বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

পানিতে ভাসছে উপকূল

শিশুসহ প্রাণহানি আরো ৪ : নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত : সীমাহীন দুর্ভোগ : নতুন আতঙ্ক ভাঙন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

‘ইয়াসের খবর শুনে গ্রামের সবাই মিলে চেষ্টা করেছি গ্রামরক্ষা বাঁধটি বাঁচাতে। সকাল থেকে বাঁধের ওপর মাটি, বস্তা দিয়েছি। কিন্তু দুপুরের আগ মুহূর্তে জোয়ারের পানির প্রবল চাপে বাঁধটি আর রক্ষা করা গেল না। এভাবে বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার হুড়কা গ্রামরক্ষা বাঁধটি জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে গেলে নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা জানিয়ে এক মৎস্যচাষি অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, আমাদের এখানের বেশিরভাগ মানুষ মৎস্য চাষের ওপর নির্ভরশীল। এত চেষ্টা করেও বাঁধটিকে রক্ষা করতে পারলাম না। এক নিমিষে ভেসে গেল আমাদের জীবিকা-স্বপ্ন।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করলেও পানিতে ভাসছে উপকূলের বিভিন্ন এলাকা। উত্তাল রয়েছে বঙ্গোপসাগরসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি। ফলে ঘূর্ণিঝড় আতঙ্ক কেটে গেলেও জলোচ্ছ্বাস মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নদ-নদীর পানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। ভাঙনে ইতোমধ্যে কয়েক শত কিলোমিটার রাস্তা ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বেড়িবাঁধ। বিচ্ছিন্ন রয়েছে কয়েকটি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। আরিচা ও কাজিরহাট ফেরি ঘাটের পন্টুনের র‌্যাম এ রিপোর্ট লিখা পর্যন্ত পানির নীচে রয়েছে। ফলে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া জোয়ারে শিশুসহ আরো ৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ডুবে গেছে অর্ধলক্ষাধিক হেক্টর ফসলি জমি। পানির নিচে রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ। এতে প্রায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে

বরিশাল : পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী তীর রক্ষা বাঁধের ১৭৯টি স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪.১৬ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৪৯টি স্থানে প্রায় ২৫ কিলামিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এছাড়াও বিভিন্নস্থনের বাঁধের ২২৩টি পয়েন্টে আংশিক ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। যার দৈর্ঘ প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। এছাড়াও ৩৬টি স্থানে সংরক্ষিত নদী তীরের প্রায় সোয়া ৬ কিলোমিটার সিসি ব্লক বাঁধও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর বাইরেও ৪৫টি ফ্লাসিং স্লুইস ও ড্রেনেজ স্লুইস ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৩ হাজার হেক্টরের ১৭ হাজার ২০৯টি পুকুর, দিঘি ও ঘের থেকে আড়াই হাজার টনেরও বেশি চিংড়িসহ বিভিন্ন ধরণের মাছ ভেসে গেছে বলে জানা গেছে। সব মিলিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্য সেক্টরে ক্ষতির পরিমানও ১শ’ কোটি টাকার মত।

খুলনা : খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ-এই তিন উপজেলার কমপক্ষে ৩০টি স্থানে নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শতাধিক গ্রাম। পুরো ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। তবে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
উপকূলীয় খুলনা জেলার ঝুঁকিপূর্ণ উপজেলা কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটাকে ধরা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কয়রা। কয়রায় চারটি ইউনিয়নে অন্তত ১১টি স্থানে বাঁধ ভেঙে গেছে। পাইকগাছা উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৭ টি স্থানের বাঁধ ভেঙে গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২৫ কিলোমিটার ও ভেসে গেছে ১০০ মিটার বাঁধ। এতে ৬৫ কিলোমিটার রাস্তা ভেঙ্গে যায়, কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্থ হয় ২০ কিলোমিটার। ১ হেক্টর ফসলি জমি ও ৬শ’৬০ হেক্টর চিংড়ি ঘের। পাইকগাছায় ক্ষতির পরিমাণ ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
নোয়াখালী : হাতিয়ায় জোয়ারের পানিতে ভেসে যাওয়ার ২০ ঘণ্টা পরও নিখোঁজ শিশুর সন্ধান মিলেনি। নিখোঁজ লিমা আক্তার (৭) উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের চর আমান উল্যাহ গ্রামের জুবলুলের মেয়ে। গত বুধবার সন্ধ্যার দিকে উপজেলার সুখচর ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে ঘর থেকে ভেসে যায় ওই শিশু।

ঝালকাঠি : পানি বেড়ে উপকূলীয় জেলা ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদী তীরের প্রায় চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। অরক্ষিত ভাঙা বাঁধ দিয়ে পানি ঢুকে ১৫ গ্রামের ৫ শতাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছে। পানিতে তলিয়ে আছে ফসলের মাঠ ও মাছের ঘের। এছাড়াও পানির তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য রাস্তাঘাট।
এদিকে, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে বিষখালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ডুবে প্রাণ গেছে মো. সিয়াম হোসেন (৮) ও সামিয়া আক্তার (৪) নামে দুই শিশুর। বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার মেডিকেল মোড় সংলগ্ন ও বড়ইয়া এলাকায় পৃথক এই ঘটনা ঘটে। সিয়াম উপজেলার পিংড়ি গ্রামের মো. ফারুক হাওলাদারের ছেলে। সে আজিজিয়া নূরানী কিন্ডারগার্টেন মারদাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো। আর সামিয়া আক্তার বড়ইয়া এলাকার সাইলু আকনের মেয়ে।
বরগুনা : দুইদিনে বরগুনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বরগুনার পাথরঘাটায় আবুবকর নামে দেড় বছর বয়সী একটি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। গতকাল সকাল সাড়ে নটার দিকে উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের লাকুরতলা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আবুবকর একই গ্রামের মাহতাব হাওলাদারের ছেলে। এর আগে বরগুনার বেতাগী উপজেলার দক্ষিণ কালিকাবাড়ি গ্রামের শিপনের ছেলে ইমামুল (৭) ও বরগুনার বামনা উপজেলার ডৌয়াতলা এলাকার মতি জমাদ্দারের ছেলে নান্না জমাদ্দার (৩৫) মারা যান।
ফরিদপুর : ফরিদপুরের সালথা-নগরকান্দায় ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতে ৫/৬ টি গ্রামের শতাধিক ঘর-বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাজারো গাছপালা ভেঙে উপড়ে পড়েছে। কয়েক একর জমির পাট বিনষ্ট হয়েছে। গতকাল সকাল আনুমানিক ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

লক্ষ্মীপুর : মেঘনা নদীর অস্বাভাবিক জোয়ার উপকূলে আঁচড়ে পড়ে কমলনগর উপজেলার মতিরহাট, চরমার্টিন, নাসিরগঞ্জ, নবীগঞ্জ, কালকিনি ও রামগতির উপজেলার চরগাজী, চর আবদুল্লাহ এবং রায়পুর উপজেলার দক্ষিন চরবংশি, উত্তর চরবংশী, দক্ষিন চরআবাবিল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামসহ মেঘনা তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। এসব এলাকার অন্তত ২০টি কাঁচা ও পাকা রাস্তা ভেঙে গেছে।
পটুয়াখালী : পানির অতিরিক্ত চাপে নদীতে নেমে পটুয়াখালীর দুমকী উপজেলার মুরাদিয়ার সন্তোষদি গ্রামের হাসিনা বেগম(৫৫) প্রাণ হারিয়েছেন। এদিকে পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানি বিপদসীমার ৫৯ সে. মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী হাকিম সালেহীন।

আরিচা : পদ্মা-যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এবং বিআইডব্লিউটিএ’র গাফলতির কারণে আরিচা ও কাজিরহাট ফেরি ঘাটের পন্টুনের র‌্যাম পানির নীচে। কর্তৃপক্ষের ঘাট পুনঃস্থাপন কাজে ধীরগতি ব্যাহত হচ্ছে আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি চলাচল। আটকে আছে শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক। ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রী ও যানবাহন শ্রমিকরা।

বাগেরহাট : পূর্ব সুন্দরবনের অবকাঠানোর ৬০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া গতকাল সকালে বন থেকে জোয়ারে ভেসে লোকালয়ে চলে আসা দুইটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
কয়রা (খুলনা) : খুলনার কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ, সহস্রাধিক ঘর বাড়ি, কয়েক হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমি নোনা পানিতে ডুবে রয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) : রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার উজানচর ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আঘাতে ২টি গ্রামের শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। গাছপালা ভেঙে গেছে এবং অনেক গাছাপালা উপড়ে পড়েছে। কয়েক একর জমির ফসলও (পাট, তিল) বিনষ্ট হয়েছে। গরু ছাগল, হাস মুরগি ও ঘরের টিনসহ উড়িয়ে নিয়ে পাশের নদীতে ফেলে যায়। নারী, শিশু ও ছাগল, মাটির মধ্যে পুতে রেখে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, পাঁচশত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ নতুন করে আটটি পয়েন্টে ভেঙে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ৭৬টি গ্রামের ১৪ হাজার ৭১০টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পরেছে। এসব পরিবারের বাড়ি-ঘর জোয়ারের সময় কোমর সমান পানির নিচে তলিয়ে থাকে, ভাটার টানে পানি কমতে না কমতেই পরের জোরে আবার তা তলিয়ে যায়। এভাবেই গত তিন দিন ধরে রয়েছে কলাপাড়ার লক্ষাধিক মানুষ।

শ্যামনগর, (সাতক্ষীরা) : নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি বৃদ্ধিতে শ্যামনগরে উপকূলীয় ৫ ইউনিয়ন বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্য ঘের। উপকূলীয় জনসাধারণের মনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গাবুরা ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান মাস্টার আব্দুর রহিম জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এর তাণ্ডবে কপোতাক্ষ নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ইউনিয়নের লেবুবুনিয়া, গাঁগড়ামারি ৩নং এলাকায় পাউবো বাঁধ ভেঙে পানি ভিতরে প্রবেশ করে। এতে ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম তলিয়ে যায় এবং যাবতীয় মৎস্য ঘের তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন