মুসলিম পরিবার ও সমাজে প্রতি বছরই ঈদ আনন্দ প্রত্যক্ষ করা যায়। রোজার ঈদে রোজাদার মুসলামানগণের সাথে বে-রোজাদারগণও অতি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে ঈদ উদযাপন করে থাকে। ঈদের অতীত যেমন গৌরবোজ্জ্বল, তেমনি বর্তমানে ঈদ উদযাপনের ধারায় অভিনব অনেক কিছু লক্ষ করা যায়, তবে এসব ঈদের চিরন্তন ঐতিহ্য-মাহাত্ম্যে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি, আট-নয় দশক পূর্বে ঈদ উপলক্ষে যেসব উদ্যোগ আয়োজন করা হতো, বর্তমানে তাতে মৌলিক তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কেবল আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে মাত্র। ফলে গ্রামীণ ও শহর এলাকায় ঈদ উদযাপনে প্রায় সমতা এসে গেছে। বৃটিশ শাসনামলের অন্তিম সময়ে যুদ্ধবিভীষিকা, যুদ্ধজনিত মহাদুর্ভিক্ষ এবং প্রাকৃতিক কলেরা মহামারি প্রভৃতি দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেও সন্ধীপের মতো একটি বিচ্ছিন্ন ভ‚-খন্ডের গোটা গ্রামীণ এলাকার অধিবাসী হিসেবে ছেলেবেলার ঈদ অনুভ‚তি ব্যক্ত করতে গেলে প্রায় সাত-আট যুগ আগের ঈদ আনন্দ প্রত্যক্ষ করার কথা আগেই বলতে হয় ।
এ লেখকের শৈশব, কৈশোর কালটি ছিল এমন দুর্যোগ-আপদের, যখন একদিকে চলছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। লেখকের বাড়ির অতি নিকটে চরকালিতে বৃটিশদের বিমান ঘাঁটি স্থাপিত হয়েছিল। একদিকে তাদের জঙ্গী বিমান বহরগুলোর ঝাঁকে ঝাঁকে উঠানামা করার ভীতিকর দৃশ্য, অপরদিকে যুদ্ধজনিত কারণে সমগ্র স›দ্বীপে ভয়ানক মহামারি ও একই সাথে মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। এ উভয় সংকটে পতিত হয়ে সন্দীপবাসীর তখন রীতিমত হাহাকার অবস্থা। এ কঠিন সময়েও সন্ধীপের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন। বিপদ মুক্তির জন্য তারা আল্লাহর দরবারে এবাদত বন্দেগীতে কোনো ছাড় দেননি। প্রায় সর্বত্র কোরআন তেলাওয়াতের ধুম পড়ে গিয়েছিল ও আলেমগণের অবসর ছিল না। আলেমগণ বিরতিহীনভাবে প্রায় ঘরে ঘরে কোরআন তেলাওয়াতে রত ছিলেন।
মনে পড়ে, যখন রমজানের চাঁদ দেখা যেত, তখন মুসলিম পরিবারগুলোর ঘরে ঘরে এক প্রকারের আনন্দের ঢেউ খেলত। রোজা রাখতে যারা অভ্যস্থ ছিল না, কিংবা যারা রোজা রাখার কষ্টকে ভয় করতো, তারা কিছুটা হতাশায় ভুগলেও তাদের মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দ বিরাজ করতো ঈদকে কেন্দ্র করে। যারা ক্ষুদ্র, মাঝারি বা বড় ব্যবসায়ী ছিল তারা ঈদকে সামনে রেখে আগ থেকেই বিভিন্ন দ্রব্যের সাথে ঈদের পণ্য সামগ্রীও সংগ্রহ করে তাদের দোকান সাজাতে শুরু করতো।
প্রায় প্রত্যেক পরিবারের মহিলারা কয়েকদিন আগ থেকে ঘর সাজানোর অংশ হিসেবে যে কাজটি করতেন, তা হচ্ছে ঘর লেপন। গ্রামীণ পল্লী এলাকায় পাকা ভবনের কথা তো চিন্তাই করা যায় না, স্বচ্ছল পরিবারগুলোর টিনের ঘর ছিল, আর ভিটে ছিল কাঁচা মাটির। অধিকাংশ লোকের ঘরের ছাদ ছনের ছাউনিতে ঢাকা কাঁচা ঘর। সুতরাং অনেকে ঈদ উপলক্ষে মাটি দ্বারা ঘরের চার দেয়াল অবশ্য লেপন করাতেন। অনেক মহিলা নিজেরাই এ কর্ম সম্পন্ন করতেন। ঘর লেপন ছিল ঈদের প্রাথমিক প্রস্তুতি ।
‘ঈদের কাই, কার ঘরে নাই’- বহুল প্রচলিত এ প্রবাদ গ্রামীণ মুসলিম মহিলাদের এক বিশেষ পরিচয়। ঈদের আগমনকে সামনে রেখে তারা ঈদের সেমাই প্রস্তুতির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। গ্রামাঞ্চলে সকাল হলে সে কালে গমের আটার তেমন প্রচলন না থাকায়, প্রধানত চালের রুটিই বানানো হতো। ঈদ উপলক্ষে মহিলারা ঢেঁকিতে চাল ভাঙ্গিয়ে সেমাইয়ের লতা স্বহস্তে তৈরি করতেন। প্রয়োজনে এ কাজে পাড়া-পড়শি মহিলারাও সহযোগিতা প্রদান করতেন।
ঈদের নতুন জামা কাপড় ও অলংকারের আগ্রহ কার না থাকে? সে কালে ছোট ছেলে-মেয়ে ও পুরুষ-মহিলাদের জামা কাপড় যোগাড় করার জন্য প্রথমে খলিফার (দর্জি) শরণাপন্ন হতে হতো। দর্জির সংখ্যা অপর্যাপ্ত হওয়ায় প্রত্যেক দর্জির দোকানে ভিড় লেগেই থাকতো। তবে অধিকাংশ লোক হাট-বাজার থেকে ঈদের নতুন জামা, কাপড়-চোপড় ইত্যাদি ক্রয় করত। মহিলাদের শাড়ি ইত্যাদিও দোকান থেকে কেনা হতো। মহিলাদের অলংকার বানানোর জন্য ঈদের অনেক আগেই স্বর্ণকারদের অর্ডার দিয়ে রাখা হতো। কারো কারো ব্যবহৃত পুরানো অলংকার স্বর্ণের দোকানে পাঠিয়ে পলিশ করা হতো। পুরুষদের ক্ষেত্রে নিয়ম ছিল, যারা নতুন জামা-কাপড় কিনতে সক্ষম নয়, পুরাতনগুলো সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিত। এ সবই ছিল ঈদ প্রস্তুতি।
সেই বৃটিশ আমলে ঈদের চাঁদ দেখা কোনো সমস্যাই ছিল না। তখন চাঁদ দেখার কমিটির জন্মও হয়নি। ২৯ রমজান মুসলমানগণ ঈদের চাঁদ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। রোজাদার ছাড়াও অনেকে ২৯ রমজান সূর্যাস্তের সময় পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। চাঁদ দেখা গেলে অনেকে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যেত, খবরটি কে কার কাছে আগে জানাবে, রীতিমত তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত। কেননা, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না।
ঈদের চাঁদ দেখা দেয়ার সাথে সাথে ঈদ আনন্দের এক নতুন মাত্রা শুরু হয়ে যেত। যাদের কেনা-কাটা অসম্পূর্ণ থাকত, তারা হাটবাজার খোলা থাকলে সে দিকে ধাবিত হতো, নতুবা নিকটস্থ দোকানপাটে গিয়ে ভিড় জমাত, দোকানপাটও সারারাত খোলা থাকত। অপরদিকে প্রত্যেক পরিবারে গিন্নীদের তৎপরতাও বেড়ে যেত। রমজান মাস শেষে ঈদের দিন পুরুষদের সকালে কিছু খেয়ে ঈদের জমাতে যাওয়ার নিয়ম। তাই রাতেই সকালের খাবার কিছু রান্না করে রাখা দরকার। ঈদের জমাতগামীদের সামনে খাবার হাজির করা না হলে, তাদের উপবাস অবস্থায় জামাতে অংশ নিতে হবে- এতে রমণীকুলদের সম্মান থাকে না। সুতরাং মহিলারা ভোর হওয়ার আগেই সবকিছু প্রস্তুত করে রাখতেন।
যারা গ্রামীণ সমাজে নিয়মিত নামাজী, তারা মসজিদ নিকটে হলে ফজরের নামাজ মসজিদে গিয়ে অথবা সময় মতো গৃহে পড়তেন। পাড়া-পড়শির যাকাত-ফিতরা পাওয়ার উপযোগী, তারা ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের পাওনা উসুল করত। নামাজের আগে ফিতরা-যাকাত প্রদান করা সম্ভব না হলে ঈদের জামাত শেষে তা প্রদান করা হতো। এভাবে ঈদ আনন্দের সূচনা হতো। অতঃপর ঈদের জমাতে অংশ গ্রহণ পর্ব।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, আমাদের এলাকায় সেকালে মসজিদের সংখ্যা ছিল চর্তুদিকে মাইল খানিকের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ খানা। আমাদের পারিবারিক সদস্যরা সবসময় যে মসজিদে নামাজ আদায় করতেন, সেটি আমাদের বাড়ি হতে কিছুটা দূরে অবস্থিত হওয়ায়, কোনো কোনো বছর ভারী বৃষ্টিতে মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ পড়া সম্ভব হতো না। বাড়িতে বিশেষভাবে তারাবীহর নামাজ পড়ানোর জন্য একজন আলেম নিয়োজিত থাকতেন। বর্ষাকালে ঈদ হলে তিনি ঈদের নামাজ পড়াতেন। ঈদের দিন অনুপস্থিত থাকলে তখন আমার আব্বা অথবা আমার বড় ভাই বাড়িতে থাকলে (বাদুরা শহীদ মওলানা মোহাম্মদুল্লাহ) ঈদের নামাজ পড়াতেন। এ জন্য আলাদা স্থান নির্দিষ্ট ছিল। এ জমাতে আশেপাশের মুসল্লীরা অংশগ্রহণ করতেন এবং উপস্থিত সকলকে ঈদের খাদ্য সামগ্রী দ্বারা আপ্যায়ন করা হতো।
শীতকাল না হলে ঈদের দিন সকালে ছোট-বড় সবাই অত্যন্ত উৎসাহ সহকারে পুকুরে নেমেই গোসল করতেন। নতুন বা পরিষ্কার জামা-কাপড় পরিধান করে এবং সুগন্ধি মেখে ঈদের জমাতে রওয়ানা হয়ে যেতেন। সে যুগে আমাদের এলাকায় কোনো ঈদগাহ না থাকায় মসজিদসমূহে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতো। খতীব বা ইমাম সাহেব সারা বছরের ওয়াজ যেন এই দিনই বলে ফেলতেন। ইমাম সাহেব দীর্ঘ বয়ান, খোতবা, নামাজ ও মোনাজাত শেষ করতে কোনো কোনো সময় জোহরের সময় হয়ে যেত। সুতরাং অনেকে একই সাথে জোহরের নামাজও আদায় করে মসজিদ ত্যাগ করতেন।
ঈদের নামাজ শেষে আলিঙ্গন-কোলাকুলি এবং ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময় হতো। গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর মেহমান, আত্মীয়-স্বজনের আগমন, ঈদের রকমারি খাবার পরিবেশন, আলাপচারিতা এবং তাদের বিদায় পর্ব। ঈদের নামাজ শেষে গৃহের সদস্যদের কেউ কেউ মসজিদ হতে তাদের বন্ধু মহলের সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চলে যেতেন। এদিকে ঘরের অবস্থা দাঁড়াতো, যাদের ঘরে চাকর-বাকর ও কাজের বুয়া থাকত তারাও বেতন-ভাতা উপহার ইত্যাদি নিয়ে ঈদের বহু আগেই স্বগৃহে চলে যেতো। ঘরে মাতা-পিতা বা স্বামী-স্ত্রীকেই অতিথি আপ্যায়ন করানো ছাড়া উপায় থাকতো না।
ঈদ উপলক্ষে বন্ধু-বান্ধব এবং স্থানীয় গুণীজ্ঞানীদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর প্রথা প্রাচীন। অনেকে নানা প্রকারের উপহার বিনিময় করতেন। ঈদের দিন ফরজ যাকাত হিসাব করে, অনেকে ঈদের আগে রমজান মাসেই তা প্রদান করতেন এবং ওয়াজেব ফিতরা প্রাপকদের মধ্যে ঈদের নামাজের পূর্বেই প্রদান করা শরীয়তের নিয়ম। ফিতরা ছাড়াও ঈদ উপলক্ষে পুরুষরা দান-খয়রাত প্রদানে কার্পণ্য করতেন না। রমজানে ঈদ আনন্দে মুসলিম পরিবারে এসব ধর্মীয় ও সামাজিক তৎপরতা পূর্বে যেমন ছিল, এখনো তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। উপরন্তু আধুনিক কালে বহু নব নব কৌশল-পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ-মহামারি কবলিত মৃত অনেক মুসলমানকে কাফনের কাপড়ের অভাবে ধারাপাতা, কলা পাতার কফিনে দাফন করা হয়েছে। অভাবীদের জন্য চালু করা রেশন প্রদানের আওতায় রেশনে পাওয়া পাতলা কাপড়কে লুঙ্গি বানিয়ে তা অনেকে পরিধান করেছে এবং তা অনেকে ঈদের পোশাক হিসেবেও ব্যবহার করেছে। বস্ত্রহীন ও দরিদ্র মুসলমান এভাবে ঈদের জমাতে যোগদান করেছেন।
মোট কথ, আজ থেকে ৮/৯ দশক পূর্বে পরাধীন আমলের শেষ দিকে মানব সৃষ্ট মহাযুদ্ধ এবং যুদ্ধজনিত দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক কলেরা মহামারি ইত্যাদি দুর্যোগকালের সংকটময় ভীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স›দ্বীপের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ যথাসাধ্য ইসলামের অনুশাসনগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন