বাংলাদেশে সম্প্রতি সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আটকে রেখে হেনস্থার পর ঘটে যাওয়া তুলকালাম ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই তারই একজন সহকর্মীর একটি ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ওই ফোনালাপে তিনি তার বাবার সাথে কথা বলছিলেন যেখানে এসেছিলো রোজিনা ইসলাম প্রসঙ্গও।
বাংলাদেশে এ ধরণের ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে রাজনৈতিক কিংবা পরিস্থিতিগত সুবিধা নেয়ার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা ব্যাপক বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই জরুরি বা ব্যক্তিগত নানা আলাপের ক্ষেত্রে ফোনে কথা না বলে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করছেন। তেমনই একজন ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা সানজিদা খান। তিনি বলছেন, ‘আমি এখন নতুন একটা অ্যাপ সিগন্যাল ব্যবহার করা শুরু করেছি। কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে মানুষের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাই কমে যাচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করি কিন্তু তা নিয়েও একটা ভয় থাকে। এগুলো আসলে বড় রকমের ভীতির সঞ্চার করেছে যে আমি কার সাথে কতটুকু কি কথা বলবো। কিন্তু কথা বলার সময় তো মেপে বলা যায় না।’
বাংলাদেশে গত এক যুগে ফোনালাপ ফাঁসের ক্ষেত্রে বহুল আলোচিত ঘটনা হলো দেশের দুই প্রধান রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মধ্যকার ফোনালাপ ফাঁস হওয়া। দেশের প্রধানমন্ত্রীর ফোনালাপ কারা ফাঁস করলো সেটি তদন্তের কোন দৃশ্যমান উদ্যোগও সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দেখা যায়নি। বরং গত নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের একাধিক নেতার ফোনালাপ ফাঁস করে সেগুলো কয়েকটি টেলিভিশনেও প্রচার করানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজত ইসলাম নেতা মামুনুল হকসহ এমন অনেক ফোনালাপ দিনের পর দিন প্রচার করা হয়েছে কয়েকটি টেলিভিশনে। কিন্তু তারা এগুলো কোথা থেকে সংগ্রহ করেছে সেটিও তারা প্রকাশ করতে পারেনি।
আবার সরকারি ভাবে কোন সংস্থা যেমন দায়ও স্বীকার করে না আবার আইন-বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও এগুলো নিয়ে কোন তদন্তও হয়না। ফলে এসব ফোন কল কারা রেকর্ড করে এবং কারা প্রচার করে সে সম্পর্কে কোন তথ্য জানা যায় না। মানবাধিকার সংগঠন নূর খান লিটন বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলোর বাইরে কারও এভাবে ফোন রেকর্ড করার সক্ষমতাই নেই। তিনি বলেন, ‘যারা সরকারের সমালোচনা করেন বা বিরোধী রাজনীতি বা মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বা সরকারের দুর্নীতি ফাঁস করেন তাদের ক্ষেত্রেই এটা হয়। যারা সরকারে আছেন বা যারা ক্ষমতাধর তাদের ফোনালাপ ফাঁস হতে দেখিনি। নাগরিকদের ফোনালাপ রেকর্ডের সক্ষমতা সরকারি সংস্থাগুলোরই আছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানি। মিডিয়াতে এমন নিউজও হয়েছে যে কিভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে এসব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করা হয়েছে।’
তাহলে বিভিন্ন পেশার যেসব ব্যক্তির ফোনালাপ গত কয়েক বছরে ফাঁস হয়েছে, কারা এগুলো রেকর্ড করে তা যেমন জানা যায় না, আবার যারা ঘটনার শিকার হন তারা কেন আইনি প্রতিকার পেতে চান না সেটাও বড় প্রশ্ন। গত কয়েক বছরে যাদের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে বিবিসি বাংলা তাদের অনেকের সাথে কথা বলতে চাইলেও তারা ওই বিষয়ে কোন কথাই বলতে রাজি হননি। নূর খান লিটন বলছেন, আরও হেনস্থা হবার আশংকা থেকেই এসব ব্যক্তিরা কথা বলেন না বলে মনে করেন তিনি।
ওদিকে, দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলো আগেই জানিয়েছে যে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তারা গ্রাহকের ভয়েস কল রেকর্ড রাখতে পারে না, তারা শুধু কোন গ্রাহক কাকে কল দিয়েছে বা কে তাকে কল দিয়েছে এই রেকর্ড দু’বছর পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখতে পারে। তাহলে যারাই কলগুলো রেকর্ড করুক না কেন তারা কিভাবে সেটি করে। জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ডঃ নওশীন নাওয়ার বলছেন, ফোন ও বেইস স্টেশনের মধ্যে একটা ডিভাইসের মাধ্যমে ভূয়া স্টেশন তৈরি করে আড়িপাতা ও কল রেকর্ড করা হয়। তিনি বলেন, ‘এই ফেইক স্টেশনটা একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করবে এবং আমার কথা এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যাবে। সেখান থেকেই এটা রেকর্ড করা যাবে। এটা হলো ম্যান অব দা মিডল অ্যাটাক। এই ডিভাইসটার নাম হচ্ছে আইএমএসআই ক্যাচার। এই ক্যাচার দিয়ে আড়িপাততে পারি। এটা নেটওয়ার্ক তৈরি করবে ফলে কথা, টেক্সটসহ ফোন দিয়ে যা যা করা যায় সবই ট্র্যাক করতে পারবে।’
তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আয়োজন সাধারণ সরকারি সংস্থাগুলোরই থাকে। যদিও বাংলাদেশের কোন সংস্থা কখনো এসব বিষয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা প্রকাশ করেনি। শুধু কখনো কখনো অপরাধী আটকের পর বিভিন্ন সংস্থা ফোন ট্র্যাক করে কিভাবে তারা সফল হয়েছে তেমন বর্ণনা দিয়েছে প্রকাশ্যেই। আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া অবশ্য বলছেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইস্যু বা কোন অপরাধের তদন্তের প্রয়োজনে আদালতে অনুমতি নিয়ে কারও ফোনালাপ রেকর্ড করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে ফোনালাপ ফাঁস হয় সেটি বেআইনি, কারণ আড়িপাতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
এই অবস্থার অবসানে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় আইনের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট এর দাবি উঠছে অনেকদিন ধরেই। এছাড়া গোয়েন্দা সংস্থা বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও যদি এ বিষয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে কি ব্যবস্থা নেয়া যাবে সেটি সুনির্দিষ্ট করে আইন করার দাবিও করছেন আইনজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা। যদিও এসব দাবির প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ সরকারের দিক থেকে দেখা যায় না। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন