গতকাল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথ নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার শপথ নেয়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘আমার ছোট বোন’ বলে সম্বোধন করলেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়। এদিকে, নন্দীগ্রাম আসনের ভোট পুনর্গণনার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। কমিশন বলেছে, রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইচ্ছা করলে এটা নিয়ে নির্বাচনী মামলা করতে পারেন।
এদিকে নবান্নে বসেই মমতার নির্দেশে সরিয়ে দেয়া দল পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক স্মিতা পাণ্ডেকে। তাঁকে নিয়োগ করা হল ওয়েবেলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে। নতুন জেলাশাসক হলেন পূর্ণেন্দু মাজি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশনের সচিব পদে ছিলেন পূর্ণেন্দুবাবু। সেইসঙ্গে, পুরুলিয়ার জেলাশাসক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়কে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক হিসেবে ইতিমধ্যেই বিজেপির প্রতি বাড়তি পক্ষপাতিত্ব দেখানোর অভিযোগ উঠেছে স্মিতা পাণ্ডের বিরুদ্ধে। সেই কারণেই তাঁকে সরতে হল বল মনে করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ভোটের সময়ে যে সব জেলাশাসক, পুলিশ সুপার সহ প্রশাসন-পুলিশ আধিকারিকরা বিজেপিকে পরোক্ষে মদত দিয়েছিলেন সেই সব আধিকারিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটা হচ্ছে বলে সূত্রের খবর।
অতীতে একাধিকবার রাজ্য-রাজভবন দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে। কিন্তু তৃণমূলের জয়ের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন রাজ্যপাল। তবে কী অতীতের তিক্ততা ভুলে রাজ্য-রাজ্যপাল সম্পর্কের নতুন শুরু? এদিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শপথ গ্রহণের ঠিক পরের মুহূর্তেই রাজ্যের ভোট পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা প্রসঙ্গে বার্তা দেন রাজ্যপাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবার প্রথমে ভিত্তিহীন, ভয়ানক ভোট পরবর্তী হিংসার ঘটনা আটকাতে হবে। আমার পূর্ণ বিশ্বাস, মুখ্যমন্ত্রী, আমার ছোট বোন সহিংসতার ঘটনা কড়া হাতে দমন করবেন।’
এদিকে শপথবাক্য পাঠ করেই এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলায় শান্তি বজায় রাখুন। কেউ প্রতিহিংসাপরায়ন আচরণ করবেন না।’ এদিন মমতা বলেন, ‘এতদিন নির্বাচনের কারণে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা কমিশনের আওতায় ছিল। এবার রাজ্যে অধীনে তা আনা হবে।’ রাজ্যে সহিংসতা দমনের পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে প্রথমেই মমতার নজর কোভিড পরিস্থিতির দিকে। গতকাল রাজভবনে তিনি বলেন, ‘প্রথম কাজ হবে রাজ্যের কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা করা।’ শপথ নেয়ার পরেই রাজভবন থেকে নবান্নের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি। সেখানে তাকে কলকাতা পুলিশের তরফে গার্ড অফ অনার দেয়া হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তার নিজের আসন দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর ছেড়ে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম আসনে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এই নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ তারই মন্ত্রীসভার সাবেক সদস্য শুভেন্দু অধিকারীর কাছে হেরে যান। মমতা এই পরাজয় মেনে নিতে পারেননি। নন্দীগ্রাম আসনে মমতা ভোট পান ১ লাখ ৮ হাজার ৮০৮টি। আর শুভেন্দু পান ১ লাখ ১০ হাজার ৭৬৪টি। মমতা হেরে যান ১ হাজার ৯৫৬ ভোটে। আর এরপরই মমতা ভোটযন্ত্র বদলানোসহ ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে নন্দীগ্রাম আসনের ভোট পুনর্গণনার আবেদন জানান নির্বাচন কমিশনে।
মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেছে, নন্দীগ্রাম আসনের রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশই বহাল রাখা হয়েছে। রিটার্নিং অফিসার ওই আসনে মমতাকে পরাজিত ও শুভেন্দুকে জয়ী হওয়ার সার্টিফিকেটও দেন। এরপরই মমতা ভোট পুনর্গণনার আবেদন জানান। সেই আবেদন খারিজ করে এক নির্দেশে বলা হয়েছে, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮০ ধারায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী মামলা করতে পারেন।
এদিকে, নন্দীগ্রামের ফলাফলে ‘কারচুপির’ অভিযোগ রোববারই জানিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সোমবার আরও একধাপ এগিয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো সামনে আনলেন তার মোবাইলে আসা একটি মেসেজ। সেই মেসেজে নন্দীগ্রামের রিটার্নিং অফিসারকে খুনের হুমকি দেয়া হয়েছে। যার জেরে নন্দীগ্রামের ভোটে পুনর্গণনার সম্মতি দিতে রিটার্নিং অফিসার সাহস পাননি বলে দাবি করলেন মমতা। ফলে নন্দীগ্রামের ভোট ফলাফল নিয়ে যে অভিযোগ বিজেপির বিরুদ্ধে উঠেছে, তাতে বড়সড় হাতিয়ার হয়ে উঠল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আসা ওই মেসেজ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়াও কি সম্ভব? : বুধবার সকালে শপথ নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জী। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেই তিনি রাজনীতির ইনিংস শেষ করবেন, নাকি দিল্লিতেও তাকে একদিন প্রধানমন্ত্রীত্বের সিরিয়াস দাবিদার হিসেবে দেখা যাবে - এ প্রশ্নটা আবার নতুন করে উঠতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গ দখলে মরিয়া বিজেপিকে যেভাবে তিনি পর্যুদস্ত করে হারিয়েছেন, তাতে অনেকেই মনে করছেন আগামী সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনিই হতে পারেন যোগ্যতম মুখ।
তৃণমূল কংগ্রেসের সিনিয়র এমপি কাকলি ঘোষ দস্তিদার বলেন, তার দল মিস ব্যানার্জীকে একদিন অবশ্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে দেখতে চায়। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘মমতা একেবারে শূন্য থেকে উঠে এসেছেন শুধু নিজের দৃঢ়তা, দক্ষতা আর প্রশাসনিক সামর্থ্যরে জোরে। মোদির চ্যালেঞ্জার হয়ে ওঠার মতো সব যোগ্যতাই তার আছে - তবে বিষয়টা নিয়ে দলে এখনও আলোচনা হয়নি’। ‘কিন্তু তৃণমূলের নেত্রী একদিন যে অবশ্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, সেটা আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি’।
দিল্লিতে সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সোমা চৌধুরী আবার বলছিলেন, মমতা প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে নামতে পারবেন কি না সেটার পূর্বাভাস করা কঠিন - তবে এ মুহূর্তে ভারতে রাজনৈতিকভাবে যে ‘ফ্লুয়িড’ পরিস্থিতি চলছে তাতে সেটা হয়তো একেবারে অসম্ভবও নয়। মিস চৌধুরীর কথায়, ‘উদ্ধব ঠাকরে থেকে শুরু করে অখিলেশ যাদব - বহু বিরোধী নেতার সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক আছে। ফলে ২০২৪ নির্বাচনের আগে যদি কোনও বিজেপি-বিরোধী জোট সত্যিই গড়ে ওঠে, তাহলে সেই জোটের মুখ হিসেবে মমতা ব্যানার্জীকে দেখা যেতেই পারে’। তবে কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক নেই, এটাও সুবিদিত। কাজেই কংগ্রেস তার কাছে কতটা নতি স্বীকার করতে রাজি হয়, সেটাও দেখার বিষয়। তবে এই মুহূর্তে কোভিড মহামারি সামলাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা মমতা ব্যানার্জীর জন্য দিল্লির পথ সুগম করে তুলতে পারে বলেও সোমা চৌধুরীর ধারণা। সূত্র : বিবিসি বাংলা, বর্তমান পত্রিকা, টিওআই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন