শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কে ভিআইপি, কে নয়

রূপন কান্তি সেনগুপ্ত | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ভিআইপি আছেন। সুইডেনে ভিআইপি হিসাবে শুধুমাত্র দেশটির প্রধানমন্ত্রী সরকারি সুযোগ-সুবিধা পান। ইচ্ছে হলে তা ভোগ করেন। পার্লামেন্টের বেশিরভাগ সদস্য ইচ্ছে করেই পাবলিক পরিবহনে যাতায়াত করেন। ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া সরকারি কোনো গাড়ি বা চালক পান না। সূত্রমতে, ব্রিটেনে মাত্র ৮৪ জন, ফ্রান্সে ১০৯ জন, জাপানে ১২৫ জন, যুক্তরাষ্ট্রে ২৫২ জন ভিআইপি রাষ্ট্রের পক্ষ হতে বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা পান। প্রায় ১৪৪ কোটি মানুষের দেশ গণচীনে এইরকম ভিআইপি আছেন মাত্র ৪৩৫ জন। রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ প্রশাসনের সর্বোচ্চ নির্বাহীরা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকারমূলক প্রটোকল বা রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশে কতজন ভিআইপি আছেন তার কোনো তালিকা প্রশাসন কর্তৃক বা গবেষণামূলক হালনাগাদ কোনো তথ্য জনগণের জানা নেই। বাংলাদেশের মতোই ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায়ও এরকম সংস্কৃতি প্রবলভাবে রয়েছে।

সমগ্র সমাজকে ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে, বঞ্চিত করে, কিছু বাছাইকৃত মানুষের বাড়তি সুবিধার নামই ভিআইপি সংস্কৃতি। ভিআইপি মানসিকতা কার্যত উপনিবেশকালের একটা রোগ। শাসক ইংরেজদের পতন ঘটেছে বহু পূর্বেই। তবে তাদের শোষণ ও জীবনযাত্রার নানা স্মৃতিচিহ্ন, অস্তিত্ব আজও বহন করে চলেছি আমরা। ইংরেজ লাট সাহেবদের মতো বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে, হাসপাতালে, বিমানবন্দরে, ফেরিঘাটে এমনকি হোটেলের ডাইনিং রুমেও শত শত লাট সাহেব, ভিআইপি সুযোগ-সুবিধা দাবি করছে, নিচ্ছে ও পাচ্ছে। এরা সাধারণ আমজনতার সঙ্গে লাইন ধরে, জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু নিতে বা পেতে রাজি নন। এতে একটি বার্তা স্পষ্ট। আমজনতাকে তারা আনটাচেবল ভাবেন। ভিআইপি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আকুতি সমাজে এত প্রবল যে, অনেকের ব্যক্তিগত গাড়ি বিদ্যালয় ও হাসপাতালের গেইটে গিয়ে দাঁড়াবে অতঃপর ড্রাইভার দরজা খুলে দেবে এবং তথাকথিত ভিআইপি গাড়ি হতে বের হবেন। একটু আগে বা পিছনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নামলে ভিআইপি নামিক স্ট্যাটাস সিম্বলে অবনমন ঘটবে! এই দম্ভের শিকড় তাদের মননের অনেক গভীরে নীরবে কাজ করে। পাড়া-মহল্লায়ও অনেক ভিআইপি রোগে আক্রান্ত রোগী গাড়িতে অদ্ভুত ধাঁচের এক হাইড্রোলিক হর্ন লাগিয়ে চলাফেরা করেন। এ যেন ক্ষমতার এক শাব্দিক প্রকাশ। অনেক ভিআইপি আবার গাড়ির সামনে-পেছনে মোটরসাইকেল আরোহী কয়েকজনকে পাহারায় রাখেন। এসব ভিআইপির গতি নির্বিঘœ রাখতে গিয়ে আসা যাওয়ার পথে আটকা পড়ে অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা দিতে দেরি হওয়া, কর্মজীবীর সময়মত কর্মস্থলে উপস্থিত হতে না পারা, রাস্তায় রোগীর মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরানো যেন স্বাভাবিক ব্যাপার।

এসব মাঝারি মাপের ভিআইপির অনাচার নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেই শুনতে হয় ‘আমাকে চিনোস তোরা?’, ‘জানো তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?’, ‘তুমি জানো আমি কে?’, ‘তুমি জানো, আমি কী করতে পারি?’ বাংলাদেশে এগুলো খুবই পরিচিত বাক্য। কাউকে লাইনে দাঁড়াতে বললে, কাউকে ট্রাফিক আইন মানতে বললে, কারো অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, কারো জবরদখল সরাতে বললে এরকম কথা শোনা যায়। কারা এরকম কথা বলেন? যারা ক্ষমতার ভারে আক্রান্ত। এটা হতে পারেন ক্ষমতাবান ভিআইপি কেউ, হতে পারেন ক্ষমতার ছোঁয়া লাগা তাদের ভাই, ছেলে-মেয়ে, ভাতিজা, বন্ধু বা বন্ধুর ভাই কিংবা স্তাবক ও গুণমুগ্ধ চেলা-শাগরেদ। প্রশাসন, আইন, নীতি, শৃঙ্খলা- সবই তাদের ক্ষমতার অধীনে। ক্ষমতার প্রভাব দেখাতে গিয়ে এরা মানে না কোনো যুক্তি। ক্ষমতার জোরে এরা সমাজ ও আইনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান। ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে তারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। সাম্প্রতিক সময়ে ডাক্তার-প্রশাসন দ্ব›েদ্ব ক্ষমতার দম্ভ স্পষ্টভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তর্কে জেতার জন্য দুঃখজনকভাবে সেখানে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামও রাস্তায় বিক্রয় করা হলো। অহমের ফ্যাসাদ ছিল সেখানে মূল সমস্যা। কে বড়? ডাক্তার নাকি পুলিশ? আমি এই, আমার বাবা সেই, এই সবের দাম্ভিকতা মানুষের স্বতন্ত্র পরিচয়কে ম্লান করে দেয়। শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত চেতনাবোধে ন¤্রতার বদলে অন্তর্দৃষ্টিতে অহংকার প্রতিফলিত হয়েছে। মহত্বের গুণে একদিনের জন্য সাধারণ মানুষ হলে এমন কি ক্ষতি হতো!

এইতো গেল এক টাইপের ভিআইপির দাপট। অন্যদিকে উচ্চমানের ভিআইপি, যাদের ক্ষেত্রবিশেষে ভিভিআইপি বলেও অভিহিত করা হচ্ছে, তাদের সংখ্যাও আমাদের অজানা। রাজনীতিবিদদের নির্বাচিত করা হয় সঠিক ও কার্যকর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের সার্বিক নিরাপত্তা ও সুবিধা বাড়ানোর জন্য। তারা জনগণের সেবক হওয়ার কথা, ভিআইপি নয়। জনগণের করের টাকায় বেতনভোগীরা সর্বাগ্রে নন, সর্বাগ্রে থাকার কথা করদাতারা। কিন্তু কার্যত রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত সুবিধাগুলো অগ্রাধিকারমূলকভাবে পাচ্ছেন কথিত ভিআইপিরা। কোন্ সাংবিধানিক নির্দেশনার বদৌলতে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত এত ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ তৈরি হচ্ছে তা অজানা। রাষ্ট্রযন্ত্র যেন এটা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে, ভিআইপিদের সেবার জন্যই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। যেসব বিধি-নিয়ম-প্রথা সাধারণ ব্যক্তিকে ভিআইপি করে তুলেছে সেগুলো অবশ্যই আমাদের সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিছু মানুষকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে উচ্চবর্ণের মর্যাদায় অভিষিক্ত করার জন্য নিশ্চয়ই জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। এক দেশে দুই রকম মানুষের আইনগত বৈধতার মানসে নিশ্চয়ই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক এভাবে গণহারে ভিআইপি, নন-ভিআইপিতে বিভক্ত হতে পারে না। প্রজাতন্ত্রে ‘এভরি পার্সন ইজ ইম্পর্টেন্ট’ হওয়ার কথা।

ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার বাকিংহাম প্যালেস ছেড়ে সাধারণ জীবনযাপনের জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বসবাস করছেন। সেখানে তিনি রাজকীয় বিভিন্ন কর্মসূচির বাইরে স্বাধীন জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করেন। ব্রিটিশ রাজ সিংহাসনের অন্যতম উত্তরাধিকারী যুবরাণী ডায়ানার ছোট সন্তান ডিউক অফ সাসেক্স প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী ডাচেস অফ সাসেক্স মেগান বিশেষ সুরক্ষাবন্দোবস্তের জীবন ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের কাতারে চলে এসেছেন। নীল রক্তের শৌর্যের সমাপ্তি টেনে তারা স্বইচ্ছায় রাজপরিবার ত্যাগ করেন।
আমরা যারা বলি, বাংলাদেশে ভিআইপি প্রথা উপনিবেশিকতার দীর্ঘ জের। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ব্রিটিশ রাজ পরিবার এই অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসছে। তারা সাধারণের সাথে মিশে জীবনকে উপভোগ করতে চলেছে। পক্ষান্তরে আমাদের দেশের মানুষ সচেতনভাবে ভিআইপি প্রথা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু এই ভিআইপি সুবিধার ‘একটি সীমারেখা’ থাকা প্রয়োজন। সীমারেখা অনুযায়ী বাংলাদেশে ভিআইপিদের জন্য নির্ধারিত কার্যালয়, নির্ধারিত চেয়ার, তাদের গাড়িটা নির্ধারিত। তবে জনগণের ব্যবহারযোগ্য যে সুযোগ-সুবিধা যেমন- রাস্তাঘাট, ফুটপাত, ফেরিঘাট, বিমানবন্দর ভিআইপি ব্যক্তিরা দখল করে নেবেন বা বন্ধ করে দেবেন তা কোনো মানবিক আচরণ হতে পারে না। অসাধারণ হওয়ার সুবিধা পূর্ণমাত্রায় ভোগ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা তারা আমলে নেন না। তারা ইচ্ছা করলে আইন ভঙ্গ করতে পারেন, মানুষকে লাইনে দাঁড় করিয়ে যেখানে-সেখানে, যখন-তখন ঢুকে যেতে পারেন, উল্টো রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চলে যেতে পারেন। আইন তাদের ধরতে পারে না। যাদের কলমের খোঁচায় বা মুখের বাণীতে নদী হয় জমি, পাহাড় হয় সমতল, বিষাক্ত খাদ্য হয় সুষম খাদ্য, খুনি হয় সাধু, তারা যেখানেই যান না কেন প্রশাসন অন্য সব কাজ ফেলে তাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েস নিশ্চিতে ব্যস্ত থাকে।

দেশে ভিআইপি আছে, থাকবে। তাদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধাও আছে, থাকবে। কিন্তু তথাকথিত ভিআইপি দাবিদারদের ব্যাপারে রাষ্ট্র কেন জানি ঢাক ঢাক গুড় গুড় নীতি অবলম্বন করে। এরা ভিআইপি সেজে সুকৌশলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নেন, ক্ষেত্রবিশেষে জোর করে আদায় করে নেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিষ্কারভাবে বলে দিতে পারে কোন কোন মানুষগুলো ভিআইপি।
লেখক: কলামিস্ট, নিরীক্ষক ও হিসাববিদ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন