অধিকার বঞ্চিত ও নির্যাতিত শ্রমিকগণ ১৩৫ বছর পূর্বে থেকে নিজেদের অধিকারের জন্য আন্দোলন শুরু করলেও মানবতা ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম তার প্রায় সাড়ে বারশত বছর পূর্বেই তাদের অধিকারের কথা বলেছে। ইসলাম শ্রমের মর্যাদা, শ্রমিকের অধিকার ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছে। ইসলামের এত্ত্ব্বেত্ত্ব্ব্বে অনুসরণ করত, তাহলে আজকের দিনে বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমিককে তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হতো না। ইসলাম বৈরাগ্যবাদী সেজে কর্মবিমুখ হওয়াকে পছন্দ করে না। বরং কর্মের প্রতি উৎসাহিত করে। এইজন্য নামায সমাপণের পরপরই জমিনে আল্লাহর নেয়ামত তালাশের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘অতঃপর তোমরা নামায শেষ করে পৃথিবীতে আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণে ছড়িয়ে পড় এবং বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ [সূরা জুমু’আ: ১০]। আর আদম (আ.) থেকে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (দ.) পর্যন্ত প্রায় প্রত্যেক নবীই (আ.) নিজের শ্রমব্যয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। প্রিয় নবী (দ.) নিজের শ্রম ব্যয় করে উপার্জনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ‘কোন ব্যক্তি তা থেকে উত্তম আহার করেনি, যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে আহার করেছে। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে আহার করতেন।’ [সহীহ বুখারী: ২০৭২]।
ইসলাম যেমনিভাবে শ্রমের গুরুত্ব বর্ণনা করে শ্রমব্যয়ে উপার্জনের দিকনির্দেশনা দিয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে শ্রমিকের অধিকারকেও অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা শ্রমিককে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু ইনসাফভিত্তিক ধর্ম ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। উদাহরণস্বরূপ: ইসলাম শ্রমিককে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তার নিজের সামর্থ্য ও চাহিদা অনুযায়ী পেশা নির্ধারণের অধিকার দিয়েছে। বর্তমান সমাজে কিছু কিছু পেশাকে খুবই খাটো করে দেখা হয় এবং অনেক সময় শ্রমিকের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার উপর অনেক কিছু চাপিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ইসলামে এই ধরনের কোনো শ্রেণিবৈষম্য নেই। বরং প্রত্যেককে নিজের চাহিদা অনুযায়ী পেশা নির্ধারণের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে ইসলাম শ্রমিককে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক যথাসময়ে পাওয়ার অধিকার দিয়েছে এবং পরিশ্রমের কারণে তার শরীর থেকে বের হওয়া ঘাম শুকানোর পূর্বেই কোনো ধরনের গড়িমসি না করে চুক্তি অনুযায়ী তার পারিশ্রমিক দিয়ে দেয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তুমি তাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ [সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী: ১১৬৫৪]। আর যে মালিক শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে তার থেকে পূর্ণ কাজ আদায় করে তার পারিশ্রমিক দেয় না, কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তার প্রতিপক্ষ হবেন। হাদীসে কুদসীতে এসেছে, প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: মহান আল্লাহ বলেন: ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণির লোকের প্রতিপক্ষ হব, এক. যে ব্যক্তি আমার নামে কথা বিশ্বাসঘাতকতা করল। দুই. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন লোককে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষন করল এবং তিন. যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পূর্ণ কাজ বুঝে নিল; কিন্তু তার ন্যায্য পারিশ্রমিক প্রদান করল না।’ [সহীহ বুখারী: ২২৭০]
শ্রমিকের কাছ থেকে যথাযথভাবে কাজ আদায় করে তার সঠিক পারিশ্রমিক না দিয়ে তাকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা অন্যায় ও অপরাধ। ঠিক তেমনিভাবে তার সাথে চুক্তির অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয়া কিংবা তাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়াও সমান অপরাধ। শ্রমিকের সাথে এমন অন্যায় অচরণ না করার জন্য ইসলাম মালিককে সাবধান করেছে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তারা (শ্রমিক বা অধিনস্থ) তোমাদের ভাই। অতএব, তাদের সাথে ভালো আচরণ কর। যে কাজ তোমরা একা করতে অক্ষম, তাতে তাদের সাহায্য নাও। আর যে কাজ তারা একা করতে অক্ষম, তাতে তোমরাও তাদেরকে সাহায্য কর।’ [মুসনাদ অহমাদ: ২০৫৮১]
শ্রমিকের সাথে সদয় আচরণ করা ও তাদের থেকে বোঝা হালকা করা শুধু তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা নয়; বরং এটা একটি পুণ্য কাজও বটে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তোমরা তোমাদের অধিনস্থ কর্মচারীদের থেকে যতটা হালকা কাজ নেবে, তোমাদের আমলনামায় ততটা পুণ্য লিপিবদ্ধ করা হবে।’ [শুয়াবুল ঈমাণ: ৮৩৪৩]
সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিককে যে সমস্ত ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তারমধ্যে অন্যতম হলো, উৎপাদিত পণ্যে লাভের কোনো অংশিদারিত্বে শ্রমিককে শরীক না করা। অনেক সময় তার ন্যায্য পাওনা পরিশোধেও বিভিন্ন টালবাহানা করা হয়। কিন্তু ইসলাম শ্রমিককে তার উৎপাদিত পণ্যের মুনাফায় শরীক করে। পবিত্র কুরআ’নুল কারীমে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন: ‘বিত্তবানদের সম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ [সূরা যারিয়াত: ১৯]। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘শ্রমিকদের তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ থেকেও অংশ দাও।’ [মুসনাদ আহমাদ: ৮২৫০] এভাবে ইসলাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে, যা অনুকরণ করলে শ্রমিকরা সকল ক্ষেত্রে তাদের অধিকার ভোগ করতে পারবে।
বর্তমানে প্রচলিত মানবগঠিত শ্রম আইনে মালিক-শ্রমিক সম্পর্ককে মালিক-দাসের সম্পর্কের সমতুল্য করে রাখা হয়েছে! অথচ, ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম মালিক-শ্রমিক সম্পর্ককে উভয়ের মধ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং মালিককে শ্রমিকের সাথে সর্বদিকে ভাইয়ের মতো আচরণের জন্য বলেছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তারা (শ্রমিক) তোমাদের ভাই। মহান আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধিনস্থ করে দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যা খাবে তাদেরকেও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তা পরিধান করাবে। আর তাদের উপর সামর্থ্যরে বাইরে কিছু চাপিয়ে দিও না। আর যদি দাও, তাহলে তোমরা তাদেরকে সহযোগিতা করবে।’ [সহীহ বুখারী: ৩০ ও ২৫৪৫]
প্রিয় নবী (দ.) অধিনস্থ ও শ্রমিকদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন এবং তাদেরকে নিজ সন্তান-সন্ততির মতো স্নেহ করতে বলেছেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘অধিনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ এবং আরো বলেছেন: ‘তোমরা তাদেরকে তোমাদের সন্তান-সন্ততির ন্যায় স্নেহ করবে।’ [সুনানু ইবনে মাজাহ: ৩৬৯১]
ইসলাম মালিককে যেভাবে শ্রমিকের সাথে সবদিক থেকে নিজের আপজনদের ন্যায় আচরণ করতে বলেছেন, ঠিক একইভাবে শ্রমিককেও মালিক কর্তৃক তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনেও সজাগ থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে এবং তার সামর্থ্য অনুযায়ী তা আদায় করতে বলেছে। পবিত্র কুরআ’নুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে, মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক থেকে শক্তিশালী ও আমানতদার।’ [সূরা কাসাস: ২৬]। আর শ্রমিককে মনে রাখতে হবে যে, কোন গড়িমসি ছাড়া তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সে মালিকের নিকট ওয়াদাবদ্ধ। সুতারাং তাকে ওয়াদা পরিপালনে একনিষ্ঠ হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘তোমরা ওয়াদা পূর্ণ করো! অবশ্যই তোমাদেরকে ওয়াদা সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে।’ [সূরা ইসরা: ৩৪]। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্য কেউ যখন দৃঢ়তার সাথে কোনো কাজ করে, তখন মহান আল্লাহ তাকে পছন্দ করেন।’ [শুয়াবুল ঈমান লিল বায়হাকী: ৪৯২৯]
শ্রমিকদের কল্যাণ ও অধিকার আদায়ে যুগে যুগে যত আইন রচিত হয়েছে, তা তাদের প্রকৃত কল্যাণ ও অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত করতে পারেনি। চৌদ্দশত বছর পূর্বে ঘোষিত ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকদের সত্যিকারের কল্যাণ এবং মালিক-শ্রমিকে ভ্রাতৃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, কিং আব্দুলআজীজ বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দা, সৌদি আরব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন