শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

বেড়িবাঁধে করোনার থাবা

মেরামতের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন পরিকল্পনা কমিশনের

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় আইলা, বুলবুল, ফনী এবং আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত এবং বাঁধ সংরক্ষণ, নদী ক্ষননসহ সারাদেশে ১০১টি প্রকল্প বাস্তবায়ানের কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে করোনার কারণে দেড় হাজার কোটি টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। অনেক প্রকল্পের বরাদ্ধ কেটে নেয়ায় প্রয়োজনীয় অর্থের অভারে কারণে উন্নয়ন কাজে ধীরগতি শুরু হয়েছে। গত বছর যেসব জেলায় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই জেলা গুলোতে অনেক বাঁধ মেরামত এবং বাঁধ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়নি বলে জানা গেছে।

ষাটের দশকে নির্মিত বেরি বাঁধগুলোর উচ্চতা ছিল গড়ে ১২ ফুট, এখন যেটা সর্বোচ্চ ৩০ ফুট পর্যন্ত করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রতি মিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রস্তাবিত এ ব্যয়কে অত্যাধিক মনে করে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং ১৫ পুনর্বাসন প্রকল্প এমন অত্যাধিক অর্থের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ১ দশমিক ৬০ কিলোমিটার বাঁধ পুনর্বাসন বাবদ ৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মিটারে পুনর্বাসন ব্যয় দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৭৮৯ টাকা। প্রকল্পের মূল কাজ অর্থাৎ বাঁধ নির্মাণ, সংরক্ষণ, মেরামত ইত্যাদি কাজের প্রাক্কলন পূর্বের প্রাক্কলন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তা যাচাই করে দেখার প্রয়োজন আছে বলে জানিয়েছে কমিশন।
এ ব্যাপারে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম ইকিলাবকে বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকার ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘূর্ণিঝড় আম্পান দুর্গত খুলনার ১৪ নম্বর পোল্ডারে ৯৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ও ৩১ নম্বর পোল্ডারে এক হাজার ২০১ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং সাতক্ষীরার ৫ নম্বর পোল্ডারে ৩ হাজার ৬৭৪ কোটি ৩ লাখ ও ১৫ নম্বর পোল্ডারে ৯৯৭ কোটি ৭৮ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর বেড়িবাঁধ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান সরকার। পর্যায়ক্রমে সারাদেশের মতো পুরো উপকূলে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে।

এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক এ কে এম ওয়াহেদ উদ্দিন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণিঝড় আইলা, বুলবুল, ফনী এবং আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামত নদী ক্ষননসহ ১০১টি প্রকল্পর বাস্তবায়ানের কাজ শুরু হয়েছে। ৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থেকে করোনার কারণে ১৫শত কোটি টাকা কেটে নেয়া হয়েছে। আর বিশ্ব ব্যাংকের যে সব প্রকল্পের কাজ চলছে সে গুলোর টাকা কেটে নেয়া হয়নি।

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়াতে ষাটের দশকে নির্মিত উপকূলীয় বাঁধগুলো ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালে আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার বেশির ভাগই এখনো যথাযথভাবে সংস্কার করা হয়নি। সর্বশেষ গত বছর ২৫ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে উপকূলের ১৫২টি স্থানে ৫০.৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। আর ৫৮৩টি স্থানে ২১০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই সব বাঁধের পাশাপাশি পুরো উপকূলীয় অঞ্চলকে ঝুঁকিমুক্ত করতে বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনর্নিমাণে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

কার্যপত্রে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতসহিষ্ণু সমৃদ্ধিশালী বদ্বীপ গড়ে তোলাসহ ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকার কৃষি ও শিল্প অর্থনীতি, মৎস্য, বনায়ন, জনস্বাস্থ্য, পানি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ খাতকে সমন্বিত করে প্রথম শতবর্ষী মহাপরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ হাতে নিয়েছে। ওই ডেল্টা প্ল্যান অবলম্বনে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো ডিজাইনের ক্ষেত্রে বৃহত্তর নদ-নদীর জন্য ২০০ বছরের এবং ছোট নদ-নদীর জন্য ২১ বছরের বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ জন্য উপকূলীয় বাঁধগুলোর উচ্চতা প্রয়োজন অনুযায়ী তিন থেকে সাত ফুট বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী নির্মাণের লক্ষ্যে বাঁধের ঢালে, পোল্ডারের ভেতরে এবং অধিগ্রহণ করা জমিতে যথাযথভাবে বৃক্ষ রোপণ করা হবে। এদিকে প্রথম পর্যায়ের কাজ চলমান থাকা অবস্থায় ওই ১৭টি পোল্ডারের বাইরে আরো ১৩টি পোল্ডারে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্প প্রণয়নের কাজ গত বছর শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ আগামী ২০২২ সালের জুনে শেষ হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় পুনর্গঠন করে পুনরায় জমা দেওয়া হবে। প্রকল্পটি নিয়ে স¤প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে নানা ধরণের প্রশ্ন তোলা হয়। প্রকল্পের আওতায় মোটরযান মেরামত ও সংরক্ষণ বাবদ ৯ লাখ, সেমিনার কনফারেন্স বাবদ ৬ লাখ, তিনটি রেস্ট হাউজ, অফিস ভবন মেরামত বাবদ ১ কোটি টাকা প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। অন্যদিকে প্রকল্পে সম্মানী ভাতা বাবদ ৮ লাখ, কম্পিউটার কেনা বাবদ ২ লাখ এবং মধ্যবর্তী মূল্যায়ন বাবদ ১০ লাখ টাকা প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে সভায় একমত পোষণ করা হয়। পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের প্রধান (অতিরিক্ত সচিব) মো. মতিউর রহমান বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা হয়েছে। প্রকল্পের কিছু ব্যয় বেশি মনে হয়েছে। এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে জবাব চাওয়া হয়েছে। তারা (বাপাউবো) জবাব দিলেই বিষয়গুলো প্রকল্প প্রস্তাবনায় পুনরায় সংযুক্ত করে একনেক সভার জন্য প্রস্তুত করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ২২ দশমিক ৫০ কিলোমিটার নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন বাবদ ১৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা সংস্থান রাখা হয়েছে। ফলে প্রতি মিটারে নিষ্কাশন বাবদ খরচ পড়ে ৭ হাজার ৬৪০ টাকা। এই বিষয়ে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে কমিশন।

নিষ্কাশন খাল পুনঃখননের যৌক্তিকতার বিষয়ে বাপাউবো প্রতিনিধি সভায় জানায়, পোল্ডার অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নিষ্কাশন খাল পুনঃখনন করা প্রয়োজন। সভায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিনিধি বলেন, বাঁধ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কী ধরনের জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রকল্পে অনর্ভূক্ত করা হয়নি। বাঁধের ঢাল সংরক্ষণ কাজে ব্যবহারের জন্য বøকের পুরত্ব ৩০০ মিলি মিটারের পরিবর্তে ২০০ মিলি মিটার করা যায় কি না বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করা প্রয়োজন। নদী তীরে কী ধরনের জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হবে তার সুনির্দিষ্ট বিবরণ প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা। চলতি সময় থেকে ২০২৩ সালের জুন মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের অন্যাতম উদ্দেশ্য টেকসই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৩ হাজার ৪৪১ হেক্টর এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে উদ্ভূত ক্ষতির প্রভাব কমিয়ে আনা এবং উন্নত পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা এবং প্রকল্পের মাধ্যমে পোল্ডারিং ব্যবস্থাকে পুনরুজীবিত করে বিদ্যমান কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন নির্বিঘœ করা। একই সাথে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনে সহায়তা করা।

গত বছর ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার বলেন, স্বাধীনতা-উত্তরকালে নির্মিত বাঁধগুলো খুবই নিচু ও ছোট, যে কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি জোয়ারের পানি বাড়লেই বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়। বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট অঞ্চলের অবস্থা খুবই নাজুক। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ওই অঞ্চলের অন্তত ৩৯টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকে প্লাবিত হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন