সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইনকিলাব বর্ষ শুরু সংখ্যা

বনানী টু আর. কে. মিশন রোড

মকবুলা পারভীন | প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০২১, ১২:১২ এএম

ধীরে ধীরে সবই কেমন ধোঁয়াশা হয়ে আসছে। পেছন ফিরে দেখলে সব কিছু আর স্পষ্ট মনে হয় না।

দৈনিক ইনকিলাব প্রকাশিত হলো ৪ জুন, আমি নিয়োগপত্র পেলাম খুব সম্ভাবত: ৯ জুন।
নিয়োগের আগে পত্রিকার মহাসম্পাদক এ. কে. এম মহিউদ্দিন সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনার কত টাকা বেতন হলে চলবে?
আমি বললাম, দু’হাজার টাকা।
নিয়োগপত্র পেয়ে দেখলাম কিছু কম।
নতুন অফিসে আমার কর্মযোগ শুরু হলো মহিলা পাতার ইনচার্জ হিসেবে। দায়িত্ব বড়। তবে আমি এর আগে দৈনিক দেশের শিশুদের পাতা ‘কমলকলি’র সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছি। সে অভিজ্ঞতা ছিল।
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা এম এ মান্নান। সবাই তাঁকে হুজুর বলে সম্বোধন করতেন। তাঁর বনানীর বাড়ির নিচের তলার ড্রয়িংরুমে এডিটোরিয়াল প্লাস ফিচার সেকশন। অফিসে সারসার সেক্রেটারিয়েট টেবিল পাতা। মহাসম্পাদক এ. কে. এম মহিউদ্দিন সাহেব ও এ. কে. এম ফজলুর রহমান মুন্সী সাহেব প্রথম দিকে একই টেবিলে পাশাপাশি বসতেন।
সামনে লন সংলগ্ন বারান্দাতেও টেবিল পড়েছিল। ফিচার, টাইপ ও রেফারেন্সের দায়িত্বপ্রাপ্তরা সেখানে বসতেন। এডিটোরিয়াল সেকশনের বর্ষীয়ান সাংবাদিক হাফিজউদ্দিন সাহেব, মফিজউদ্দিন সাহেব, ইউসুফ শরীফ সাহেব প্রমুখ বাঘা বাঘা মানুষের সাথে আমারও ঠাঁই হলো এককোণে। মহিলা পাতার লেখা সম্পাদনা, কম্পোজ দেখা, ছবি জোগাড়ের কাজ শেষে সপ্তাহে একদিন যেতে হতো বনানীর আরেক রোডের অন্য একটি বাড়িতে। বাড়ির নাম আইভী ভিলা। সেটা ছিল নিউজ, মেকাপ ও অন্যান্য সেকশনের জায়গা। অবশ্য প্রতি বিকেল, মানে সন্ধ্যার আগ দিয়ে এডিটোরিয়াল গুঁটিয়ে ওইখানেই পেজের কাজে সবাই চলে যেতেন।
বনানী তখন জমজমাট, অত্যাধুনিক স্থাপনায় ঠাসা ছিল না, জায়গা ছিল ফাঁকা ফাঁকা। বহু প্লট তখনও শুধু সীমানা প্রাচীরে ঘেরা ছিল। বাড়ি তৈরি হয়নি, জনসমাগম কম। দিনের বেলাতেই থমথমে। সন্ধ্যার অনুজ্জ্বল আলোকে কোনো নিস্তব্ধ বাড়িতে মৃদু আলোজ্বলা যেন রহস্যের জাল বিস্তার করত।
অতজন অভিজ্ঞ সাংবাদিকের মধ্যে আমি ভয়েই থাকতাম। মফিজউদ্দিন সাহেব ছিলেন আমার পূর্ব-পুরুষের বাসস্থান, বর্তমান জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানার মানুষ। পরবর্তী সময়ে আব্বার কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, আব্বা তার কথা জানেন। যাই হোক, তিনি সুব্যবহারে আমাকে আপন করে নিলেন। সাহিত্যিক-সাংবাদিক ইউসুফ শরীফ সাহেবের বাড়ি আমার বড় আপার শ্বশুর বাড়ির গ্রামে, এখানে এসে জানলাম, এতে গুরু গভীর পরিবেশটা আমার কাছে কিছুটা সহনীয় হলো।
মহাসম্পাদক এ কে এম মহিউদ্দিন সাহেব স্বল্পভাষী, গম্ভীর মানুষ। হাফিজউদ্দিন ও মফিজউদ্দিন সাহেব দুই বন্ধু। তুইতুকারি সম্পর্ক। মহিউদ্দিন সাহেব ছিলেন তাদের ‘মহী ভাই’।

দুপুরবেলা এডিটোরিয়ালের ব্রিফিং হতো। তারপর যার যার টেবিলে কাগজ-কলমের মধ্যে ডুবে যাবার কারণে নিপাট নিস্তব্ধতা বিরাজ করত। মফিজউদ্দিন সাহেব ছিলেন দিলখোলা মানুষ। লেখার মাঝে মাঝেই জোরেজোরে জানান দিতেন, দু’শ’ হয়েছে, তিনশ’ হয়েছে। তার মানে তার দু’-তিনশ’ শব্দ কমপ্লিট হয়েছে। মাঝে মাঝে চা-নাস্তা খাবার ফাঁকে অনুুচ্চ গল্প করতে করতে হা হা করে অট্টহাসি দিতেন।
অফিসের শুরুতে একদিন মহিউদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, পত্রিকায় কিন্তু বসিং নেই। এখানে সবাই সবার ভাই। অন্যদের মতো তাকেও তাই ‘ভাই’ সন্বোধন করেছি।

একটা কথা মনে পড়ছে। একদিন যথারীতি কাজ করছি, এমন সময় ওই ভবনের আর্কিটেক্ট মহোদয় এসে বললেন, এত সুন্দর একটা ড্রয়িংরুম করেছি, কী অবস্থা করেছে এর? নিজের নকশায় তৈরি করা ড্রয়িংরুমে এতগুলো টেবিল আর মানুষ দেখে তার শিল্পীসত্তা আহত হয়েছিল হয়তো।
যাক, খুব বেশি দিন যায়নি, ইনকিলাব তার নিজস্ব বভন আর. কে. মিশন রোডে উঠে আসে। এই ভবনে সবার পর্যাপ্ত জায়গা হয়। সম্মানিত সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন সাহেব নিজস্ব রুমে নিয়মিত অফিস করতে শুরু করেন। এখানে এসে কিছু দিন এডিটোরিয়াল সেকশনে বসেছি। ফিচারের আলাদা রুম হলে সেখানে বসতাম। এখানে ফিচার সম্পাদক আব্দুল গফুর সাহেব, সাহিত্য সম্পাদক হাসানাইন ইমতিয়াজ সাহেবসহ আরও কয়েকজন বসতেন। পরবর্তী সময়ে এডিটোরিয়ালে কাজ করার সুযোগ লাভ করি। তখন আবার টেবিল চলে আসে এডিটোরিয়াল সেকশনে।

মহিউদ্দিন সাহেব সম্পর্কে একটু বলি। মনে হয়, তার অতিন্দ্রীয় একটা ক্ষমতা ছিল। মাঝে মাঝে কিছু কথা বলতেন, যা আমার বোধের অগম্য। কারণ, চেতনার ওই স্তর সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।

এই অফিসে মাওলানা রূহুল আমীন খান সাহেবের আলাদা রুম ছিল। আমি সম্পাদকীয় মিটিংয়ে রূহুল আমীন খান সাহেব আর এ কে এম মহিউদ্দিন সাহেবের সুগভীর আলোচনায় জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছি। যেমন থাকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী।
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকা প্রকাশনা জগতে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল। যোগ্য, অভিজ্ঞ, শক্তিশালী একটি টিম কাজ করেছিল পত্রিকা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে সঠিক দিকনির্দেশনা, দক্ষ পরিচালনা ও যোগ্য কর্মীদল প্রতিষ্ঠানকে অনেকদূর এগিয়ে নেয়। সেটা ইনকিলাবের ক্ষেত্রে হয়েছিল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন