শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুন্দরবনে বার বার আগুন কেন

| প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

গত তিনমাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মত বড় ধরণের অগ্নিকান্ডের শিকার হল সুন্দরবন। ফেব্রুয়ারিতে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে আগুন লেগে বনের ৩ একরের বেশি এলাকা পুড়ে বিরান হয়ে যায়। সে সময়ে আগুন লাগার ঘটনাকে নাশকতা বলেই দাবি করা হয়েছিল। যথারীতি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তবে তদন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। তিনমাসের মাথায় গত সোমবার সুন্দরবনের শরনখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লেগে প্রায় ৫ একর বনভ‚মি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। বিশ্ব ঐতিহ্য ও বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন নানা কারণে বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বাংলাদেশের নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সুন্দরবনের নিরাপত্তার চেয়ে এ বনভূমিকে ঘিরে অপরিনামদর্শী স্বার্থপরতা ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমই প্রকটভাবে ফুটে উঠছে। গত দুই দশক ধরে সুন্দরবনের সন্নিহিত এলাকায় বড় বড় শিল্পকারখানার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরই পথ ধরে সুন্দরবনের নদী, খাল ও চ্যানেলগুলোতে বাণিজ্যিক জাহাজ, ট্যাঙ্কার চলাচল বহুগুণ বেড়ে গেছে। এসব জাহাজের জ্বালানি, উচ্ছিষ্ট, ধোঁয়া ও শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে সুন্দরবন। সেই সাথে ফসিল জ্বালানি ও রাসায়নিক পণ্যবোঝাই জাহাজ ডুবির কারণেও সুন্দরবনের উপর বিপর্যয় নেমে আসতে দেখা গেছে। ২০১৪ সালে শেলা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ডুবে বনের শত শত কিলোমিটার এলাকায় পরিবেশগত বিপর্যয় নেমে আসার ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কিছুদিন বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকলেও সুন্দরবনের নদী , খাল ও চ্যানেলগুলোতে এখন বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল উন্মুক্ত ও অবারিত হওয়ায় সুন্দরবনের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও নিরাপত্তা ক্রমেই অবনত হয়ে পড়ছে।

গত দুই দশকে সুন্দরবনে অন্তত ২৩টি বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উঠে এসেছে। এসব অগ্নিকান্ডে কমপক্ষে ৭১ একর বনভ‚মি বিলোপ হয়েছে। জলাভূমি বেষ্টিত ম্যানগ্রোভ বনভ‚মি হওয়ায় সুন্দরবনের মত বনে স্বাভাবিক আবহাওয়ায় বড় অগ্নিকান্ড ঘটনার কোনো কারণ নেই। এসব অগ্নিকান্ডের বেশিরভাগই মানব সৃষ্ট বা ইচ্ছাকৃত নাশকতা বলে অনুমান করা যায়। গত সোমবার সকালে শরনখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি টহল ফাঁড়ির কাছে বনের ভেতর ধোঁয়ার কুন্ডুলি দেখে বনবিভাগের সাথে শত শত গ্রামবাসি অগ্নিনির্বাপণের কাজে যোগ দেয়। স্থানীয় তিনটি ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটের চেষ্টায় ২৯ ঘন্টা পর আগুন নেভানো সম্ভব হয়। অবশ্য এ জন্য মঙ্গলবারের হঠাৎ একপশলা বৃষ্টিপাত বিশেষ ভ‚মিকা রাখে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এবারো যথারীতি আগুন লাগার কারণ উদঘাটন ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য বনবিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। অতীতে প্রায় সবগুলো বড় অগ্নিকান্ডের পরেও একই রকম তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছিল। সে সব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও সুপারিশ যে কোনো কাজে আসেনি, তিন মাসের মধ্যে দুইবার রহস্যজনক বড় অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার মধ্য দিয়েই তা প্রমানিত হয়।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লোকালয় থেকে দু’এক কিলোমিটারের মধ্যে সুন্দরবনের অগ্নিকান্ডের ঘটনাগুলো ঘটেছে। গত সোমবারের অগ্নিকান্ডটি ছিল গহীন বনের চার কিলোমিটার ভেতরে। একশ্রেণীর জেলে মাছ ধরার সুবিধার্থে জায়গা খালি করার জন্য বনে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ থেকে জানা যায়। বনের কাঠ চুরি ও জায়গা দখলের উদ্দেশ্যেও বনে নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশের পরিবেশগত ও ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম। সাম্প্রতি দশকে বেশ কয়েকটি প্রলয়ঙ্করি সামুদ্রিক ঘুর্ণীঝড়ের তান্ডব প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যুহের মত ঠেকিয়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবনের মৎস্য. বনজসম্পদের সাথে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং খাদ্য নিরাপত্তার নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়াল ছাড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যত কল্পনা করা যায়না। সুন্দরবনের নিরাপত্তা মানে বাংলাদেশের নিরাপত্তা। এ নিয়ে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই। সুন্দরবনে যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত মৎস্য আহরণ, মৌয়ালসহ নানা পেশার মানুষের বিচরণ যেমন নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক একইভাবে সুন্দরবন সন্নিহিত এলাকায় ভারীশিল্পের অনুমোদন এবং বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের উপর কঠোর বিধি নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা জরুরি। গত দুই দশকে অগ্নিকান্ড, গাছচুরি ও দখলবাজিতে সুন্দরবনের যে সব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে সব এলাকায় পরিকল্পিত বৃক্ষরোপন ও সংরক্ষনের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা নিতে হবে। নাশকতা ও দখলবাজির সাথে জড়িত স্থানীয় জেলে, বনদস্যু ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে বনবিভাগের একশ্রেণীর কর্মচারি-কর্মকর্তার সংশ্রবের কথাও জানা যায়। এদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। সুন্দরবনের সুরক্ষায় ভরাট হয়ে যাওয়া নৌচ্যানেলগুলোকে খনন করা, ভাঙ্গনপ্রবণ এলাকাগুলোর ভাঙ্গণরোধ ও বৃক্ষরোপন জোরদার করার উদ্যোগ নিতে হবে। অগ্নিকান্ডসহ নাশকতা রোধ ও বনজসম্পদ রক্ষায় সুন্দরবনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে অবজারভেটরি টাওয়ার স্থাপনসহ নিরাপত্তা টহল বাড়ানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন