বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাঘব বোয়াল ছাড় পাচ্ছে ‘নন-সাবমিশন’ মামলায়

হয়রানির শিকার নিরীহরা

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

গুরু অপরাধ করলেও মামলা হচ্ছে লঘু ধারায়। দুর্নীতি না করেও এ ধারায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন নিরীহরা। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের আড়াল করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কোনো কোনো কর্মকর্তা আশ্রয় নিচ্ছেন এই কূটকৌশলের। নিরীহদের নানাভাবে হয়রানি করছেন তারা। কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে পাড় করে দিচ্ছেন রাঘব বোয়ালদের। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি অনুসন্ধান ও মামলায় বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য। তবে দুর্নীতি বিরোধী এক মাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থাটিকে বিগত সময়ে সৃষ্ট ধারণার এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে মর্মে বর্তমান কমিশনের কাছে প্রত্যাশা বিশ্লেষকদের।

কেস স্টাডি (এক) : স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির মাফিয়া ডন মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। ২০১৩ সালে মিঠু এবং তার স্ত্রী রংপুর হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী নিশাত ফারজানা ছিলেন অনুসন্ধানটির বিষয়বস্তু। অনুসন্ধান চলাকালে মিঠু দম্পতির তথ্য-উপাত্ত চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি দেন দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তা। ওই চিঠির বিরুদ্ধে রিট করে মিঠু থামিয়ে দেন দুদকের অনুসন্ধান। চার বছর আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৭ সালে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। ফের অনুসন্ধান শুরু হলে দুদকের অভ্যন্তরে থাকার মিঠুর শুভাকাঙ্খী কর্মকর্তারা ফাইলটি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। আশ্রয় নেন কূটকৌশলের। মিঠুর অনুসন্ধান ফাইলটিতে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া পুরনো একটি নথির নম্বর ফেলে ধামাচাপা দেয়া হয় স্বাস্থ্যখাতের বিশাল এ দুর্নীতি। প্রেষণে আসা প্রশাসন ক্যাডারের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে সে সময় সুরক্ষা দেয়া হয় মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে। ২০২০ সালে করোনা শুরু হলে ফের আলোচনায় আসে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি। এ সময় মাস্ক কেলেঙ্কারির সূত্র ধরে ফের অনুসন্ধান শুরু হয় মিঠুসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে। ততোদিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন মিঠু। নতুন শুরু হওয়া অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় মিঠুকে তলব করা হলে তাচ্ছিল্যভরেই এড়িয়ে যান। অদ্যাবধি কিছুই হয়নি মিঠুর।

কেস স্টাডি (দুই) : নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সি সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে। ‘অনিক ট্রেডার্স’ এবং ‘আহমেদ এন্টারপ্রাইজ’ নামক দু’টি প্রতিষ্ঠান খুলে স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে সাজ্জাদ। অভিযোগ রয়েছে, মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং আসবাব সরবরাহ দেখিয়ে তিনি হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। সর্বশেষ ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের পর্দা কেলেঙ্কারির সঙ্গে মুন্সি সাজ্জাদের সংশ্লিষ্টতা মেলে। ব্যবসার আড়ালে দুর্নীতিলব্ধ অর্থে নামে-বেনামে তিনি অর্জন করেন বিপুল সম্পদ। নামে-বেনামে গড়ে তোলেন বেশ কিছু কাগুজে প্রতিষ্ঠান। মিঠুর প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে তার দুর্নীতিও বেশুমার। মুন্সি সাজ্জাদ এবং তার স্ত্রী ফারজানা হোসাইনের বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করে দুদক। অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয় বহির্ভুত বিপুল সম্পদের সন্ধান মেলে। এ প্রেক্ষিতে এই দম্পতির সম্পদ বিবরণী চায় দুদক। কিন্তু তারা সম্পদ বিবরণী দাখিল করেননি। তার বিরুদ্ধে ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের ২৬(২) ধারায় পৃথক দু’টি ‘নন-সাবমিশন’ মামলা দায়ের করেন। মামলার বাদী তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান। অথচ তাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির মূল অভিযোগটি (জ্ঞাত আয় বহির্ভুত সম্পদ অর্জন) মামলা অবধি গড়ায়নি। বরং মুন্সি সাজ্জাদ হোসেন নিজে নেপথ্যে বেনামী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এখন সরকারের বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে ব্যবসার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কেস স্টাডি (তিন) : ২০১২ সালে ননীগোপাল নাথের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মেলে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাবতীয় সম্পদের হিসাব চেয়ে তাকে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ দেয়া হয়। নোটিশ পাওয়ার পরও তিনি সম্পদ বিবরণী দাখিল করেননি। পরে দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মো. মুজিবুর রহমান তার বিরুদ্ধে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা ঠুকে দেন। চাপা পড়ে যায় তার জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের মূল অভিযোগটি।

দুদক সূত্র জানায়, এ প্রক্রিয়ায় আইনের ফাঁক-ফোঁকড়ে ছেড়ে দেয়া হয় রাঘব বোয়ালদের। বেনামী অভিযোগের ‘অনুসন্ধান’ দেখিয়ে হয়রানি করা হয় নিরীহদের।

দুদকের মহাপরিচালক (লিগ্যাল) হিসেবে অবসরে যাওয়া সিনিয়র জেলা জজ মঈদুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ২৬ (২) ধারা অনুযায়ী সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ২৭(১) ধারা অনুযায়ী জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জন করলে সর্বনিম্ন ৩ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদও বাজেয়াপ্ত করার বিধান আছে। কিন্তু আইনটির ২৬(২) ধারা প্রয়োগ করে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা করে অনেক সময় ২৭(১) ধারাটি এড়িয়ে যাওয়া হয়। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়। তিনি বলেন, অসৎ চিন্তা থেকে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ ধরণের কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, নন-সাবমিশন মামলা দায়েরের সঙ্গে জ্ঞাত আয়বহির্ভুত সম্পদ অর্জনের মামলাও অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেটি প্রয়োগ না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়ার কথা।

দুদকের আইনজীবী প্যানেলের সাবেক সদস্য ব্যারিস্টার আকবর আমীন বাবুল বলেন, দুদকে আইনের সুষম প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিগত কমিশনের সময় সংঘটিত কয়েকটি ঘটনার কারণে প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। বর্তমান কমিশনের প্রধান কাজ হবে সেই ধারণাটি ভেঙে দেয়া। প্রতিশোধপরায়ণতার বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে পেশাদারিত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠা করা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (11)
Md Riyaz ৬ জুন, ২০২১, ১:২০ এএম says : 0
দুর্নীতিবাজ রক্ষা কমিশন।
Total Reply(0)
Saiful Islam ৬ জুন, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
অভিযোগ করলে ১৬ কোটি মানুষের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ করা যাবে। সোনার বাংলার ১৬ কোটি মানুষই দুর্নীতির সাথে জরিত। এক মেকার ১০ টাকার পার্টস আমার কাছে ৩০০ টাকা নিয়েছে ।
Total Reply(0)
Robiul Islam ৬ জুন, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
আগে দুদকের কর্মকর্তাদের বিচার শুরু হোক তাদের দুর্নীতি নিয়ে বিচার শুরু হোক তারপর দেশে অটোমেটিক দুর্নীতি কমে যাবে
Total Reply(0)
লোকায়ত নিলয় ৬ জুন, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
আমার এক বান্ধবী দুদকের চাকরিতে উত্তীর্ণ হয়। পরে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করে দুদক। তার সেই সামর্থ ছিলো না আর চাকরি ও হয়েনি। এ হল দুদক
Total Reply(0)
বাংলা আর্কাইভস ৬ জুন, ২০২১, ১:২৭ এএম says : 0
দুদুক শুধু আওয়ামী লীগ নেতাদের সম্পদ খোঁজ করলেই কয়েকটা পদ্মা সেতুর বানানোর খরচের সমান দূর্নিতির টাকা খোঁজে পাবে।
Total Reply(0)
Zillur Rahaman ৬ জুন, ২০২১, ১:২৭ এএম says : 0
দুদুক যা করে তা শুধুই লোকদেখানো ভেলকিবাজি ও আইওয়াস মাত্র। আবদুল হাই বাচ্চু, পি কে হালদারদের কিছুই হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না। রুই কাতলাদের কিছুই হয় না, যতোসব পুটিমাছদের নিয়ে টানাটানি।
Total Reply(0)
Animesh Halder ৬ জুন, ২০২১, ১:২৮ এএম says : 0
সরকারি অফিসগুলোতে ঘূষ মোটামুটি ওপেন সিক্রেট | বিমান , রেল , বিদ্যুৎ , গ্যাস , ওয়াসা - কোন প্রতিষ্ঠান লাভ এ আছে ? কোনটি না | সিবিএ নেতা , তৃতীয় শ্রেণীর কর্মীচারী থেকে বস , সবাই কোটিপতি | আর এদের অনেকের বেশ ভূষা দেখলে মনে হয় এইমাত্র বেহেস্ত থেকে নেমে এসেছে | এই সকল সংস্থার ৯০% এর বেশী চোর - দুর্নীতিবাজ |
Total Reply(0)
Rakibul Hasan Shuvo ৬ জুন, ২০২১, ১:২৯ এএম says : 0
দুদকের কাজ হলো ক্রিমিনাল দের ওয়াশিং মেশিনের ন্যায় পরিষ্কার করে আবার ময়লা কাজে ছেড়ে দেয়া।। এভাবেই ক্রিমিনাল রা বৈধতা পায়
Total Reply(0)
Muhammad Israfil ৬ জুন, ২০২১, ১:২৯ এএম says : 0
বাংলাদেশের দুদুক যদি ঠিক হয় তাহলে ৫০% দুর্নিতী কমে যাবে।। দুদকের মধ্যে ঝামেলার লোকজন বেশি। সুতরাং দুদককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো উন্নত ও গতিশীল করতে হবে।
Total Reply(0)
Md Jalil Chy ৬ জুন, ২০২১, ১:৩০ এএম says : 0
দুর্নীতি দমন অভিযানের ভিতরেই এই দুদক কি পরিমাণ টাকা গ্রাহক থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে তার প্রতি সরকারের কোন নজরদারিও নেই। আর হটলাইন পট লাইন এগুলো হচ্ছে লোক দেখানো মাত্র।
Total Reply(0)
পারভেজ আলম ৬ জুন, ২০২১, ১:৩০ এএম says : 0
বাংলাদেশের যদি কোন সংস্থাকে বেকার অথবা অকার্যকর হিসেবে বাছাই করা হয় তাহলে এক নাম্বারে দুদক থাকবে
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন