বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা

অনাবৃষ্টি-হিটশকে ঝলসে যাচ্ছে ফল-ফসল কৃষিতে এমন বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘হিটশক’ দেখিনি : ড. মো. শাহজাহান কবীর বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহে ফল ও ধানের ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে : ড. মুন্নুজান খানম

শফিউল আলম/ মাহফুজুল হক আনার | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০০ এএম

বৈশাখের ৮ তারিখ আজ। বৃষ্টি দূরের কথা কালবৈশাখীর দেখা নেই। বৈশাখের বৃষ্টির পানি জমিতে ধানের ফুল (থোর) ফোটে, আমের মুকুল, লিচুর মুকুল পরিপুষ্ট করে। বৃষ্টির পানি পেলে গাছে পুরনো শাখায় ফুল আসে। বৃষ্টি না হওয়ায় কাক্সিক্ষত ফলন নিয়ে কৃষকের শঙ্কা: অন্যদিকে বৈশাখেও তাপমাত্রার পারদ উর্ধ্বমুখি। হাঁসফাঁস গরমে পানির অভাবে বিস্তীর্ণ জনপদ খাঁ-খাঁ করছে। একটানা গরমে মাটির নিচে পানির স্তর আরো নিচে নেমে গেছে। বাধ্য হয়েই সমতলের কৃষকদের টাকা খরচ করে বোরোর জমিতে সেচের পানি দিতে হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় দেশি মাছ যেন হারিয়ে গেছে। ধানের ফুল ফোটার সময়ে গরম হাওয়ায় পুড়েছে কৃষকের স্বপ্ন। চলতি মৌসুমে টানা তাপপ্রবাহে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে বোরো। কোথাও কোথাও ‘হিটশকে’ ধান চিটা হচ্ছে। আবার বৃষ্টি না হওয়ায় আম, লিচুসহ মৌসুমি ফলের মুকুল শুকিয়ে যাচ্ছে। এক যেন কৃষকের ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা।

সারা দেশের ইনকিলাবের জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিরা জানান, সারা দেশেই প্রচন্ড গরম। বৈশাখের তীব্র তাপদাহে পুড়ছে মাঠ-ঘাট ফল-ফলাদির বাগান। রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নানা জাতের আম, রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম, দিনাজপুরের লিচুর দেশজোড়া নাম। আম ও লিচুর শত শত কোটি টাকার ব্যবসা। অথচ সময় মতো কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না হওয়ায় পুড়তে বসেছে দেশের লাখো কৃষকের স্বপ্ন। আবার উজানে পদ্মা ও তিস্তা থেকে ভারত পানি সরিয়ে নেয়ায় আল্লাহর দান প্রকৃতির অপার সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক নদীগুলো শুকিয়ে খাঁ-খাঁ করছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ যেন মরুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, মার্চের শেষ সপ্তাহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এখন ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পেরেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর উপরে যদি তাপমাত্রা উঠে এবং এসময় যদি ফুল ফোটে সেগুলো শুকিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, আমার দীর্ঘ চাকরি জীবনে কৃষিতে এমন বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘হিটশক’ দেখিনি। এখন পর্যন্ত ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে এফেক্টেড হয়েছে। কোনো কোনো জমি ৮০% পযন্ত, কোনো জমি ৫%-১০%; আবার পাশে ভালোও রয়েছে। যেখানে ফ্লাওয়ারিং পর্যায়ে ছিল না, সেখানে খুবই সুন্দর রয়েছে, যেখানে ফ্লাওয়ারিং ছিল সেটাতে ৭০-৮০% ক্ষতি হয়েছে।

অথচ গতকাল বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বলেন, সর্বশেষ সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২০১৯ সালে রাজশাহীতে। এবার গত সোমবার যশোরে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় এ বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বগুড়ায় ৩৭ দশমিক ২, টাঙ্গাইলে ৩৮ দশমিক ১, ফরিদপুরে ৩৮ দশমিক ২, গোপালগঞ্জে ৩৭ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

জানতে চাইলে ব্রি-এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (উদ্ভিদ শারীরতত্ত¡ বিভাগ) ড. মুন্নুজান খানম বলেন, এবার যে হিটশক তা ২০০৭ সালের পরে আর হয়নি। এবার হিটশক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করছে। প্রতিবছর বৈশাখে তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে, বৃষ্টি হয়। কিন্তু যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না তখনই ধানের জন্য তা হিটশক ঘটে। বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ফল-ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়। সেটাই হচ্ছে।

সারা দেশে জমিতে হিটশকে পুড়ছে ক্ষেত। শুধু ময়মনসিংহ জেলার ১৩ উপজেলা এবং পাবনার চাটমোহর উপজেলায় হিটশকে চিটায় পরিণত হয়েছে সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান। এর মধ্যে চাটমোহরে ৬ হাজার ও ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির বোরো ধানের এ ক্ষতি হয়েছে। এতে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কায় আছেন এ দুই জেলার কৃষক।

চলতি মাসের শুরুর দিকে পাবনার চাটমোহরে হিট শকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বোরো ধান। কয়েক মিনিটের গরম হাওয়ায় ধীরে ধীরে ধান চিটা হতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতিতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাটমোহরের কৃষকরা।
কৃষি বিভাগ বলছে, উপজেলায় প্রায় ছয় হাজার হেক্টর জমির ধান হিটশকে আক্রান্ত হয়ে চিটায় পরিণত হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এখনো ক্ষতিগ্রস্ত জমির ধানের ৮০ ভাগ রক্ষা করা সম্ভব।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার কাতুলী গ্রামের কৃষক মো. মানু শেখ জানান, দুই বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করেছিলাম। আগাছা পরিষ্কার, সেচ দেয়া, সার, কীটনাশক খরচ, বীজসহ সবকিছু মিলিয়ে খরচ হয়েছে সাড়ে ২২ হাজার টাকা। কিন্তু গরম বাতাসে জমির ধান যেভাবে চিটা হয়ে গেছে, তাতে অর্ধেক খরচ উঠবে কি না সন্দেহ। একই গ্রামের কৃষক মো. দিলবার হোসেন, রবিউল ইসলাম রবি কমবেশি সবাই ৩ থেকে ৭ বিঘা জমিতে বোরো ধান রোপণ করেছেন। তাদের কণ্ঠেও একই হতাশার সুর। ধান লাগাতে যে খরচ হয়েছে তাতে কিভাবে কি হবে বুঝতে পারছেন না তারা। হিটশকে জমির অর্ধেক ধান চিটা হয়ে গেছে। এমন চিত্র পাওয়া গেছে, বগুড়া, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নিলফামারী, জয়পুরহাট, নওগাঁ জেলাসহ কয়েকটি জেলায়।

এদিকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গরম হাওয়ায় আনুমানিক ২ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুর্যোগ শেষ হতে না হতেই আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে গলাপচা রোগ। জেলায় কয়েকটি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে এ খবর পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্রে ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি মাসের শুরুতে জেলার ১৩টি উপজেলায় মাত্র কয়েক মিনিটের গরম বাতাস বা হিটশকে বিস্তীর্ণ এলাকার জমির বোরো ধানের শীষ চিটায় পরিণত হয়। এখন নতুন করে ময়মনসিংহের কয়েকটি উপজেলায় ব্লাষ্ট রোগ দেখা দিয়েছে। ভালুকা, ত্রিশাল, গৌরীপুর, ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ সদর ও হালুয়াঘাট উপজেলায় এ রোগের প্রাদুভার্বের খবর পাওয়া গেছে। কৃষি অফিসারদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ প্রয়োগ করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। ময়মনসিংহ জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, চলতি মৌসুমে ময়মনসিংহ জেলায় ২ লাখ ৬১ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়। গরম বাতাস বা হিটশকে জেলার ৪ হাজার ২০১ হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হলেও ২ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমির ধানের শীষ সম্পূর্ণ চিটায় পরিণত হয় এবং ৬৩ হাজার ৩৩৮ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো দেখা দিয়ে বøাস্টের প্রাদুর্ভাব। গৌরীপুর উপজেলার ইউসুফাবাদ, সাতুতি, গাঁওগৌরীপুর, শালীহর, চান্দেরসাটিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় এখন বোরো ধানে নতুন করে পাতাপোড়া, ‘গলাপচা’ বা ব্লাষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রিয়াজ উদ্দিন বলেন, হিটশকে ধানের ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হয়েছে। ব্লাষ্ট রোগের প্রাদুর্ভাবের খবর পেয়েছি। কিন্তু এখন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক কিংবা জমির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়নি। জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, গরম বাতাসে ধানের ক্ষতি হয়েছে। তবে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে প্রতিষেধক ব্যবহারের জন্য।

বৃষ্টির যেন দেখা নেই। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সে. ছাড়িয়ে যাচ্ছে। খুলনা, রাজশাহী, ঢাকা বিভাগসহ দেশের অনেক জেলায় বাতাসে যেন মরুর লু-হাওয়ার ঝাপটা। বইছে মাঝারি তাপপ্রবাহ। গত ১৭ ও ১৮ এপ্রিল অধিকাংশ জেলায় স্বস্তির বৃষ্টি ঝড়েছে হালকা কিংবা মাঝারি। গড়ে ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি নিচের দিকে নামে তাপমাত্রার পারদ। কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তনের দিকে যেতে না যেতেই দু’দিন বিরতি দিয়ে হঠাৎ করেই সোমবার তাপদাহ তীব্রতর মোড় নিয়েছে। আবহাওয়ার এহেন এলোমেলো, খেয়ালি, চরম-ভাবাপন্ন আচরণকে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক ফল ও প্রভাব হিসেবে দেখছেন আবহাওয়া-পরিবেশ বিশেষজ্ঞগণ।

চৈত্র-বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসগুলোতে উজ্জ্বল সূর্য কিরণকাল দীর্ঘ থাকবে। উত্তাপ হবে বেশি। যা ষড়ঋতুর এদেশে আবহাওয়ার চিরচেনা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির আপন নিয়মেই গ্রীষ্মের রোদের তেজে রসালো-শাঁসালো, পুষ্ট-সুমিষ্ট হয়ে ওঠে ফল-ফলাদি। আম, কাঁঠাল, লিচু, আনারস, লেবু, জাম, তরমুজ, বাঙ্গী, লটকন, পেয়ারা, আমলকি প্রভৃতি। তবে বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর নিয়মের ছকে এই চৈত্র-বৈশাখেই দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়া, কালবৈশাখী, বজ্রঝড়-বজ্রপাতের সঙ্গেই হালকা ও মাঝারি বৃষ্টিপাত হওয়াই স্বাভাবিক। গরম কেটে গিয়ে মাঝেমধ্যেই থাকবে হিমেল হাওয়া। আবহাওয়ার শীতল পরশ। কিন্তু ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টির দেখা নেই।

নিরবচ্ছিন্ন অনাবৃষ্টি আর খরতাপের দহনে দুর্বিষহ স্বাভাবিক জনজীবন। বিপর্যস্ত কৃষি-খামার সেক্টর। ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টি একেবারেই উধাও। গত নভেম্বর মাস থেকে খরা পরিস্থিতির শুরু। বাংলাদেশের জলবায়ুর নিরিখে, বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক হার ও পরিমাণের তুলনায় গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে সারা দেশে সার্বিক গড় বৃষ্টি ৯৪ শতাংশই কম হয়েছে। বলা যায় বৃষ্টিই ঝরেনি। তাছাড়া গেল মার্চ মাসের জলবায়ু চার্ট নিরিখে দেশের সার্বিক গড় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে যথাক্রমে ১.৭ এবং ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ঊর্ধ্বেই ছিল। যা পুরোদমে অনাবৃষ্টি ও খরার দহনের সূচক বহন করছে। চলতি এপ্রিলে এসে সমগ্র দেশে টানা অনাবৃষ্টি খরা পরিস্থিতি ষষ্ঠ মাসে পড়েছে।

অবিরাম তীব্র খরতপ্ত আবহাওয়ায় ঝলসে যাচ্ছে ফল-ফসল, সবজি, ক্ষেত-খামার। গত সোমবার থেকে পারদ ৪০ ডিগ্রিতে লাফ দেয়ায় ফল-ফসল আবারও হিটশকের মুখে পড়েছে। কেননা জমির টপসয়েল আগেই পুড়ে খাক। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামছে। খাল-বিল-ছরা, দীঘি-পুকুর, নদ-নদীসহ ভূ-উপরিভাগের পানির উৎসগুলো শুকিয়ে হয় চৌচির নয়তো তলানিতে ঠেকেছে। পাহাড় টিলাময় উঁচু-নিচু বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে সবধরনের ফল-ফসলের জমি থেকে শুরু করে মাছ চাষের পুকুর-খামার টানা অনাবৃষ্টি ও তাপদাহের কারণে মারাত্মক সঙ্কটে পড়েছে। সেচের খরচ মেটাতে গিয়ে দিশেহারা কৃষকেরা।

দিনভর যেন মরুর অগ্নিঝরা বাতাসের ঝাপটায় পুড়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে আধপাকা বোরো ধানসহ ফল-ফসল। চাই শীতল মেঘের ছায়া। চাই বৃষ্টির ধারা। চাই ঠান্ডা হাওয়ায় বাতাসে স্বস্তির শ্বাস-প্রশাস। অথচ নেই মেঘ-বৃষ্টি, শীতল হাওয়া। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি-খরার কবলে দেশ। খাদ্যশস্য সঙ্কটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আপামর মানুষ রহমতের বৃষ্টির আকুল প্রার্থনায় চাতক পাখির মতো আকাশপানে তাকিয়ে।

বাপাউবো’র দেশে বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত গত ১১ এপ্রিল পূর্বাভাস প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ ও বৈশি^ক আবহাওয়া সংস্থাসমূহের গাণিতিক মডেলের তথ্য মতে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলতি এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হতে পারে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এ অঞ্চল বিশেষত সিলেটে গত ক’দিন যাবত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি ঝরছে। তবে দেশের অন্যত্র বৃষ্টিবিহীন খাঁ-খাঁ অবস্থা বিরাজ করছে। তাপদাহ আরো বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। গেল ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, সাতক্ষীরা, চাঁদপুরে রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও ২৭ ডিগ্রির ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। ঢাকায়ও রাতের পারদ ২৭ ডিগ্রির কাছেই। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সূত্রে জানা গেছে, আপাতত পশ্চিমা বায়ু ও পূবালী বায়ুর সংযোগের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বজ্রবৃষ্টির ঘনঘটাও নেই তেমন।

চুয়েটের জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. রিয়াজ আখতার মল্লিকের গবেষণায় জানা যায়, বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের হার বাড়ছে। তবে বর্ষার আগে, বর্ষায় এবং বর্ষার পরে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টিপাতই বেশি হচ্ছে। দেখা যায় হঠাৎ নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় সাময়িক ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আবার অনেক এলাকায় অনাবৃষ্টি। বৃষ্টিপাতে অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
দিনাজপুরকে বলা হয় লিচুর রাজ্য। করোণাকে জয় করা কৃষকেরা হার মেনেছে প্রকৃতির কাছে। লিচুর জন্য প্রসিদ্ধ দিনাজপুরে এবার লিচু নেই। বৃষ্টিহীন আকাশের সূর্যতাপ সবকিছুকে যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এই অঞ্চলে মূলত ৫টি জাতের মধ্যে সর্বোচ্চ ফলন হওয়া বোম্বাই জাতের লিচু’র ফলন এবার একেবারেই নেই। দামে সহনীয় এই লিচু মূলত রসালো পিপাসুদের স্বাদ পূরণে অবদান রাখতো। এখন আছে বেদেনা ও চায়না থ্রি। গত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত একেবারেই বৃষ্টিপাত হয়নি বলে জানিয়েছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। চলতি এপ্রিল মাসে মাত্র ২২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা গত মৌসুমের তুলনায় অনেক কম। এদিকে শীতকাল বিদায়ের পরপরই ফেব্রæয়ারী মাস থেকে সূর্যতাপ বেড়ে যায়। বর্তমানে দিনাজপুর অঞ্চলে ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করছে। একদিকে বৃষ্টি না হওয়া অপরদিকে মুকুল থেকে দানা সৃষ্টির মুহুর্তে প্রচন্ড রৌদ্রতাপ লিচু’র ফলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রচন্ড তাপদাহে দানা হওয়ার আগেই ঝড়ে পড়ে মুকুল।

দিনাজপুর সদর বিরল বীরগঞ্জ মূলত লিচুর জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। এসব এলাকায় একরের পর একর জমির উপর দাড়িয়ে আছে শত শত গাছ। এছাড়াও অন্যান্য উপজেলাতেও লিচুর আবাদ বেড়েছে অনেকাংশে। বিরলের মাধবপুর, কাজিপাড়া এলাকার একাধিক বাগান ঘুরে দেখা গেল কৃষক ও ফড়েয়াদের মধ্যে হাহাকার অবস্থা। দিনাজপুর অঞ্চলে বাগান কৃষকের ফল ফড়েয়াদের বলে একটি প্রবাদ রয়েছে। এর কারণ হলো ফড়েয়ারা বাগান ও গাছ দেখে ২ থেকে ৩ বছরের জন্য পূরো ফল কিনে নেয়। অর্থাৎ বাগান ও গাছ কৃষকের থাকলেও তিন বছর ফলন যা হবে তা পাবে ফড়েয়া। ফড়েয়ারা সাধারণত মৌসুমের শুরুতে গাছের পরিচর্যা এবং দানা মোটাতাজাকরণের ভিটামিন ও বিষ প্রয়োগ সবই করে থাকে। কিন্তু এবারের ফলন দেখে মাথায় হাত পড়েছে ফড়েয়াদের। পাশাপাশি অনেক কৃষক যারা নিজেরাই বাগান পরিচর্যা করে নিজেরাই লিচু বাজারজাত করে থাকে তাদের অবস্থাও আরো খারাপ। মৌসুমী এই ফল বিক্রি করে কৃষকের বাৎসরিক খরচের খাতা পূরণ করা হয়ে থাকে। আলাপ হলো সূদুর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা আহেমেদুল্লার সাথে। দীর্ঘদিন ধরেই লিচুর বাগান কিনে ব্যবসা করে আসছিল। বিরলের একটি বাগান তিন বছরের চুক্তিতে কিনেছে সোয়া ৫ লক্ষ টাকায়। প্রথম বছর কিছু টাকা পেয়েছে। আশা ছিল দ্বিতীয় বছর লগ্নিকৃত অর্থ উঠে আসবে এবং তৃতীয় বছর পূরোটাই লাভের মধ্যে থাকবে। কিন্তু গত বছরের করোণা সব শেষ করে দিয়েছে। এবার তার আসা যাওয়া ও থাকার খরচই উঠবে না বলে আশংকা প্রকাশ করেছে। এভাবেই কৃষকের পাশাপাশি ফড়েয়াদের মাথায় হাত পড়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (8)
Md Farhad Alam ২১ এপ্রিল, ২০২১, ১:৫১ এএম says : 0
আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা আল্লাহর গজব
Total Reply(0)
রুহান ২১ এপ্রিল, ২০২১, ২:০৮ এএম says : 0
আমাদের উচিত আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থণা করা
Total Reply(0)
সফিক আহমেদ ২১ এপ্রিল, ২০২১, ২:০৯ এএম says : 0
হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে রক্ষা করো
Total Reply(0)
রফিক ২১ এপ্রিল, ২০২১, ২:০৯ এএম says : 0
দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি-খরার কবলে দেশ
Total Reply(0)
নিয়ামুল ২১ এপ্রিল, ২০২১, ২:১০ এএম says : 0
এ অবস্থায় আপামর মানুষ রহমতের বৃষ্টির আকুল প্রার্থনায় চাতক পাখির মতো আকাশপানে তাকিয়ে।
Total Reply(0)
হুমায়ূন কবির ২১ এপ্রিল, ২০২১, ২:১১ এএম says : 0
একমাত্র আল্লাহ-ই পাবে এমাদেরকে এই অবস্থা থেকে বাঁচাতে
Total Reply(0)
Moniru Zamman ২১ এপ্রিল, ২০২১, ৬:৪০ এএম says : 0
এটা আল্লাহর গজব এটা আল্লাহর গজব।
Total Reply(0)
asif ২১ এপ্রিল, ২০২১, ৮:৪৬ এএম says : 0
Eer pachone bharat er haat acche mone hoy
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন