ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
মানুষ সাম্য চায়, তাই বৈষম্য শব্দটি তাদের কাছে খুবই অপ্রিয়। বৈষম্য বিষয়টি খুবই অমানবিক, তাই তো আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বাণী উচ্চারণ করেছেন তার কবিতায়। বর্তমান সময়েও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কথা বলতে দেখা যায়, ইউরোপের রাষ্ট্রনেতারাও বেশ সোচ্চার। তবে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে প্রশ্ন জাগে, খোদ ইউরোপ কি বৈষম্যমুক্ত হতে পেরেছে? ‘ইউরোপে চরম বৈষম্যের শিকার মুসলিম নারীরা।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস ‘বুরকিনি’ প্রসঙ্গে নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চেয়েছে। ফ্রান্স, বেলজিয়ামসহ আরো কিছু দেশের এক হাজারের বেশি নারী তাদের মতামত দিয়েছেন, যাতে উঠে এসেছে পোশাকের চেয়েও গভীর অনেক বিষয়। ইউরোপের বিভিন্ন অংশের মুসলিম নারীরা প্রতিদিনের জীবন-যাপনকে একটি যুদ্ধ কিংবা সংগ্রাম হিসেবে অভিহিত করেছেন। ফ্রান্সে জন্মেছেন এবং বেড়ে উঠেছেন এমন অনেকেই জানিয়েছেন, তাদেরকে শুনতে হয় ‘বাড়ি ফিরে যাও’ এমন তির্যক বক্তব্য।
প্যারিসের উপকণ্ঠে পাতিনে বসবাসকারী শিক্ষিকা তাসলিমা আমর (৩০) বলেছেন, আমাদের বছরের পর বছর নোংরা ও অশালীন চাহনি ও হুমকি সহ্য করতে হয়েছে। অথচ আমরা স্থায়ী বাসিন্দা। আমাকেও বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তাসলিমা তার পরিবার নিয়ে ফ্রান্স ত্যাগ করার কথা ভাবছেন। এদিকে ৩২ বছর বয়ষ্ক লরি আবুজেইল জানিয়েছেন, তিনি এখন ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর তোলাউসে একটি বেবিকেয়ার হোম খোলার চিন্তা করছেন। কারণ এতে তাকে বাড়ির বাইরে যেতে হবে না এবং তার হিজাব নিয়ে কেউ কটূক্তি করবে না কিংবা বাধা দেবে না।
এদিকে বেলজিয়ামের জেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দিনা স্রজি বলেছেন, যখন বুরকিনি বাজারে এসেছে আমি খুবই খুশি হয়েছি। কারণ আমার বোন ছুটিতে তার সন্তানদের নিয়ে দ্বীপে সময় কাটাতে পারবেন। বুরকিনি নিয়ে এতসব নাটকের শুরুতে আমি ভেবেছি, এটা বড় কিছু নয়। ক্ষুদ্র মানসিকতার কিছু লোকের ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা মাত্র, যারা কখনই কল্যাণকর কিছু করতে পারে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পুরো ইউরোপই আমাদের বিপক্ষে চলে গেছে। এটা কেমন আধুনিক যুগ, যেখানে উলঙ্গপনাকে গ্রহণ করা হবে কিন্তু সৈকতে শরীর আবৃত করা যাবে না। ফ্রান্সের লিওন শহরের বাসিন্দা হাজের জেননৌ নিস শহরের সমুদ্র সৈকতে বুরকিনি পরা এক মহিলার সাথে পুলিশের দুর্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এ ঘটনায় আমার স্কুলের প্রথম দিনটির কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন শিক্ষক, অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে আমাকে হিজাব খুলতে বাধ্য করেছিলেন। আমাকে অপদস্ত করা হয়েছিল। আজ আমি আবারও মর্মাহত হলাম। এই মহিলাকে তার পোশাক খুলতে বাধ্য করা দেখে নিজেকেই প্রশ্ন করলাম এসব কবে শেষ হবে?
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বৈষম্য পীড়িত মুসলিম নারীদের যে যন্ত্রণার কথা ফুটে উঠেছে তাতে আমাদের মনেও প্রশ্ন জেগেছে, ইউরোপে বৈষম্যমূলক এসব অনাচার কবে দূর হবে? সাম্য ও মানবতার কথা বলতে ভালো লাগে, শুনতেও ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে এ বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে যে সততা ও উদারতা প্রয়োজন তা এখনও ইউরোপে অনুপস্থিত। বস্তুনিষ্ঠভাবে ইউরোপীয় সমাজকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে শুধু রঙের বর্ণবাদ নয়, বহুমাত্রিক বর্ণবাদের উপস্থিতি রয়েছে, ধর্ম-বিদ্বেষ যার একটি অন্যতম উপাদান। আমরা জানি, ইউরোপের নেতারা চাতুর্যে এবং কূটনীতিতে অনেক প্রাগ্রসর। কিন্তু এমন প্রাগ্রসরতা দিয়ে তো স্বদেশের বহুমাত্রিক বর্ণবাদ দূর করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সাফল্য পেতে হলে ইউরোপে প্রয়োজন ন্যায়ের চেতনা এবং নৈতিক মেরুদ-। এ দু’টি বিষয়ে ইউরোপ সমৃদ্ধ না হলে ইউরোপে মুসলিম নারীরা হয়তো বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে সহসা মুক্তি পাবে না।
য় লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল’ ইয়ার্স ফোরাম
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন