইট হাউজের যে স্পটে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই একই স্পটে দাঁড়িয়ে জো বাইডেন অন্তহীন যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দিলেন। গত একযুগ ধরেই জো বাইডেন আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন। এখন তিনি যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দিয়ে নিজের অবস্থানের পক্ষে একটি ঐতিহাসিক ভ’মিকা পালন করলেন। আগামী ১ মে থেকে শুরু করে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তা আরো আগেই শেষ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রথম চুক্তি নির্ধারিত করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। এগ্রিমেন্ট অনুসারে ২০১১ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মার্কিন সৈন্য ও অস্ত্র সরিয়ে নেয়ার চুক্তি আংশিক বাস্তবায়িত হলেও জায়নবাদী নীল নকশায় সা¤্রাজ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে ইরাকে নতুন করে সেনা মোতায়েন করে পেন্টাগণ। এখন সে সব সেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গলার কাঁটা ও ইজ্জতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষত কাশেম সুলাইমানিকে হত্যা করার পর থেকে ইরাকে মার্কিন সেনারা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়েছে। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের ক্ষেপনাস্ত্র হামলার শিকার হচ্ছে তারা। ইরাকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এখন আর কেউ মেনে নিচ্ছে না। ইরাকের রাজনৈতিক নেতারা একই সঙ্গে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং ইরানি গেরিলা হস্তক্ষেপ থেকে থেকে মুক্তি চাচ্ছেন। তবে ইরাকের উপর সামরিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঠান্ডা লড়াইয়ে মার্কিনীদের পরাভূত করে ইরানের বিশাল কৌশলগত বিজয় অর্জিত হয়েছে।

কোরিয়া, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন পর্যন্ত গত সাত দশকে কোনো যুদ্ধেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক-রাজনৈতিক বিজয় লাভে সক্ষম হয়নি। এসব যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শিক বা রাজনৈতিক স্বার্থে শুরু হয়নি। মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রশাসনের অভ্যন্তরে থাকা বিশেষ গোষ্ঠির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ডিপ স্টেট ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের স্বার্থে এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিটি যুদ্ধের আগেই জায়নবাদ প্রভাবিত মার্কিন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া একটি বিশেষ প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইন করেছিল। পরবর্তীতে এসব ক্যাম্পেইনের মিথ্যাচার প্রমানিত হয়েছে। মূলত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ঠান্ডা লড়াইয়ের বিভক্তি ও ভীতি জিইয়ে রাখার মাধ্যমে অস্ত্রবাণিজ্য চাঙ্গা রাখাই প্রতিটি যুদ্ধের নেপথ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। শুধুমাত্র অস্ত্রবাণিজ্য ও ওয়ার বাজেট হাতিয়ে নেয়ার কলাকৌশলই যুদ্ধে রাজনৈতিক পরাজয়ের ভিত্তি রচনা করেছে। আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই ট্রিলিয়ন ডলার। তালেবান এবং আফগান গেরিলারা এর এক শতাংশের কম খরচ করে মার্কিন বাহিনীকে পরাভুত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধের চিত্রও প্রায় একই রকম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের সেনাবাহিনীর পেছনে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, আবার প্রতিপক্ষকেও অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করে যুদ্ধকে প্রলম্বিত করেছে। এর পেছনে অস্ত্রবাণিজ্যের অনুঘটকদের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট রিগানের আমলে নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের মাধ্যমে ইরানে অস্ত্র বিক্রির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। ইরানের বিরুদ্ধে ৮ বছরব্যাপী যুদ্ধে ইরাককে সব রকম সহযোগিতা দিলেও সেটা ছিল একটা পরিকল্পিত ফাঁদ। হাজার হাজার কোটি ডলার ঋণের ফাঁদে ফেলে ঋণ পরিশোধের জন্য কুয়েতের তেলসমৃদ্ধ উপত্যকা দখলের নেপথ্য ইন্ধন আমেরিকাই দিয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন কুয়েত দখল করার পর তা প্রত্যাহারের জন্য ক’টনৈতিক চাপ সৃষ্টির বদলে সরাসরি সামরিক আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই যুদ্ধে এবং পরবর্তী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরাকের লাখ লাখ মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্যের মুখোমুখী হয়। নিষেধাজ্ঞা-অবরোধে কাবু ইরাক যখন আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি সেখানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ঘিরে অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা, সামরিক হুমকি, টার্গেট কিলিংসহ প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য তৎপরতা কখনো বন্ধ হয়নি। ইরানের সাথে ৬ জাতির সমঝোতা চুক্তির মধ্য দিয়ে পারমানবিক অস্ত্র প্রকল্প থেকে ইরানকে নিবৃত্ত রেখে শক্তিশালী ইরানের সম্ভাবনা টিকিয়ে রেখে জায়নবাদিরা স্বস্তি বোধ করেনি। তারা ইরানকে ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়ে নেতানিয়াহু ইরানযুদ্ধ শুরুর তৎপরতা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। নেতানিয়াহুর চাপে ইরানের পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার মার্কিন সিদ্ধান্তও ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। মার্কিনীরা এখন চুক্তিতে ফিরে যেতে ভিয়েনায় ৬ জাতির বৈঠকে বসেছে। ওদিকে সউদি-ইরান আলোচনার কথাও শোনা যাচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় পশ্চিমাদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার যে নতুন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ প্রশস্ত, তা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্স এবং জায়নবাদী ডিপস্টেটকে নতুন কোনো যুদ্ধবাদী ষড়যন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বাকি দুনিয়াকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
MD Amzat ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৩ পিএম says : 0
বাস্তব চিত্র টি তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
MD Nesar Uddin ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৩ পিএম says : 0
valuable post
Total Reply(0)
মাজহারুল ইসলাম ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৪ পিএম says : 0
লেখাটির জন্য লেখক জামালউদ্দিন বারী সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি
Total Reply(0)
হাসিবুল হাসান শান্ত ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৫ পিএম says : 0
নিষেধাজ্ঞা-অবরোধে কাবু ইরাক যখন আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি সেখানে মার্কিন সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
Total Reply(0)
নাজিম ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৬ পিএম says : 0
ইরাকের উপর সামরিক-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঠান্ডা লড়াইয়ে মার্কিনীদের পরাভূত করে ইরানের বিশাল কৌশলগত বিজয় অর্জিত হয়েছে।
Total Reply(0)
সততাই উৎকৃষ্ট পন্থা ২১ এপ্রিল, ২০২১, ৫:৪৫ পিএম says : 0
দুই ট্রিলিয়ন ডলার খরচে ২৫০০ সৈন্য হারিয়ে এখন তালেবানদের সাথে চুক্তি করে পালাতে হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নও এমনটাই করেছিল।
Total Reply(0)
Foysal Mahmud ২১ এপ্রিল, ২০২১, ৫:৪৬ পিএম says : 0
কোনো ধ্বংসাত্মক যুদ্ধই মানুষের জিত বা জয় নিয়ে আসে না। মানুষে মানুষে হত্যাযজ্ঞ মানবজাতির ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আমরা ধ্বংসাত্মক এই দল ওই দল সাপোর্ট দিয়ে বাস্তবে পৃথিবীটা নরকে পরিণত করছি। ভালোর প্রতিযোগিতা/যুদ্ধ হোক ভালো কিছু নিয়ে। জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণের মধ্যে বিদ্বেষ ভুলে সম্প্রতির দিকে এগিয়ে আসুক মানুষ। মানুষ সকল জাত-পাত, ধর্ম-বর্ণ এক ঈশ্বরের ভেবে ফিরে আসুক সম্প্রতিতে। পৃথিবী মানবতার হোক, মানুষ হোক সকল জীবের সম্পৃতির বন্ধক।
Total Reply(0)
মঈনুদ্দিন ২২ এপ্রিল, ২০২১, ৬:১১ এএম says : 0
আফগান যুদ্ধে আমেরিকা যে ইরানের সাহায্য নিয়েছিল এটা বলা প্রয়োজন ছিল।
Total Reply(0)
খোরশেদ আলম ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৯:০৯ পিএম says : 0
জামালউদ্দিন বারী সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
খোরশেদ আলম ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৯:১০ পিএম says : 0
লেখককে ধন্যবাদ জানাই তার জ্ঞানগর্ভ লেখার জন্য।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন