শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হঠাৎ পদ্মার ভাঙন

মানিকগঞ্জে দিশেহারা পদ্মা পাড়ের মানুষ : ফরিদপুরে নদীগর্ভে বিলীন ৩শ’ মিটার এলাকা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৬ জুন, ২০২১, ১২:০১ এএম

হঠাৎ করে পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হয়েছে। ফরিদপুরে একদিনে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ৩শ’ মিটার এলাকা। হুমকির মুখে রয়েছে দুটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষের চলাচলের একমাত্র সেতু ও শহর রক্ষা বাঁধ। যে কোনো সময় ধসে যেতে পারে বসতভিটা, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল, বাজারসহ বহু স্থাপনা। নদী ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

এদিকে, দিনের পর দিন পদ্মার ভাঙনে ছোট হয়ে আসছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার মানচিত্র। প্রতি বছরের নিয়মিত পদ্মার ভাঙনকে এক প্রকার নিয়তি হিসেবেই মেনে নিয়েছে পদ্মা পাড়ের মানুষ।
স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে হঠাৎ করে ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিগ্রিরচর ও নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে ভাঙনের ভয়াবহতায় বিলীন হয়ে যায় প্রায় ৩শ’ মিটার এলাকা। এসময় ভাঙনের কারণে ফসলি জমিও পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। হঠাৎ করে ভাঙন দেখা দেয়ায় আতংক বিরাজ করছে নদীপাড়ের মানুষের মধ্যে। ভাঙন কবলিত এলাকার এক নারী বলেন, এখন পর্যন্ত ৬-৭ বার আমাদের বাড়ি ঘর নদী ভাঙনে শেষ হয়ে গেছে। এখন আবার ভাঙন শুরু হয়েছে। এবার যদি বাড়ি-ঘর নদীতে চলে যায়, তাহলে আমাদের আর থাকার কোনো জায়গা নেই। সেখানকার বাসিন্দারা বলেন, নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তারপরও সরকার কিছুই করছে না। নদী ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর প্রতিও দাবি জানান তারা। এদিকে ইউনিয়ন দুটির হাজারো মানুষের সম্পদ রক্ষায় ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে সরকারি সহযোগিতা চেয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
ডিক্রিরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান মিন্টু বলেন, যেভাবে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। তাতে আমার এলাকার যে ব্রীজটা আছে সেটা আর টিকবে না। এখনই নদী ভাঙন রোধ করা না গেলে তা টেপাখোলা ইউনিয়ন পর্যন্ত চলে যাবে। নর্থ চ্যানেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মোস্তাক বলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন মাল রক্ষার জন্য নদী ভাঙন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি আমাদের। পদ্মা নদীর ভাঙনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা। নদী ভাঙন রোধে দ্রুত কাজ শুরু করার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
অন্যদিকে প্রতি বছরই পদ্মার ভাঙনে গৃহহীন হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর এলাকার পদ্মাপাড়ের শতাধিক পরিবার। বছরের শুরু এবং শেষ দিকে ভাঙন থাকলেও এবার ভাঙন শুরু হয়েছে কিছুটা সময় আগেই। এরই মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়েছে ১০টি পরিবার। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষার তাগিদে ঘর-বাড়ি স্থান্তরের কাজেও ব্যস্ত কিছু পরিবার। অসময়ের পদ্মার ভাঙনে দিশেহারা পদ্মা পাড়ের মানুষ। পদ্মার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেতে গাছ-গাছালি থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিচ্ছে অনেকেই। কোন ত্রাণের চাহিদা নেই পদ্মা পাড়ের মানুষের। ত্রাণ না পাওয়ায় নেই কোন হতাশাও। তবে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান হরিরামপুর উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কয়েক হাজার বাসিন্দা।

ভাঙন নিয়ে আলাপকালে কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কোট কান্দি গ্রামের অস্থায়ী বাসিন্দা নূর ইসলাম প্রামাণিক জানান, সাত বারের ভাঙনে এখন নিঃস্ব তিনি। পারিবারিক অভাব অনটন সামলে সাধ্য হয়নি নতুন করে ভিটেমাটি ও ঘর-বাড়ি করার। তাই দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে কোট কান্দি এলাকায় শ্যালিকার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে এবার সেই বাড়িও ভাঙনের কবলে থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

একই এলাকার বৃদ্ধ তাউজুদ্দিন মিয়া (৭০) বলেন, জীবনের সব সঞ্চয় এখন পদ্মার পেটে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে পদ্মার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছি। তবে এবারের পরিস্থিতিতে পরাজিত হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। উপজেলার কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের কুশিয়ারচর এলাকার বারেক গাজি জানান, কয়েকদিনের ব্যবধানে বিলীন হয়ে গেছে তার ১০জন প্রতিবেশীর বসত বাড়ি। এবার তার পালা। পদ্মার ভাঙন থেকে ঘরসহ প্রয়োজনীয় জিনিস রক্ষায় সব সরিয়ে শূণ্য করে রেখেছি ভিটে মাটি। যে কোন মুহূর্তে জীবনের শেষ সম্বলটুকুও পদ্মার পেটে চলে যাবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। হাফিজা খাতুন (৭৫) জানান, বিয়ের সময় কৃষি জমি এবং গৃহস্থলিসহ বড় পরিবার ছিলো তার। কয়েক দফার ভাঙনে বেশ কিছু বছর আগেই পদ্মার পেটে চলে গেছে সব কৃষি জমি। এবার ভিটেমাটি শূণ্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে দিশেহারা তিনি।

কাঞ্চনপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ড সদস্য মো. জিয়া বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে হুট করে পদ্মার পানি বাড়তে শুরু করে। এরপর থেকেই ভাঙন শুরু হয়। এরই মধ্যে প্রায় ৩০ বিঘা কৃষি জমি ও ১০টি বসত ভিটে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের কবলে রয়েছে আরও শতাধিক বসত ভিটে। তিনি জানান, কাঞ্চনপুর ইউনিয়নে আগে ১৩টি মৌজা ছিলো। এখন আছে মাত্র একটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্থায়ীভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করলে সেটিও নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। তাই পদ্মা পাড়ের মানুষদের জান-মাল রক্ষায় ত্রাণ না দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকোশলী মাইনুদ্দিন বলেন, পদ্মার ভাঙন রোধে হরিরামপুর উপজেলার বাহাদুরপুর থেকে কাঞ্চনপুর এলাকা পর্যন্ত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। করোনার জন্য কাজে কিছুটা দেরি হচ্ছে। তবে ভাঙন এলাকায় খুব অল্প সময়ের মধ্যে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন