শিশু বয়সের বিবাহের কারণে ছেলে-মেয়েদের জীবনের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করা গেছে, সেজন্য বর্তমান সমাজ-মানসে যুক্তিসঙ্গতভাবেই এর প্রতি প্রতিরোধ জেগে উঠেছে। এ কাজকে আজ অনেকে ভাল এবং সমর্থনযোগ্য মনে করতে পারছে না। তাই বলে বিবাহের একটা নির্দিষ্ট বয়স ধার্য করা এবং তার পূর্বে বিয়ে অনুষ্ঠানকে আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ করে দেয়া; এমনকি যদি কেউ তা করে সংশ্লিষ্ট আইন ভঙ্গকারী ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে জেল-জরিমানার দন্ডে দন্ডিত করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। মানবীয় নৈতিকতার দৃষ্টিতেও এ কাজ সমীচীন নয়। তবে ধর্মীয় নৈতিক মানের অবক্ষয়ের সাথে এবং অন্যান্য পার্শ্ববর্তী সমাজের প্রভাবে মুসলিম সমাজেও বাল্য বিবাহ এমনকি অসম বিবাহ অর্থাৎ, অল্প বয়সের মেয়েকে বুড়ো বয়সের পুরুষের সাথে বিবাহ দেয়ার এবং বিবাহ করার প্রবণতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফলে সমাজে এর বিরূপ প্রভাব এতই বেড়ে যাচ্ছে যে, সমাজের সুস্থতা এবং শিশুমাতা ও তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার তাগিদে আইনের সাহায্যে এ কাজকে নিরুৎসাহিত করার দাবি রাখে।
অনুসিদ্ধান্ত : উক্ত আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, জাতিসংঘ প্রদত্ত শিশুর সংজ্ঞা বলতে এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন শিশু আইনের দৃষ্টিতে যা নির্ধারণ করা হয়েছে তা একেবারে অযৌক্তিক নয়। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে শরীয়তের মুকাল্লাফ- দায়িত্বশীল হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ছেলে-মেয়েকে শিশু বলা যাবে। মোট কথা যার ওপর শরীয়তের বাধ্যবাধকতা নেই সেই শিশু।
রাষ্ট্রীয় বিধানে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রয়োজনে এবং সমাজের বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য এবং শিশু নির্যাতন বন্ধের জন্য যে আইন করা হয়েছে তা সে ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে বাধা নেই; যদি তা ঐ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ও কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। শরীয়তের বিধি-বিধান পালনের ক্ষেত্রে সংশিষ্ট শিশু আইনের সংজ্ঞা বাধ না সাধলে তাতে কোনো ক্ষতি নেই। অতএব স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শিশুর বয়সসীমা নির্ধারণকারী একক কোনো আইনের অস্তিত্ব না থাকায় কেউ শিশু কিনা তা নির্ধারণ করতে হলে সংশ্লিষ্ট আইনের নিরিখেই নির্ধারণ করতে হবে।
ইসলামী নীতি দর্শনে শিশুর অবস্থান ও মর্যাদা ঃ আজকের শিশু মানবতার ভবিষ্যৎ, জাতির আগামী দিনের স্থপতি। সুন্দর ও সভ্য জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন এমন সুন্দর পরিবেশ যেখানে জাতির ভবিষ্যৎ স্থপতিগণ সকল সম্ভাবনাসহ সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাধীন মর্যাদা নিয়ে শারীরিক ও মানসিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামাজিকভাবে পূর্ণ বিকাশ লাভ করতে পারে। আল্লাহ তা’আলা মানব জাতিকে অগণিত নিয়ামত দান করেছেন। এসব নিয়ামতের মধ্যে শিশু-সন্তান অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- ‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের নিজস্ব প্রজাতি থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের সে জুড়ি থেকে তোমাদের জন্য সন্তান-সন্ততি ও পৌত্র-পৌত্রী সৃষ্টি করেছেন। আর তোমাদের দিয়েছেন উত্তম জীবনোপকরণ। তবুও কি তারা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং তারা কি আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে? ‘‘আল-কুরআন, ১৬:৭২।’’
একজন নারী এবং পুরুষের বৈধ দাম্পত্য জীবনের আবেগ উচ্ছাসপূর্ণ প্রেম-ভালবাসা পরিপূর্ণতা লাভ করে মানব শিশুর মাধ্যমেই। তাই শিশু-সন্তান হচ্ছে দাম্পত্য জীবনের পুত:পবিত্র পুষ্প বিশেষ। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তান আল্লাহ তাআলার সেরা উপহার। সন্তান ঘরের শোভা, খায়ের ও বরকত এবং দীন-দুনিয়ার কল্যাণে বাহন। শিশু-সন্তান পার্থিব জীবনের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে এবং জীবনের সাহায্যকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই শিশুর মর্যাদা ও মূল্য মানবজীবনের সীমাহীন। পবিত্র কুরআনে ব্যাপারটি এভাবে বলা হয়েছে- ‘‘ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য ও সুখ-সমৃদ্ধির বাহন। ‘‘আল-কুরআন ১৮:৪৬।’’
আল্লামা আলূসী র. এর ব্যাখ্যায় বলেন- ধন-সম্পদ হচ্ছে প্রাণ বাঁচানোর উপায় আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে বংশ সুরক্ষার মাধ্যম।’’ ‘‘আলুসী, শিহাবুদ্দীন মাহমুদ ইবনে আব্দিল্লাহ আজীম ওয়াস আল-হুসাইনী: রূহুল মাআনী, বৈরূত: দারুস সাদির, তা. বি. খ. ১১. পৃ. ১২৭।’’ শিশুদের যথার্থ মর্যাদা দানের মধ্যেই নিহিত হয়েছে শিশু অধিকারের নিশ্চয়তা। এ জন্য শিশুর প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো তার সঠিক মর্যাদা ও মূল্য অনুধাবন ও নিরূপণ। শিশুর অস্তিত্বকে জীবনের মুসিবত মনে করে বিরক্ত হওয়া উচিত নয়; সন্তানকে নিজের ও মানবতার জন্য আল্লাহর রহমত ও পুরস্কার মনে করা প্রয়োজন।
শিশুর অস্তিত্বের সঠিক মুল্য দিতে না পারলে অন্যান্য অধিকার কখনই আদায় করা যাবে না অথবা অন্যান্য অধিকার আদায়ের সুযোগই পাওয়া যাবে না। কিংবা সুযোগ এলেও তার অধিকার আদায়ে সফল হওয়া যাবে না। কাজেই শিশুর সঙ্গে সঠিক আচরণের জন্য তার যথার্থ মর্যাদা অবগত হওয়া অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। পৃথিবীতে অগণিত মানুষ রয়েছে যাদের সম্পদের অভাব নেই, কিন্তু তা ভোগ করার জন্য কোন সন্তান নেই। হাজার চেষ্টা-সাধনা এবং কামনা না করেও বহু সন্তানের পিতা-মাতা, কিন্তু তাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ নেই। কাজেই কারো সন্তান হওয়া না হওয়া একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারণ হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআনের ঘোষণা- ‘‘নভোজগত ও ভূ-জগতের আধিপত্য কেবলমাত্র আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা শিশু উভয়ই। আর যাকে ইচ্ছে তাকে করে দেন বন্ধ্যা। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’’ ‘‘আল-কুরআন, ৪২:৪৯-৫০।’’
মানুষ যত বিত্ত বৈভব ও বৈষয়িক শক্তি-ক্ষমতার অধিকারীই হোক না কেন, অন্যদের সন্তান দান তো দুরের কথা তার ইচ্ছায় নিজ সন্তান জন্মদানের ক্ষমতাও তার নেই। এরপরও যদি কেই আল্লাহ ছাড়া অপর কোন মক্তি বা সত্তার সন্তান কামনা করে কিংবা তাকে সন্তানদাতা বলে বিশ্বাস করে, তার মত হতভাগ্য ও অপরিণামদর্শী আর কেউ নেই। সন্তানই দীনি কাজের সাহায্যকারী ও উত্তরাধিকারী। দীনের প্রচার-প্রসার ও সংরক্ষণের সন্তানই উত্তরসূরী। এজন্যই নবী-রসূলগণ আল্লাহর দরবারে কামনা করতেন- ‘‘হে আমার রব! তুমি তোমার নিকট থেকে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান কর। এ উত্তরাধিকার আমার ওয়ারিসও হবে এবং ইয়াকুবের পরিবারের মিরাসও পাবে। আর হে প্রভু! তাকে একজন পছন্দীয় মর্যাদাবান মানুষ বানাও।’’ ‘‘আল-কুরআন, ১৯:৫-৬।’’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন