খালেদা বেগম : সারাদিন অফিসে কাজের পর বাসায় এসে দশটা কাজ গুছিয়ে নীলা বসেন তার সাত বছরের ছেলে নাফিজকে পড়াতে। মাথায় থাকে ঘরের আরও দশটা কাজের চিন্তা। ওদিকে দেড় বছরের মেয়েটা তো আছেই। তারপরও উপায় নেই। কারণ নাফিজের বাবা অর্থাৎ হাকিম সাহেব যদি ছেলেকে পড়াতে বসেন তো কথায় কথায় চড়, থাপ্পড়, ধমক চলতেই থাকে। ছোট শিশু, তার উপর এতগুলো পড়া- অঙ্ক, ইংরেজি, বাংলা, ধর্ম কত কি সবতো ঠিকমতো লিখতে পারে না বা পড়তে চায় না। হাকিম সাহেবের এত ধৈর্য নেই যে, মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ছেলেটাকে পড়াবেন। এতে ফল হয় উল্টো। ইদানীং বাবাকে প্রচ- ভয় ও পড়ার প্রতি কেমন যেন অনীহা তৈরি হয়েছে নাফিজের। অগত্যা নীলাকে ছেলের পড়ার হাল ধরতে হয়। শত কষ্ট হলেও সন্তানের গায়ে হাত তোলেন না নীলা। তাই বলে বাচ্চা শাসন করেন না-তা নয়। তবে তা এত ভয়ঙ্করভাবে কোনমতেই নয়। কঠিন চাহনি, হালকা ধমক ইত্যাদি হাতিয়ার অবশ্যই ব্যবহার করেন। মায়ের নিরলস চেষ্টায় ছেলের সাথে মায়ের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক অটুট মানসিক যোগাযোগ। যার ফলে ছেলেটি ছোট হলেও ফেলতে পারে না মায়ের কথা।
সাধারণভাবে মনে করা হয় যে শিশুদের জন্য কিল, থাপ্পড় বা চড় হয়তো তেমন ক্ষতিকর নয়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের মারধোর বা লাঠি দিয়ে পেটানো শিশু স্বাস্থ্যের এমনকি তার জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। মেরুদ-ের নিচের দিকে সামান্য থাপ্পড়ের ফলে সমস্ত মেরুদ-ে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। প্রাপ্ত বয়সে আমাদের অনেকের পিঠ বা কোমর ব্যথা দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ হচ্ছে বাল্যকালে সেসব চড় থাপ্পড়ের ফল। এ ধরনের শাস্তির ফলে যদি কোন স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি হয় তবে শিশুর শরীর আংশিক বা পূর্ণভাবে চলৎশক্তিহীন হয়ে যেতে পারে। হাত পা অথবা বুকের খাঁচার হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। অনেকক্ষেত্রে গভীর কোন ক্ষত থেকে ক্যান্সারের জন্মও হতে পারে। চড় থাপ্পড়ের চেয়েও ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার শিশু শ্রমিকরা। মালিক বা গৃহকর্ত্রীর কিল, ঘুষি, লাথি, সজোরে ধাক্কা, শরীরের কোন একটা অংশ পুড়িয়ে দেয়া, গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা, গরম খুন্তি দিয়ে সেঁকা দেয়া, নির্জন প্রকোস্টে বা বাথরুমে দিনের পর দিন আটকে রাখার কথাতো সর্বজনবিদিত। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে ছোট শিশুদের জোরে ঝাঁকুনি শিশু শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। শারীরিক বৃদ্ধি বিঘœ, বমি, ¯œায়ু বৈকল্য, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি শিশু মনে বড়দের বিরুদ্ধে ক্রোধ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। ফলে তাদের মনের যা কিছু সুন্দর ও কমনীয়তা হারিয়ে যায়। কোমল শিশুর মনে জন্ম নেয় সবকিছুর বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা। এগুলো ফুটে ওঠে কিশোর কিশোরী, তরুণ-তরুণীর অস্বাভাবিক আচরণ ও অপরাধ প্রবণতার মধ্যদিয়ে।
এসবের কারণ হল মার খাওয়া শিশুর মধ্যে উগ্রতা, হিং¯্রতা দেখা যায় বেশি এবং সহজেই সে অন্যকে আঘাত করে। কথায় বলে, যে মার খায় সে অন্যকে মারতে শেখে। গবেষণায় দেখা গেছে, যে সমস্ত শিশু বাল্যকালে খুব মারধোর খেয়েছে কিশোর বা প্রাপ্ত বয়সে তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক মনোভাব ও নিষ্ঠুরতা দেখা যায়। সমাজের বিপজ্জনক সকল অপরাধীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে বাল্যকালে এরা প্রচ- রকমের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আসলে বাচ্চারা বাবা মা ও বড়দের আচরণ দেখে শেখে এবং অনুকরণ করে। তাই তাদের সামনে ধৈর্র্য্য, সহানুভুতি ও মায়ামমতার উদাহরণ স্থাপন করাই শ্রেয়।
নিয়মিত শারীরিক আঘাত প্রাপ্তি ও বকাঝকা খাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে শিশু মানসিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ড. মেহতাব খানমের মতে, এর ফলে শিশুর পরবর্তী জীবনে যে কোন কর্তৃপক্ষ, অফিসের বস, এমনকি স্বামী অথবা স্ত্রীর সামনেও ভীত বিহ্বল আচরণ করে। বাল্য বয়সে অথবা পরবর্তী জীবনে তার মধ্যে সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটতে পারে না। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নির্যাতিত হওয়ার পরও দুর্বল শিশুটি বাবা মা, শিশু অথবা গৃহকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। ফলে তার মনে জন্ম নেয় হিং¯্রতা, ক্রোধ। পরবর্তী জীবনে যে কোন সমস্যার সমাধানে যে সুচিন্তিত ও পরিকল্পিত উপায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না বরং গায়ের জোরে সকল সমস্যার সমাধান করতে চায়। শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা পিতামাতা ও সন্তানের মধ্যে ভালবাসার যে বন্ধন, শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্মান ও ¯েœহের যে সম্পর্ক বড় ও ছোটদের মধ্যে আদর-ভালোবাসার সম্পর্ককে নষ্ট করে। শারীরিক শাস্তি হয়তো সাময়িকভাবে শিশুকে কথা শোনাতে বাধ্য করে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটা ফলদায়ক নয়। কারণ প্রকৃতিগতভাবেই যারা শিশুর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করে তাদের প্রতি শিশুর ভালোবাসা জন্মায় না। বরং আদর, ভালোবাসা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিশুর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তা হয় সহযোগিতামূলক, স্থায়ী ও দৃঢ়।
যে সব খারাপ কাজের জন্য আমরা শিশুদের শাররিকভাবে আঘাত করি তার পূর্বে সেসব কাজের পেছনের কারণগুলোর সমাধান করা উচিত। কম ঘুম, কম খাবার, অপুষ্টি ও শারীরিক অসুস্থতা এবং মুক্ত বাতাস, শরীর চর্চা, নিজের জগতে অবাধ বিচরণের সুযোগের অভাবে শিশুর মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা, মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমী, কাজে অমনোযোগিতা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি। আজকের ব্যস্ত এ নগরজীবনে নানা জটিল সমস্যার আবর্তে নিপতিত বাবা মা ছেলেমেয়েদের সময় দিতে পারেন না। সঠিক নজরদারির অভাবে বাচ্চাদের অনেক সমস্যাই থেকে যায় চোখের অন্তরালে। তাই আদর-যতœ বঞ্চিত এসব শিশুদের যে কোন ত্রুটিতে মারধর করা খুবই অন্যায় এবং ছোট মানবশিশুটির প্রতি নির্যাতনসম।
চিন্তা করে দেখুন, প্রতিদিন আপনার ব্যক্তিজীবনে সামাজিকভাবে বা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবেও আপনি কত ধরনের বৈষম্য বা অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন। সে সব অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক তার প্রতিবাদও করতে পারছেন না। কারণ তারা আপনার চেয়ে শক্তিশালী। অথচ আপনার ছোট ছেলে বা মেয়েটি অথবা ছাত্রছাত্রী অথবা আপনার গৃহে কর্মরত শিশুর সামান্যতম ত্রুটিতে আপনি বা আমি কত নিষ্ঠুর আচরণ করি তাদের সাথে। এ নির্যাতন ও হিং¯্রতা শিশুটির কাছে একটি বার্তাই পৌঁছে দেয়, আর তা হল, “জোর যার মুল্লুক তার”। এর ফলে শিশুটির মনে দুর্বলকে আঘাত করার একটি মানসিকতা তৈরি হয় এবং তার চেয়ে কম শক্তিশালী কাউকে পদাবনত করার একটি প্রবণতা গড়ে উঠে। প্রাপ্ত বয়সে তার মধ্যে সমাজের অসহায়, দরিদ্র, দুর্বল শ্রেণীর প্রতি মায়া, মমতা ও সহমর্মিতার অভাব দেখা যায়। সুতরাং শিশুর আচরণ ছোট-বড় যে কোন ধরনের ত্রুটিই দেখা যাক না কেন, তাকে মারধর করা ঠিক নয়। বরং শিশুর কাছে খুব নমনীয় ভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রেও বাবা-মা বা শিক্ষকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। কারণ সব শিশু যে সহজে মুখ খুলবে, আর খুললেও যে সত্য কথাই বলবে তাও ঠিক নয়। এজন্য আমাদের উচিত শিশুর সাথে খুব দুঢ় মানসিক বন্ধন তৈরি করা যেতে পারে সে তার সব কথাই আমাদের কাছে নিঃশঙ্কোচে বলতে পারে। এর জন্য শিশুকে সময় দিতে হবে, জীবনে যতই ব্যস্ততা থাক না কেন, শিশুকে সুন্দর সময় দেয়ার বিকল্প নেই। তার অভাব অভিযোগ বা সমস্যা থাকলে ধৈর্য্য সহকারে সেগুলো শুনতে হবে। কোন আবদার থাকলে তা যদি যৌক্তিক হয় এবং আপনার সাধ্যে কুলায় তবে তা পুরণের চেষ্টা করা উচিত। ধরা যাক আপনার সাত বছরের ছেলেটি যাদুঘর দেখতে চাইল যা আপনার সাধ্যের মধ্যে। অথচ তা না করে ছুটির দিনে আপনি নিজেই বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরতে চলে গেলেন অথবা বিশ্রামের অজুহাতে সন্তানকে নিয়ে যাদুঘরে গেলেন না বা কিছু মজার সময় উপহার দিলেন না- এটা অবশ্যই দায়িত্ববান অভিভাবকের কাজ নয়। অথচ একটু ভাবলেই দেখবেন, যে ছুটির দিনে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে যদি যাদুঘর, শিশুপার্ক বা একটু খোলামেলা জায়গায় বেড়াতে যান তবে শিশুরা কতটা আনন্দদায়ক সময় অতিবাহিত করে। এতে শিশুরা যেমন থাকে হাসিখুশি ও প্রাণবন্ত তেমনি সুদৃঢ় হয় পারিবারিক বন্ধন। আর যদি সন্তানের আব্দার পূরণ সম্ভব না হয় তবে তাকে সেটা বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করুন। সন্তানের সাথে তৈরি করুন সহজ সরল প্রাণের সম্পর্ক। মুখে সারাক্ষণ গাম্ভীর্যের মুখোশ এঁটে কখনওই তাকে দূরে ঠেলে দেবেন না। সন্তানকে শাসন তো অবশ্যই করবেন তবে তার ক্ষতি করে নয়। শাসনের সাথে সাথে আদর ভালবাসাও দিতে হবে। সন্তানের সাথে সহজ সম্পর্ক মানসিক যোগাযোগকে করবে সুগম। তার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে আপনার নিয়ন্ত্রণ। আপনার উপর তার আস্থা ও নির্ভরতা বাড়বে। বাধ্য হবে যে কোন নির্দেশনা মানতে। প্রয়োজন হবে না আর চিৎকার চেঁচামেচি বা শারীরিক শাস্তির।
বিভিন্ন বয়সের শিশুকে বিভিন্নভাবে কথা শোনানোর চেষ্টা করতে হবে। শিশু যদি মাত্র হাঁটতে শেখার বয়সে থাকে এবং কোন খারাপ কাজ করতে যায় তবে তাকে চোখ পাকিয়ে খুব জোর করে ‘না’ বলতে হবে। বেশির ভাগ শিশুর ক্ষেত্রেই এ কৌশল কাজ দেয়। তবে কোন কোন শিশু থাকে খুবই নাছোরবান্দা। কথায় কাজ না দিলে সেক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে উক্ত স্থান থেকে সরিয়ে নিরাপদ অন্য কোন কক্ষে বা স্থানে নিয়ে যেতে হবে। মনোযোগ অন্যদিকে সরানোর জন্য খেলনা বা আঁকাআঁকির জন্য রং পেন্সিল ও কাগজ বা খেলনা দিয়ে ব্যস্ত রাখা যেতে পারে।
তিন চার বছরের বাচ্চা বাবা মায়ের মনোযোগ আর্কষণের জন্য অধিক দুষ্টুমি করে থাকে। এজন্য তাকে সময় দিতে হবে, কথা শুনতে হবে, আপনি যদি খুব বেশি ব্যস্ত থাকেন তবে তাকে সে কথা যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলুন। তাকে প্রতিশ্রুতি দিন যে পরে তাকে সময় দেয়া হবে বেশি বা আজকে রাতে আরেকটা গল্প বেশি বলবেন। প্রতিশ্রুতি দিলে তা অবশ্যই রাখতে চেষ্টা করবেন, অন্যথায় শিশু আপনার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। এ বয়সের শিশু প্রশংসা পছন্দ করে বেশি। তাই তার ভালো কাজের প্রশংসা করতে ভুলবেন না। আর বাচ্চারা তো দুষ্টুিম করবেই। সে দুষ্টুমি যদি ক্ষতিকর না হয় তবে তা দেখেও না দেখার ভান করাই শ্রেয়। সন্তানটি যদি বাড়ির বাইরে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে বা পার্কে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা করে তবে জনসমক্ষে তাকে মারধোর না করে বুদ্ধিমানের কাজ হবে অতি দ্রুত উক্ত স্থান ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে আসা এবং যতটুকু সম্ভব তাকে খারাপ আচরণের কুফল সম্পর্কে বোঝানো কিন্তু তা চড়, থাপ্পড়ের মাধ্যমে অবশ্যই নয়। স্কুলে যাওয়ার বয়সে বিশেষ করে সাত বছর হয়ে গেলে শিশুর মধ্যে বয়স, স্কুলের পরিবেশ, পড়াশুনা ও খেলাধুলার ব্যস্ততা, বাবা মায়ের উপদেশ সুন্দর পারিবারিক পরিবেশ সবকিছু মিলিয়ে শিশুর আচরণ ধীরে ধীরে সুসংহত হতে থাকে।
পিআইডি ফিচার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন