শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

টিকার জন্য হাহাকার : দ্বিতীয় ডোজের জন্য ঝুলে আছে সাড়ে ১৪ লাখ : এদের কী হবে?

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

বাংলা এবং ইংরেজীতে কয়েকটি প্রবাদ-প্রবচন এবং বাগধারা রয়েছে, যা কোনদিন পুরানো হওয়ার নয় এবং যা সর্বকালে প্রযোজ্য। তেমনি দুটি বাগধারা হলো, A stitch in time saves nine. অর্থাৎ সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। আরেকটি হলো, Do not put all eggs in one basket. অর্থাৎ সবগুলো ডিম এক ঝুড়িতে রেখোনা। বাংলাদেশে আজ টিকার হাহাকার দেখে ঐ বাগধারাগুলো মনে পড়ছে। টিকার এই হাহাকার শুধু সরকারকে নয়, অনেক মানুষকে বেহাল করে ছেড়েছে। যারা এ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ টিকাই নিতে পেরেছেন তারা তো বেঁচে গেছেন। কিন্তু শনিবারের এক শ্রেণির পত্রিকার খবর মোতাবেক সাড়ে ১৪ লক্ষ মানুষ এখনও ঝুলে আছেন। এই ঝুলে থাকা ব্যক্তিরা টিকার একটি ডোজ নিয়েছেন। এদের কেউ কেউ দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে গিয়ে দেখেন, টিকা শেষ। নতুন করে না আসলে আর টিকা দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রাপ্তি নিয়ে যারা ঝুলে আছেন তাদের সংখ্যা কত সেটি সঠিক করে কেউ বলতে পারেন না। কোনো কোনো পত্রিকায় একাধিক টিকাদান কেন্দ্রের নাম উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, এসব কেন্দ্রে টিকাদান বন্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিতে যারা ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন তারা হৈ চৈ করে ফিরে গেছেন।

টিকা সংকটের কারণেই সরকারকে এখানে ওখানে ছুটতে হচ্ছে। একবার রাশিয়ার কাছে, একবার চীনের কাছে। আবার এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার জন্য, একবার ধরনা দিতে হচ্ছে আমেরিকার কাছে, আরেকবার ধর্না দিতে হচ্ছে ইংল্যান্ডের কাছে। কিন্তু কোন সুস্পষ্ট ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় অনুরোধ করতে হচ্ছে কানাডাকে। সেখানেও কোন ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় ফের খোসামদ করতে হচ্ছে ভারতকে। সর্বশেষ খবর হলো, এ্যাস্ট্রাজেনেকা বা অক্সফোর্ডের টিকার দুইটি ডোজের ব্যবধান এখন ১৬ সপ্তাহ বা ৪ মাস করারও চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, অক্সফোর্ডের টিকা যদি সহসা পাওয়া না যায় তাহলে এই সংকটের বৈজ্ঞানিক সমাধান কি সেটা খোঁজা হচ্ছে। একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে ২০ মে তারিখে প্রথম পৃষ্ঠায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেটি খুব ইন্টারেস্টিং। এই পত্রিকাটি সরকারের উর্ধ্বতন মহলের সাথে ঘনিষ্ঠ বলে জনরব রয়েছে। তিন কলাম ব্যাপী প্রকাশিত খবরটির শিরোনাম, ‘মিক্সড ডোজ নিয়ে আলোচনা’। এটাই বৈজ্ঞানিক সমাধান কি না সেটি জানা যায়নি।

দুই
ঠিক করেছিলাম অন্য বিষয় নিয়ে লিখবো। পরে ঠিক করলাম টিকা সংকট নিয়েই লিখবো। টিকা নিয়ে যে সরকার কি রকম অসহায়ত্বের মধ্যে আছে সেটি কয়েকটি খবর পড়লেই বোঝা যাবে। ২১ মে দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠার অন্যতম খবরের শিরোনাম, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ কিছু টিকা ভারতের নিকট থেকে উপহার হিসাবে চেয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করকে ফোন করেছিলাম। আমি এর আগে চিঠিও দিয়েছি। আমি ঐ দিন বললাম, আমরা ঝামেলায় পড়েছি। আমাদের ১৫ লাখ লোক দ্বিতীয় ডোজের জন্য আটকে আছে। টিকা রপ্তানীতে নিষেধাজ্ঞা থাকলে প্রয়োজন হলে আমাদেরকে উপহার হিসাবে দিন। কারণ, এর আগে আপনারা আমাদেরকে উপহার দিয়েছেন। আমি বললাম, আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। কারণ ১৫ লাখ লোক টিকা না পেলে সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভারতের প্রভাব রয়েছে। আমি জয় শঙ্করকে অনুরোধ করেছি, যুক্তরাষ্ট্রকে বলতে, যাতে তারা আমাদেরকে টিকা দেয়। ভারত টিকা দিতে পারবে কিনা, জয় শঙ্কর এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে, ভারতের সেরামের সাথে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের যে চুক্তি হয়েছে তারমধ্যে দেড় কোটি ডোজের পেমেন্ট অগ্রিম করা হয়েছে। এই দেড় কোটি ডোজের মধ্যে ওরা ৭০ লক্ষ ডোজ সরবরাহ করেছে। অবশিষ্ট ৮০ লাখ ডোজ পাওনা আছে। আর চুক্তির দায়বদ্ধতা বিচার করলে এখনও ২ কোটি ৩০ লাখ ডোজ ভারতের নিকট পাওনা। সেখানে বাংলাদেশকে অনেকটা ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে ভারতের দুয়ারে দাঁড়ানোর মত করে বলতে হয় যে, উপহার হিসাবে হলেও দয়া করে আমাদেরকে কিছু টিকা দিন। প্রিয় পাঠক দেখুন, কি করুণ আমাদের অবস্থা।

ভারতের কাছে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাংলাদেশ কানাডার নিকট থেকে ২০ লাখ অক্সফোর্ডের টিকা চেয়েছে। অথচ কানাডা এখন পর্যন্ত টিকা উৎপাদনকারী দেশ নয়। তারা আগে ভাগেই আমেরিকার ফাইজার ও মডার্না এবং অক্সফোর্ডের টিকা আমদানী করে স্টক বা মওজুদ গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ গ্রেট বৃটেন থেকে ১৬ লাখ এবং আমেরিকা থেকে ২০ লাখ এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়ার অনুরোধ করেছে। আমেরিকা সুনিশ্চিতভাবে বিশাল পরিমাপ টিকা উৎপাদনকারী দেশ। তবে তারা এ্যাস্ট্রাজেনেকা উৎপাদন করে না। তারা উৎপাদন করে ফাইজার, মডার্না এবং জনসন এন্ড জনসনের টিকা। তারপরেও তারা এ্যাস্ট্রাজেনেকার ৬ কোটি ডোজ মওজুদ গড়ে তুলেছে। ইংল্যান্ড বলেছে, তারা টিকা দিতে পারবে না। কারণ টিকার জন্য কোভ্যাক্স নামক যে বৈশ্বিক মওজুদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গড়ে তুলেছে, তারা সেখানে অক্সফোর্ডের টিকা কন্ট্রিবিউট করবে। তবে বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টর যদি ইংল্যান্ডের প্রাইভেট সেক্টরের মাধ্যমে টিকা আমদানী করতে পারে তাহলে তাদের আপত্তি নাই।

তিন
টকা সংকটের এই ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হলো কেন? আমরা এই কলামের শুরুতেরই দুটি বাগধারা উল্লেখ করেছি। যদি সময়মত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের কপালে এই গর্দিশ নেমে আসতো না। ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে স্তন্যদানকারী মাতা, গর্ভবতী মহিলা এবং শিশুদের বাদ দিলে ১৮ বছর এবং তদুর্ধ্ব মানুষের সকলকে টিকার আওতায় আনতে হবে। শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং স্তন্যদানকারী মহিলার সংখ্যা ৩ কোটি। তাহলেও বাংলাদেশের প্রয়োজন ১৪ কোটি ডোজ টিকা। সেরাম যদি ৩ কোটি ডোজও সরবরাহ করতো তাহলেও প্রয়োজন হতো আরো ১১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের। এই ১১ কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশ কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। সম্পূর্ণ হাত গুটিয়ে বসে ছিল। সরকার কি পুরা ১৩ কোটি ডোজের জন্য একটি মাত্র উৎস, অর্থাৎ ভারতের ওপর নির্ভর করেছিল? এখনকার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তাই। সে সব ডিম এক ঝুড়িতে, অর্থাৎ ইন্ডিয়ার ঝুড়িতে রেখে দিয়েছিল।

অথচ গত বছর চীন সিনোফার্মের তৃতীয় ট্রায়াল রান বাংলাদেশে করতে চেয়েছিল। সেই প্রস্তাবে রাজি হলে চীনা টিকায় সয়লাব হতো বাংলাদেশ। এরপরেও চীন বাংলাদেশকে টিকা দিতে চেয়েছিল। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে কর্মরত চীনা রাষ্ট্রদূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে গত ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে চীন বাংলাদেশের নিকট টিকা বিক্রির প্রস্তাব দেয়। চীনা রাষ্ট্রদূত ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, ঐ প্রস্তাবের জবাব পাওয়ার জন্য চীনকে ৩ মাস অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে টিকা পাওয়ার জন্য অন্তত: ৫০টি দেশ বুকিং দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সিরিয়ালের অনেক পেছনে পড়ে গেছে। ওয়াকেফহাল মহল বলছেন যে, টিকার ব্যাপারে বাংলাদেশ চীন সহযোগিতার প্রতিটি পর্যায়ে ভারত নাক গলিয়েছে। আর প্রতিটি পদক্ষেপে বাংলাদেশ পিছু হটেছে। এর জন্য বড় খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে। শুধু মাত্র সাড়ে ১৪ লাখ মানুষই দ্বিতীয় ডোজের জন্য ঝুলে যায়নি, ২৬ এপ্রিল, অর্থাৎ ১ মাস আগে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ হয়েছে। এরপর নতুন করে নিবন্ধন করাও বন্ধ করা হয়েছে।

চার
এখন আবার সংকটের নতুন সমাধানের উদ্ভট সব তত্ত¡ দেওয়া হচ্ছে। পত্রিকার রিপোর্ট, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের ব্যবধান ১৬ সপ্তাহ হলেও ক্ষতি নাই। ১৬ সপ্তাহ অর্থ হলো ৪ মাস। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে যখন টিকা দেওয়া শুরু হয় তখন টিকা কার্ডে দ্বিতীয় ডোজের তারিখ দেওয়া হয় এক মাস পর। যেমন আমি প্রথম ডোজ নিয়েছি ১৫ ফেব্রুয়ারি। পরবর্তী ডোজের তারিখ কার্ডে লেখা হয় ১৬ মার্চ, অর্থাৎ ১ মাস পর। এরপর সরকারি সিদ্ধান্ত বদল হয়। এক মাসের বদলে দুই মাস। আমার কাছে ম্যাসেজ আসে ১৭ এপ্রিল। এখন টিকার স্টক গেছে ফুরিয়ে। এখন গবেষণা চলছে ৪ মাস পর দেওয়ার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর সাইদুর রহমান বলেছেন যে, দুই টিকার ব্যবধান ৪ মাস- এমন নজির পৃথিবীর কোথাও নাই।

আরেক গবেষণা চলছে যে, মিক্সড্ ডোজ দেওয়া যায় কিনা। অর্থাৎ প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড। আর দ্বিতীয় ডোজ ফাইজার, মডার্না, স্পুটনিক বা সিনোফার্ম। এটিও একটি সর্বনাশা চিন্তা। এটাও পৃথিবীর কোনো দেশে এখনও পরীক্ষা করা হয়নি। আর পরীক্ষা করা হবে কোত্থেকে? কোনো দেশ তো আমাদের মত এত জটিল সমস্যায় পড়েনি।

তাই এই মুহূর্তে যেটা দরকার সেটা হলো, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা বা যে দেশই হোক না কেন, তাদের হাতে পায়ে ধরে অন্তত: ১৬ লাখ অক্সফোর্ডের টিকা আনার ব্যবস্থা করা। একই সাথে যে কোনো মূল্যে চীন ও রাশিয়াকে রাজি করিয়ে কিস্তিবন্দিতে হলেও কয়েক কোটি ডোজ দ্রুততম সময়ে আনার ব্যবস্থা করা।
journalist15@gmail.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (7)
Parvez Nation ২৫ মে, ২০২১, ১:৩৫ এএম says : 0
আমরা আগে টাকা দিয়েছি আমাদের টিকা দিতে হবে।টিকা না দিলে ভারতের সাথে সম্পর্ক শেষ করা প্রয়োজন। ওরা আমাদের প্রিয়জন নয় প্রয়োজন হিসেবে ব্যবহার করছে।
Total Reply(0)
হোসনে জান্নাত নিশি ২৫ মে, ২০২১, ১:৩৫ এএম says : 0
ভ্যাক্সিন আর লাগবে না। ভ্যারিয়েন্ট দিয়ে দিসে অলরেডি
Total Reply(0)
Masudur Rahman Nizam ২৫ মে, ২০২১, ১:৩৫ এএম says : 0
স্বাস্থ্যখাতে অযোগ্য লোকদের বসবাস ও দুর্নীতি বাজ।
Total Reply(0)
অনন্ত ইসলাম ২৫ মে, ২০২১, ১:৩৬ এএম says : 0
২য় ডোজ সময় মত না দিতে পারলে, তখন কি সমস্যা হবে না, কারণ নিদিষ্ট সময় পর তো ২য় ডোজ নিতে হয়।
Total Reply(0)
মোঃ নাজমুল ইসলাম ২৫ মে, ২০২১, ১:৪০ এএম says : 0
চীন থেকে দ্রুত টিকা এনে দেয়া শুরু করা হোক।
Total Reply(0)
বদরুল সজিব ২৫ মে, ২০২১, ১:৪০ এএম says : 0
ভারতকে চাপ দিয়ে যেভাবেই এই টিকা এনে দেশের জনগণ বাচাতে হবে।
Total Reply(0)
Dadhack ২৫ মে, ২০২১, ৯:২৫ পিএম says : 0
If our country ruled by Qur'an then we would have been able to produce our own vaccine.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন