শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

করোনাকালে দেশে দেশে কতৃত্ববাদী শাসকের প্রভাব বাড়ছে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ৭ মে, ২০২১, ১২:০৪ এএম

করোনা যেন বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর জন্য একধরনের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা যায়, তাদের জন্য ‘শাপে বর’ হয়েছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের উছিলায় তারা গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করার সুযোগ নিচ্ছে। ফলে গণতন্ত্রকামী ও মুক্তমনা মানুষের কথা বলার অধিকার সংকুচিত হয়ে পয়েছে। সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও কর্তৃত্ববাদী আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলতে বা আন্দোলন করতে গেলে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে সরকার দমন ও বিধি-নিষেধ আরোপ করছে। বিশ্বজুড়েই শাসক দলগুলোর মধ্যে এ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব দেশে কম-বেশি গণতন্ত্রকে ধারণ করে দেশ পরিচালিত হয়, সেসব দেশের শাসকরা করোনা নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে চলছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, আগে করোনামুক্ত করি, পরে গণতন্ত্রের কথা ভাবা যাবে। করোনায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাকিদে সাধারণ মানুষও এদিকে মনোযোগ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তারা জীবনযুদ্ধে পেরেশান হয়ে উঠেছে। তবে এই পরিস্থিতিতেও সচেতন শ্রেণী গণতন্ত্রের অবনমনের বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে না। তারা মনে করছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই এবং এটা চলমান, তেমনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধরে রাখাও শাসক শ্রেণীর দায়িত্ব। এটা খর্ব হওয়া উচিৎ নয়। দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রেও গণতান্ত্রিক ধারা থাকতে হবে। তা নাহলে, সাধারণ মানুষ মৌলিক অধিকার হারিয়ে বৈষম্যের শিকার হবে। গণতন্ত্র সংকুচিত হলে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। গত বছর ১৪ মে করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে এককালীন আড়াই হাজার টাকা করে দেয়ার জন্য ১২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সরকার। এর মধ্যে ৩৬ লাখ ৭ হাজার ৮৭২ পরিবারকে টাকা দেয়া হয়। বিতরণ করা হয় ৮১১ কোটি টাকা। বাকি ৪৩৯ কোটি টাকা রয়ে যায়। দরিদ্র পরিবারের তালিকায় সচ্ছল মানুষও ঢুকে পড়ে। তথ্যটুকু উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের সমঅধিকারের যে কথা বলা হয়েছে, তা এখানে সংরক্ষিত হয়নি। এ নিয়ে বিতরণকারী সরকারি মন্ত্রণালয় ও সংস্থারও কোনো জবাবদিহি করতে হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল্যবোধ বজায় থাকলে প্রকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর প্রত্যেকে বরাদ্দকৃত অর্থ সমানভাবে পেত। সরকারেরও গণতান্ত্রিক আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতো।

দুই.
আমাদের দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, এ নিয়ে মানুষের খেয়াল করার সময় এখন নেই। তাদের মধ্যে এ দুঃশ্চিন্তা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘কিভাবে বাঁচব’। একদিকে করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ, আরেক দিকে কোনো রকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকার পেরেশানি। করোনার চেয়েও তাদের কাছে বেশি আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে পারবে কিনা। তাদের কাছে এখন করোনায় মরার চেয়ে না খেয়ে মরার আতঙ্ক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। তারা এখন দুধারি তলোয়ারের মধ্যে রয়েছে। সরকারের লকডাউন ও বিধিনিষেধ তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব উপেক্ষা করেই তারা উপার্জনে নেমে পড়ে। এর মধ্যে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে ভাবার কোনো ধরনের সুযোগ তাদের নেই। সরকারেরও পুরো মনোযোগ করোনা নিয়ন্ত্রণের দিকে। ভারতের সাথে টিকা চুক্তি করে তা না পেয়ে সরকারের মধ্যে একধরনের অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর মাঝেই করোনাকালে বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা কি, তা নিয়ে সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভেরাইটিজ অফ ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম) এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দেশে দেশে গণতন্ত্রের আকাল চলছে। বিশ্বজুড়ে স্বেচ্ছাচারী শাসনের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারি সামাল দেয়ার কথা বলে অনেক দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোর ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। উদার গণতান্ত্রিক সূচক ধরে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি জরিপ চালায়। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৪। প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশের অবনমন হয়েছে। শাসনতান্ত্রিক দিক থেকে বাংলাদেশ আছে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ বিভাগে। এর অর্থ হলো, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অপসৃয়মান। গণতন্ত্রের জায়গায় ধীরে ধীরে স্থান করে নিচ্ছে স্বেচ্ছাচারী শাসন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতও নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র থেকে নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্রের দিকে ধাবিত। বিগত দশ বছরে দেশটি ক্রমাগতভাবে গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্রের দিকে হাঁটছে এবং সেখানে সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকসমাজের স্বাধীনতা প্রচন্ডভাবে সংকুচিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার সঙ্গে এই অবনমনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের সূচকে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে আছে ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। এ থেকে বুঝা যায়, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল, এখন তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান সরকারের এক যুগের শাসনামলেই গণতন্ত্রের এই উঠা-নামা হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্র মজবুত হওয়ার পরিবর্তে ভঙ্গুর অবস্থায় রয়ে গেছে এবং দিন দিন তা ক্ষয়িষ্ণুর পথে। এক্ষেত্রে ভারতের সাথে অনেকটা মিল রয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা আর যাই হোক, ভারতের গণতন্ত্র বিশ্ব স্বীকৃত। এই বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একনায়কতান্ত্রিকতার দিকে ধাবিত, তখন প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের শাসক শ্রেণীর মধ্যেও তার প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এজন্য তারা অজুহাত হিসেবে ভারতকে দেখিয়ে বলতে পারে, সেখানে যখন গণতন্ত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে, তখন আমাদের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে তা ক্ষুদ্রত্ব লাভ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের অজুহাত একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবেরই পরিচায়ক। কারণ, গণতন্ত্র কখনো ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বা বড়-ছোট আয়তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। গণতন্ত্র পরিবার ও সমাজ থেকেই বিস্তৃতি লাভ করে। এ কথা অনস্বীকার্য, গণতন্ত্র কোনো আবশ্যিক বিষয় নয়। এটা একটা নিয়ম বা নীতি। কেউ গ্রহণ করতে পারে, কেউ না-ও করতে পারে। পৃথিবীতে বহু রাষ্ট্র রয়েছে যেখানে গণতন্ত্র গ্রহণ করা হয়নি। তবে যে নীতিতে জনগণের সম্পৃক্ততা এবং তাদের মতামতের মূল্য থাকে তা সার্বজনীন রূপ লাভ করে। মানুষ তা গ্রহণ করে। দেশ পরিচালনার জন্য কোনো না কোনো নীতি অবলম্বন করতেই হয়। সেটা রাজতন্ত্র হোক কিংবা অন্যতন্ত্র হোক। এছাড়া দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। গণতন্ত্র প্রবর্তনের আগে হাজার হাজার বছর ধরে রাষ্ট্র ও সরকার বিভিন্নভাবে পরিচালিত হয়েছে। বিশ্বে গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসেবে গণ্য করা হয় গ্রীসের এথেন্স নগরীকে। এ নগরীতেই খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ শতকের মাঝামাঝি গণতন্ত্রের সূচনা হয়। একে এথেনিয়ান গণতন্ত্র বলা হয়। গ্রীক দার্শনিক ক্লিসথেনিস প্রথম গণতন্ত্রের ধারণার সূচনা করেন। সে সময় এথেন্স শাসন করতো এলিট বা অভিজাত শ্রেণী। তাদের কথাই চূড়ান্ত এবং তা জনসাধারণকে মানতে হতো। জনসাধারণের মতামতের কোনো মূল্য ছিল না। তাদের দাস হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ক্লিসথেনিস এই দাসত্ব থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য গণতন্ত্রের সূচনা করেন, যেখানে জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। তার এই ধারণা এলিট শ্রেণী গ্রহণ করে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা হয়। সেই থেকে গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী একটি সাম্য ও জনসাধারণের অধিকারের নীতি হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ড. বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন যখন দেশটির সংবিধান রচনা করেন, তখন এক মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হে ডক্টর! আমরা কি পেতে যাচ্ছি, গণতন্ত্র নাকি রাজতন্ত্র। জবাবে ফ্র্যাঙ্কলিন বলেছিলেন, গণতন্ত্র, যদি তোমরা তা রক্ষা করতে পার।

তিন.
আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম ভিত্তি ছিল গণতন্ত্র। গণতন্ত্র, সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচারের লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। দেশের মানুষ এই নীতি আঁকড়ে ধরেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তার ফলও হাতেনাতে পাওয়া যায়। আমাদের সংবিধানও রচিত হয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতির ওপর ভিত্তি করে। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সরকার অন্যকোনো নীতি অবলম্বন করতে পারত। সেটা হোক সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্র। যেহেতু দেশের জনগণ গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপসহীন ছিল এবং সরকারও তার পক্ষে, তাই দেশের শাসন ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্রকেই বেছে নেয়া হয়। তবে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে চলার পর থেকে গণতান্ত্রিক এই শাসন ব্যবস্থা নানাভাবে হোঁচট খেতে শুরু করে। গণতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্রে পরিণত করার নজিরও স্থাপিত হয়। দেশের মানুষের মনে গণতন্ত্র গভীরভাবে স্থান করে নেয়ায় অন্যকোনো শাসন ব্যবস্থা তারা মেনে নিতে পারেনি। পারেনি বলে গণতন্ত্রের জন্য তাদের দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামও করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াইটি হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। তার শাসনকালকে স্বৈর শাসন আখ্যা দিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলন করে। এ সময়ে অনেককে আত্মাহুতিও দিতে হয়েছে। অবশেষে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। মৃত গণতন্ত্র যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এক-এগারোর সরকার গঠিত হওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র আবারও হোঁচট খায়। এই সরকারের বিরুদ্ধেও সব রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। অবশেষে দুই বছর মেয়াদি এই সরকার জনগণের রায় পেতে নির্বাচন দেয়। তাতে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে ক্ষমতাসীন হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের মানুষ ধরে নেয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করবে এবং তা কখনো ব্যাহত হবে না। তবে তাদের এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক হয়নি। কারণ, এ সরকারের বিরুদ্ধেও বিশ্বের বিভিন্ন খ্যাতিমান সংস্থার জরিপে গণতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়া, কর্তৃত্ববাদী হওয়া এবং হাইব্রিড গণতন্ত্র বজায় রাখার অভিযোগ উঠে। সর্বশেষ ভি-ডেম-এর জরিপে তা প্রকাশিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শাসন ব্যবস্থা কেমন হলে একটি দেশে গণতন্ত্র আছে কি নেই, তা বোঝা যাবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, কোনো শাসন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক হতে হলে সাতটি শর্ত থাকতে হবে। এগুলো হচ্ছে: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সার্বজনীন ভোটাধিকার, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রার্থী হওয়ার অধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যের বিকল্প উৎস এবং সংগঠন তৈরির স্বাধীনতা। এই সাতটি শর্ত আমাদের শাসন ব্যবস্থায় এখন আছে কিনা, তা চিন্তাশীল পাঠক ভাল বলতে পারবেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটনের মতে, একটি দেশের গণতন্ত্র স্থায়ী রূপ নিয়েছে কিনা, তা বোঝা যায় গণতন্ত্র উত্তরণের পথে পরপর দুটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে কিনা, যাতে ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশের গণতন্ত্র মূলত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। যাকে বলা হয়, নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্র। আমাদের গণতন্ত্রের এই মূলমন্ত্র বিগত এক যুগের নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে কিনা কিংবা পরপর দুটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও জনগণের অংশগ্রহণে স্বতঃস্ফূর্ত হয়েছে কিনা, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। ভি-ডেম-এর প্রতিবেদনে আমাদের শাসন ব্যবস্থাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে, ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বেচ্ছাতন্ত্র’ হিসেবে। নির্বাচন হয়েছে ঠিকই তবে তা স্বেচ্ছাচারিতার মধ্য দিয়ে হয়েছে। এখন করোনার এই সময়ে গণতন্ত্রের কি অবস্থা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বলা যায়, গণতন্ত্রের খোলস আছে, তার ভেতরের উপাদান নেই। গণতন্ত্রকে করোনার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই গণতন্ত্র এখন নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে আছে। করোনার উছিলায় শাসক শ্রেণী গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। করোনা তাদের জন্য পৌষ মাস হয়ে আছে। অন্যদিকে, জনসাধারণকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ‘কিভাবে জীবন বাঁচবে’ এই চিন্তার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।

চার.
আজ হোক, কাল হোক করোনা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। এর সাথে খাপ খাইয়েই জীবন চলবে। শাসন ব্যবস্থাও চলবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে পর্যন্ত গণতন্ত্র সুষ্ঠু অবস্থায় থাকবে কিনা। এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে যেসব দেশ রয়েছে এবং শাসকরা তা উপেক্ষা করে চললেও নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে নির্বাচন দিতেই হবে। সেসব নির্বাচনেই বোঝা যাবে, দেশগুলোর গণতন্ত্র কতটা শক্ত অবস্থানে রয়েছে। করোনা থাকুক বা না থাকুক, আমাদের দেশেও আড়াই বছর পর জাতীয় নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচন কেমন হবে তার ওপর নির্ভর করছে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। বিগত সময়ের নির্বাচনগুলো কেমন হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। যদি ঐ রকম নির্বাচন হয়, তবে বলতে হবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং তার অস্তিত্ব বিলোপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো দেশেই মনুষ্যসৃষ্ট হোক কিংবা প্রকৃতিসৃষ্ট হোক, কোনো না কোনো দুর্যোগ ঘটেই থাকে। এগুলো মোকাবেলা করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হয়। এক্ষেত্রে, দেশ পরিচালনার মূলনীতি অক্ষুন্ন রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়েই অগ্রসর হতে হয়। যদি তা না থাকে তবে, সে দেশের অস্তিত্ব ও পরিচয় সংকট গভীর হয়ে ওঠে। ফলে করোনা বা অন্য যেকোনো দুর্যোগের উছিলায় গণতান্ত্রিক পথ ব্যাহত করলে এক সময় তার চলার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। সামনে যাওয়ার পথ থাকবে না।
darpan.journalist@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ৮ মে, ২০২১, ১:৩০ পিএম says : 0
Human being cannot legislate his own Law Allah created human being with very little knowledge as such it absolutely to legislate a Law. Like we manufacture car, car cannot write it's own manual. Allah legislated a Law for human being [Qur'am] if our country ruled by Qur'an then all basic need would be fulfilled by the government. But our country is ruled by man made law as such government can do any things as they like as such they have destroyed our country and and also they destroyed our moral character.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন