শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ঈদ উপলক্ষে একটি পত্রিকাও বকেয়া বিল পায়নি

বছরজুড়ে তথ্য-অর্থ মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালি পত্রিকার বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধে মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন নেই!

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৯ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

পবিত্র রমজান মাসের আজ ২৬তম দিন। কয়েকদিন পরেই উদযাপিত হবে- ঈদুল ফিতর। কিন্তু এবার গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক-কর্মচারীদের ‘ঈদ’ উদযাপন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমনিতেই করোনাভাইরাস নিয়ে বিপর্যয়; তারপর ঈদ উপলক্ষে এখন পর্যন্ত একটি প্রিন্ট মিডিয়াও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পায়নি। অথচ সরকারের যতই অর্থ সংকট থাকুক, প্রতিবছর ঈদের আগে মিডিয়াগুলোর বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়।

জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধের জন্য অনেক আগেই মন্ত্রণালয়গুলোতে চিঠি দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছেন। তথ্যমন্ত্রী নিজেও আন্তরিকতার সঙ্গেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী প্রিন্ট মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পাত্তাই দিচ্ছেন না। দেশের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যমের সাংবাদিক-কর্মচারীরা যেন তার কাছে ‘গুরুত্বহীন’। ঈদ উপলক্ষে বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধের লক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় চিঠি দেয়ার পরও অর্থমন্ত্রী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের গণমাধ্যমের প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশনা দেয়নি। এতে অর্থ আর তথ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুধুই চিঠি চালাচালি হচ্ছে। বকেয়া বিল পাচ্ছে না মিডিয়গুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের কাছে পাওয়া পত্রিকাসহ সকল গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের বিল পরিশোধের নির্দেশনা মানছে না মন্ত্রণালয়গুলো। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পত্রিকাগুলোর বিল পরিশোধ নিয়ে চলছে অর্থ-মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি চালাচালি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে টাকা ছাড় না করায় বিপাকে পড়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর। গতকাল শনিবার পর্যন্ত কোনো টাকা পত্রিকাগুলোর নামে বরাদ্দ দিতে পারেনি। এর আগে বেশ কয়েকজন সম্পাদক সচিবালয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের দেখা করে পুরনো বিলগুলোর জন্য দাবি জানান। এদিকে গতকাল শনিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়াকে ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সকল সচিবকে গত বছর ২৬ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব ছাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিল পরিশোধের বিষয়টি যেন মন্ত্রিপরিষদকে অবহিত করা হয়, সে বিষয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে চিঠিতে।

এদিকে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর মহাপরিচালক স. ম. গোলাম কিবরিয়া ইনকিলাবকে বলেন, আপনি জানেনÑ আমাদের তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের ব্যাপারে সজাগ। মন্ত্রী স্যার পত্রিকার বকেয়া বিলগুলো পরিশোধ করার জন্য আমাকে বলেছেন। সেই নির্দেশ মোতাবেক অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। গতকাল পর্যন্ত কোনো পত্রিকায় বিল পরিশোধ করা হয়নি। ঈদের আগে আসলে দেয়া হবে। না হলে হবে না।

তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর লকডাউন পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে সীমিত পরিসরে সচিবালয় খোলার দিন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে একজন কর্মকর্তা পত্রিকাসহ সকল গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বিল পরিশোধে সব মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেওয়া প্রয়োজন বলে অভিমত প্রকাশ করেন। এমন প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামকে ফোন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠিতে বলা হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন গণমাধ্যম সরকারের অনেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতরের কাছে বিজ্ঞাপন বাবদ বিল পায়। করোনা পরিস্থিতির কারণে সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় অনেক বিল জমা হয়ে গেছে। এ সময় জরুরি কাজের সঙ্গে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম সেক্টরের আর্থিক কার্যক্রম চালাতে সমস্যা হচ্ছে। এমন অবস্থায় সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান যেন তাদের কাছে বকেয়া থাকা পত্রিকা ও অন্যান্য সকল গণমাধ্যমের বিল পরিশোধ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অবহিত করতে বলা হয়েছে।

গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আবার গণমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে দায়িত্বশীল, নির্ভরশীল ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো প্রিন্ট মিডিয়া। ডিজিটালাইজেশনের এই যুগে টিভি, রেডিও, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ নানাভাবে পাঠক-পাঠিকা খবর জানতে পারলেও সংবাদপত্রের গুরুত্ব একচুলও কমে যায়নি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের খবর দায়বদ্ধতা হীনভাবে প্রচার হয়। অন্যান্য মিডিয়া সীমাবদ্ধতার কারণে খবরের গভীরতা না। বিশেষ করে খবরের পেছনের খবর, বিশ্লেষণধর্মী খবর পেতে সংবাদপত্রের বিকল্প নেই। বেশিরভাগ সংবাদপত্র প্রিন্ট ভার্ষণের পাশাপাশি এখন অনলাইন সংস্করণ বের করেছে। তবে বৈশ্বিক মহামারি করোনায় প্রিন্ট মিডিয়া বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়ে গেছে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে প্রিন্ট দৈনিক পত্রিকা বিক্রির সংখ্যা অনেক কমে গেছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যবসা-বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বিজ্ঞাপনও কমেছে। সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল সময়মতো পরিশোধ করা হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোতে ছাপানো সরকারি বিজ্ঞাপনের বিল এখনো একশ কোটি টাকা বকেয়া রয়ে গেছে। তথ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে সংবাদপত্রগুলোকে বিল পরিশোধের লক্ষ্যে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এখনো চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের পত্রিকাগুলো বকেয়া বিল পায়নি।

করোনাভাইরাস মোকাবিলার চিকিৎসকদের মতোই সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের অন্যমত হলো সাংবাদিক। অথচ সাংবাদিকদের নিদারুণ আর্থিক কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্পসহ নানা সেক্টরে করোনায় প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। অথচ সেবা শিল্প হিসেবে পরিচিত সংবাদপত্রে সে ছোঁয়া লাগেনি। সংবাদপত্র এবং সাংবাদিক একে অপরের পরিপূরক শব্দ। সংবাদপত্র যদি গাছের কাণ্ড হয়, সাংবাদিক হলেন পাতা। সাংবাদিকদের বাঁচাতে হলে আগে সংবাদপত্রকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সংবাদপত্র টিকে থাকলে সাংবাদিক বাঁচবে। করোনা চরম দুর্দিনে অন্যান্য পেশাজীবীদের মতোই সরকার থেকে সংবাদিকদের ‘কিছু টাকা’ দেয়া হচ্ছে ঠিকই। এটা কার্যত ব্যক্তিগতভাবেই। গতকালও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ১০ কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে বলে মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলাদলির এই সাংবাদিকতার যুগে সে টাকা মূল শ্রোতের কতজন সাংবাদিক পাবেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া দুস্থ ও কর্মহীন সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা-দানখয়রাত করা যেতে পারে। কিন্তু কর্মজীবী মূল শ্রোতের সাংবাদিকদের পেশায় টিকিয়ে রাখার জন্য সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন বিলসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো দেয়া অপরিহার্য।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলে গত ১৬ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মুস্তফা কামালের সঙ্গে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট নিয়ে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সম্পাদকরা। তারা আসন্ন বাজেটে সংবাদপত্র ছাপানোর প্রধান কাঁচামাল নিউজপ্রিন্ট কাগজের ওপর কর প্রত্যাহার চেয়েছেন। তারা সংবাদপত্রশিল্পে করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বর্তমান সরকার গত ২০১৪ সালে এই শিল্পকে সেবাশিল্প’ ঘোষণা দেয়া হয়। এটা যদি সেবা শিল্প হয়, তাহলে সেবাশিল্পে সরকারের প্রণোদনা, নানামুখি আর্থিক-সুযোগ-সুবিধা দেয়া অপরিহার্য। বিগত বাজেট ঘোষণার আগের এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কর্পোরেট ট্যাক্স ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা, একই সঙ্গে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বাদ দেয়া, বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর উৎসে কর ৪ শতাংশ কমিয়ে ২ শতাংশ করা এবং উৎসস্থলে কাঁচামালের ওপর ৫ শতাংশের বদলে অগ্রিম কর শূন্য শতাংশ করার দাবি জানিয়েছিল প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকদের সংগঠন নোয়াব। গতবছর করোনা মহামারি শুরু হলে লকডাউনসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে সংবাদপত্র। সে সময় এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের পাশাপাশি পাঠক, বিজ্ঞাপনদাতা, এজেন্ট ও হকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছিল সম্পাদক পরিষদ। এ শিল্পের দুর্দিনে চিত্র তুলে ধরে সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে বলেছিল, ‘প্রিন্ট মিডিয়া থাকার জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে। পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা কমিয়ে, প্রশাসনিক ও অন্যান্য ব্যয় সংকোচ করেও এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া যাবে তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না’। এমন অবস্থা বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগতে আগে কখনো আসেনি, উল্লেখ করে সম্পাদক পরিষদ বলে, ‘সংবাদপত্রের পাঠক ও পত্রিকা প্রচার সংখ্যা কমে গেছে। বিজ্ঞাপন ও কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এমন অবস্থাতেও সকল প্রতিকূলতা সামলে আমরা পত্রিকা প্রকাশ অব্যাহত রেখেছি। পাঠকদের কাছে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার কাজ বাধাগ্রস্ত হতে দিইনি। বাংলাদেশে সংবাদপত্র একটি সেবা শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। এর প্রথম লক্ষ্য বৃহত্তর পরিসরে দেশ ও জনগণের সেবা করা। কিন্তু এই লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো সাহায্য ও সহযোগিতা সংবাদপত্র শিল্প কখনো পায়নি। সেবা শিল্প তো নয়ই, মুনাফামুখী সাধারণ শিল্পগুলো যে সহযোগিতা পায় সংবাদপত্রশিল্প তা থেকেও বঞ্চিত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন