শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক

প্রকাশের সময় : ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াকে একটি নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে যাবে। এই সামরিক চুক্তির ফলে, ভারত-আমেরিকা উভয় দেশই তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করতে পারবে। এ সামরিক চুক্তির মধ্যে দিয়ে আমেরিকা পুরোপুরি ভারত বলয়ে ঢুকে পড়ল। ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি শান্ত দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়াকে নিঃসন্দেহে অশান্ত করবে। এ চুক্তির ফলে, এরইমধ্যে চীন ও পাকিস্তান ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার ভারত সফর দুই দিন বৃদ্ধি করেছেন। তাতে প্রতীয়মান হয়, কৌশলগত কারণে আমেরিকার কাছে ভারতের গুরুত্ব এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসবই হচ্ছে উদীয়মান শক্তি চীনকে কেন্দ্র করে। চীনকে ব্যালেন্স করাই এখন আমেরিকার কাছে মূখ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে চীন যে গতিতে ও কৌশলে সামনে এগুচ্ছে, তাতে মনে হয় না আমেরিকা সুবিধা করতে পারবে। ভারত-মার্কিন সখ্যতার ফলে, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। জোরদার হতে পারে রাশিয়-চীন সম্পর্কও।
আমরা জানি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত পুরনো। ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার অবদান সবচেয়ে বেশি। ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে রাশিয়া স্বাগত জানাবে বলে মনে হয় না। বরং এই চুক্তির ফলে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে রাশিয়া নতুন করে ভাবতে পারে। চীন-পাকিস্তান ও রাশিয়াকে নিয়ে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় তৈরি হতে পারে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ। প্রশ্ন হল এখানে বাংলাদেশের ভূমিকা বা অবস্থান কী হবে? বাংলাদেশ যদি ভারত-মার্কিন লবিতে অবস্থান নেয়, তাহলে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের কী প্রভাব পড়তে পারে- সেটি অবশ্যই ভাববার বিষয়, চিন্তার বিষয়। কেননা চীন বাংলাদেশের অকৃত্রিম ও পরীক্ষিত বন্ধু।
চীন-বাংলা মৈত্রী নতুন কিছু নয়; এ সম্পর্ক প্রাচীন। দুই হাজার বছর কিংবা তারও বেশি আগের সম্পর্ক। বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল যে পথ, তার নাম রেশম পথ; যা সিল্ক রোড নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। ছিল পশ্চিমা সিল্ক রোড, যার সূচনা হয়েছিল রাজধানী সিয়ান (তৎকালীন চংগান) থেকে। সেই পথ সিনজিয়ার হয়ে আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারত হয়ে পৌঁছেছিল বাংলাদেশে (মেনজিয়ালা)। কয়েক শতাব্দী ধরে এই মেনজিয়ালাই ছিল চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেকার সম্পর্কের সেতুবন্ধ। এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অটুট ও সমুন্নত রাখতে হলে, বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ধিরস্থির ও ভেবে-চিন্তে।
চীন হচ্ছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রফতানিকারক দেশ, যার রফতানির পরিমাণ প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিগত তীব্র বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলাকালে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ চীন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের অনেক দেশকে বিরাট অর্থনৈতিক ধস থেকে উদ্ধার করেছে। ক্ষুদ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা চালু রাখতেও চীন ব্যাপক সহযোগিতা করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের কাছে ঋণী করেছে। এই ঋণ আমেরিকা এখন শুধ করছে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে। আসলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থের জন্য সবকিছুই করতে পারে। ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তির ফলে প্রতীয়মান হলো, চীন এখন পৃথিবীতে একটি বৃহৎ শক্তি, সেটি সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক-সবদিক দিয়েই।
বিশ্বে ক্রমেই চীনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে নিরবছিন্নভাবে। দেশটি বর্তমানে যেসব অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে, সেগুলো সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করে চীনের অর্থনীতি এক নতুন উচ্চতায় আরোহণ করবে। বিশ্বের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ বক্তাদের ভবিষ্যৎ বাণীকে সত্য প্রমাণিত করে চীন অচিরেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরণিত হবে।
প্রায় ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনশক্তি। চীনের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাস্টিন লিন ২০১১ সালে বলেছিলেন, ২০১০ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত চীন ২০৩০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মাথা ব্যথার কারণ। তাই নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ভারত-মার্কিন সখ্য আজ এক সামরিক চুক্তিতে পরিণত হলো।
এ সামরিক চুক্তি থেকে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ কি ভালো কিছু পাবে? মনে তো হয় না। এমনিতেই চারদিকে অস্থিরতা ও যুদ্ধ উত্তেজনা। দেশে দেশে সামাজিক সংঘাত, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, জাতি-গোষ্ঠীগত ঘৃণা ও হানাহানি। আরও রয়েছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও রোগ-ব্যাধি। শান্তি ও সম্প্রীতি এখনও দূরপরাহত, স্থিতিশীলতা বিঘিœত। সমতা ও ন্যায়বিচারের অভাব প্রকট। এসব দূরীকরণে এই সামরিক চুক্তি কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে? নাকি এসব আরও বৃদ্ধি করবে? এ প্রশ্ন তো থেকেই যায়।
চীন একটি নমনীয় দেশ, দেশটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং শান্তির পথই দেশটি অনুসরণ করে। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে চীনের ব্যাপক উত্থান ঘটেছে আগাগোড়াই শান্তিপূর্ণভাবে। তবে চীন তার সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার ব্যাপরে অত্যন্ত সজাগ। এবং সে অনুযায়ীই নিজের নৌশক্তি গড়ে তুলছে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। দেশটি নিঃসন্দেহে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে, যাতে বহির্শক্তির দ্বারা চতুর্পাশ্বের ঘেরাও হয়ে থাকতে না হয়। সম্ভাব্য যেকোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে সে যেন শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। এটা হয়তো ভারত ভালো চোখে দেখছে না। চাচ্ছে চীনের সঙ্গে পালা দিয়ে নিজের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করতে; এরই অংশ হিসেবে ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি। ভারত হয়তো ভাবছে চীন এখন কিছুটা চাপে থাকবে। কিন্তু এই সামরিক চুক্তির অবশ্যই নেতিবাচক দিক আছে, যা হয়তো ভবিষ্যতে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জন্য খারাপ ফল বয়ে আনতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশেষকরা মনে করেন।
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটান সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, যার দৃষ্টি ছিল পূর্বমুখী। সে সময়ে চেয়াম্যান মাও জে দং ও প্রধামন্ত্রী চৌ এনলাই জীবিত ছিলেন। আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু হওয়ার পর থেকে বরাবরই তা চমৎকার ছিল, ক্রমেই তা আরও নিবিড় হয়েছে এবং এই সম্পর্ক সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ এবং সামাজিক ও সাস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিন্নতা সত্ত্বেও এ দুই দেশের মধ্যকার চমৎকার কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক পরিম-লে অতি চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্পর্শ রয়েছে। আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প এবং প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও চীন আমাদের সমযোগিতা করে আসছে।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতিরক্ষা। ২০০২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার চীন সফরকালে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেটি একটি সাধারণ সামগ্রিক চুক্তি, যার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রযুক্তি স্থানান্তর, যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা প্রকল্প গ্রহণ, সামরিক প্রশিক্ষণ, যৌথ অভিযান, লজিস্টিক লাইনসমূহ উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ দমন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষেত্র। এসবের উদ্দেশ্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণ। যাতে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের রক্ষা হতে পারে।
আমাদের ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-কৌশলগত ও ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থান এমন যে, তা আঞ্চলিক কৌশলগত ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে পরিণত হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক কৌশলগত ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ এবং তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগসেতু হিসেবে অবস্থান করছে। এশিয়ার দুটি বড় দেশের মধ্যখানে বাংলাদেশের অবস্থান। এর একটি হলো উদীয়মান ভারত, যার রয়েছে আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষ। এই উচ্চাভিলাষের নমুনাই হলো ভারত-মার্কিন সামরিক চুক্তি। এই সামরিক চুক্তির পরিপেক্ষিতে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, ভারত চাইবে পূর্ব এশিয়াতে তার কর্র্তৃত্ব কায়েম করতে। আর এটি করতে গেলেই অশান্ত হবে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, এমনকি চীনের সঙ্গে একটি যুদ্ধের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়ে যেতে পারে; যা সমগ্র এশিয়াতেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। কাজেই বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ভেবে-চিন্তে এবং শত্রু-মিত্র চিনে। যাতে অটুট থাকে চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশেষক
নবষধুবঃথ১@ুধযড়ড়.পড়স

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন