শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সারা বাংলার খবর

রঙিন মাছে বর্ণিল স্বপ্ন

কামাল আতাতুর্ক মিসেল : | প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

পানিতে ভাসছে নানা রঙের মাছ। লাল, নীল, কমলা, কালো, বাদামি, হলুদ রঙের মাছের ছড়াছড়ি। গোল্ড ফিশ, কমেট, কই কার্ভ, ওরেন্টা গোল্ড, সিল্কি কই, মলি, গাপটি, অ্যাঞ্জেল প্রভৃতি বর্ণিল মাছ দেখলে চোখ জুড়ায়, মন ভরে যায়।
সাতক্ষীরার কলারোয়ার তরুণ উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী রঙিন মাছের চাষ তার জীবনকে রাঙিয়ে দেবে বলে আশাবাদী। সাইফুল্লাহ গাজী মাত্র ৬২০ টাকায় অ্যাকুরিয়াম মাছের চাষ শুরু করেন। আর সেই মাছ চাষ তাকে আজ বানিয়েছে কোটিপতি। এক সময় বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যাকুরিয়ার মাছ সৌখিন ব্যক্তিদের বাসা-বাড়িতে শোভা পেত। কিন্তু উদ্যোমী সাইফুল্লাহ চেষ্টায় দেশ থেকে উৎপাদিত মাছ এখন সৌখিনদের বাসা-বাড়িতে যাচ্ছে।

দেড় কোটি টাকার মূলধন খাটিয়ে ব্যবসা করছেন সাইফুল্লাহ। যিনি সাতক্ষীরার কলারোয়ার বজ্রবকশা গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে ২১টি পুকুরে বিভিন্ন ধরনের অ্যাকুরিয়ামের মাছ চাষ করছেন তিনি। বিশাল মূলধন খাটানোর পাশপাশি ৫০ জন বেকারের কর্মসংস্থান করেছেন সাইফুল্লাহ। তার পুকুরে বাহারি রঙের মাছে সমারোহ দেখা গেছে। প্রতিদিন সকালে পাত্রে শব্দ করে মাছকে খাওয়ার দাওয়াত দেন সাইফুল্লাহ। শব্দ শুনে পুকুরের এক কিনারে জমা হয় সব রঙিন মাছ। এরপর খাবার ছিটিয়ে দিলেই নিমিষেই খাবার খেয়ে তৃপ্ত হয় মাছগুলো। সাইফুলের ডাক ও মাছেদের সাড়া দেয়ার এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে অবাক স্থানীয়রা।
সফল উদ্যোক্তা সাইফুল্লাহ গাজী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, ১৯৯৭ সালে অভাবের কারণে জেদের বশে প্রতিবেশি দেশ ভারতে কাজে যাই। সেখানে টেক্সটাইল মিলে কাজ করার পাশাপাশি একটি গ্রামীণ এলাকায় যাই। সেখানে বেশ কয়েকটি পুকুরে নানা রঙের মাছ চাষ দেখতে পাই। এরপর জিদ মিটে গেলে দেশে ফিরে আসি।

অভাবের তাড়নায় ১৯৯৯ সালে আবারো বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করি। কিন্তু পর্যাপ্ত আয় না থাকায় সন্তুষ্টি মেলেনি। তখন মিরপুর-১৩ তে একটি অ্যাকুরিয়ামের দোকান দেখি। ভারত থেকে সৃষ্ট আকাঙ্খা আর মিরপুরের দোকান দেখে অ্যাকুরিয়াম মাছ চাষের প্রতি প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি আরো বলেন, আগ্রহ থাকলেও মূলধন ছিল না।

মাসের বেতনের সব টাকা খরচ করে অবশিষ্ট ৬২০ টাকা ছিল। সেই টাকায় কয়েকটি মাছ নিয়ে বাড়িতে রওনা হই। বাড়িতে অ্যাকুরিয়ামের মাছগুলোকে এনে কলসে পালন করি। এক সময় মাছগুলো ডিম দেয়। কিন্তু পুরুষ মাছের অভাবে ডিমগুলো থেকে বাচ্চা উৎপন্ন হচ্ছিল না। এভাবেই অ্যাকুরিয়ারম মাছ চাষের শুরু। সাইফুল্লাহ বলেন, প্রথমে ১০ রকমের মাছ আনলেও ৯ ধরনের মাছকেই বাঁচানো যেত না। তবে পাঁচ বছরের অক্লান্ত সাধনায় ৯ ধরনের মাছ প্রস্তুত করতে সক্ষম হই। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ৬২০ টাকার মূলধন এখন দেড় কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ২১টি পুকুরে চাষ করা অ্যাকুরিয়ামের পিছনে ৫০ জন পরিশ্রম করছেন।

তিনি বলেন, আমার চাষ করা অ্যাকুরিয়াম মাছ ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশ রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে তার। এতে নিজে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি দেশ লাভবান হবে। তবে রঙিন মাছ চাষ এখন কেবল সাতক্ষীরা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ না। ফেনী, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরেও বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন।

বাংলাদেশে অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। শৌখিন মানুষ বাসা-বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অ্যাকুরিয়াম রাখেন। শপিংমল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এমনকি দোকানেও এখন অ্যাকুরিয়ামের ব্যবহার বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলেন, অ্যাকুরিয়াম আগে উচ্চবিত্তদের বাড়িতে বেশি দেখা যেত। সময় পাল্টেছে, এখন মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তরাও শখের বশে বাসা-বাড়িতে অ্যাকুরিয়াম রাখেন। দিন যত যাচ্ছে এর ব্যবহারও ততই বাড়ছে। ফলে ধীরে ধীরে সেই বিদেশ নির্ভরতা কমে এসেছে। যার ফলে দেশের টাকা দেশেই থাকছে। তারা জানান, এখন অনেক শিক্ষার্থীও রঙিন মাছ উৎপাদন করে তাদের কাছে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করে। এতে করে শিক্ষার্থীরাও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে।
রহুল আমীন নামে অপর মাছ ব্যবসায়ী দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, পুকুরের পরিবেশ একটু ভালো রাখলে, চুন ব্যবহার করলে, স্বচ্ছ পানি থাকলে এবং জীবাণুমুক্ত পানি হলে সেখানে রঙিন মাছ উৎপাদন করা যায়। কিচিং গোরামি, মিল্কি কই কার্প, কই কার্প ও কমিটিসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন হয় । প্রতিটি মাছের দাম সর্বনিন্ম ১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।

বিদেশ থেকে রঙিন মাছ আমদানিকারক পপুলার অ্যাকুরিয়াম সেন্টারের অংশীদার শহীদুল ইসলাম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে রঙিন মাছ আমদানি করা হয়। আগে মাসে ১০০ রঙিন মাছের কার্টন আমদানি করতেন। এখন ৩০ থেকে ৪০ কার্টন মাছ আমদানি করছেন। কারণ দেশেই এখন রঙিন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। দামও তুলনামূলক অনেক কম। তিনি বলেন, বিদেশের এক জোড়া গোল্ড ফিশের দাম পড়ে দুই হাজার টাকা। চিংড়ির জোড়া ৬০০ টাকা। এর বেশি দামও আছে। তা ছাড়া ওই সব রঙিন মাছের খাবারের দামও বেশি। তাই মানুষ এখন দেশে উৎপাদত রঙিন মাছ বেশি কিনছে।

এ বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (সদর) রবিউল ইসলাম এই উদ্যোগকে ভালো উল্লেখ করে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এর চাষপ্রণালি অন্য মাছের মতো। শুধু আলাদা কিছু খাবার দিতে হয়। তবে এই রঙিন মাছে চাহিদা থাকায় খামারিরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। আমরাও চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন