সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় একের পর এক মানুষ মারা যাচ্ছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত তিনশ’ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত এক হাজার। বলা হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিত গতি,অদক্ষ চালক, বেপরোয়া প্রতিযোগিতাই এসব দুর্ঘটনার কারণ। এবছরে এসময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার গত বছরের চেয়ে প্রায় তিনগুণ। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে চারদিকে যখন কান্নার রোল উঠেছে, তখন পরিবহন সেক্টরে শৃ্খংলা আনতে না পারায় এর ব্যর্থতার দায় নিজেই স্বীকার করেছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সফলতা পেলেও দুর্ঘটনা রোধসহ সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে পারিনি। এই ঈদে মৃত্যুর মিছিল দেখা গেছে। এত মৃত্যুতে আমি নিজেও অবাক হয়েছি। তিনি আরো বলেছেন, চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি প্রশাসন। অদক্ষ চালকদের জন্যই ঈদের সময় দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছেÑ যা মৃত্যুর মিছিল বললে ভুল হবে না। এ থেকে উত্তরণের পথ কি তা আমাদের খুঁজতে হবে বলে তিনি জানান। এদিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন খাত চলছে ১৯৩৯ সালের ভারতীয় মোটরযান আইনের পরিমার্জিত রূপ মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ -এর অধীনে। এর পরিবর্তে কঠোর ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের কাজ চলছে গত ছয় বছর ধরে। এত দিনে আইনের খসড়াই চূড়ান্ত হয়নি। অন্য খবরে বলা হয়েছে, ট্রাফিক পুলিশ ‘চোখ থাকিতেও অন্ধ’।
সরকারি হিসেবে যাই বলা হোক না কেন, নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির হিসাব মোতাবেক, চলতি বছরে প্রথম আট মাসেই মৃত্যু হয়েছে দুই হাজার ৩৭৬ জনের। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর কারণ নিয়ে এ পর্যন্ত গবেষণা, আলাপ-আলোচনা এবং সুপারিশও কম হয়নি। কার্যত দেখা যাচ্ছে, এসবে কোন কাজ হয়নি বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা যাক না কেন, মূলত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সড়ক অব্যবস্থাপনাই দায়ী। এবারের কথাই ধরা যাক, ঈদের আগে থেকেই ফেরি জটিলতা দেখা দিয়েছিল। স্থানীয় প্রশাসন শত শত চিঠি লিখেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি করতে পারেনি। এখনও যারা রাজধানীতে ফিরছেন তাদের দীর্ঘ যানজট পোহাতে হচ্ছে। যেপথে ফেরি নেই সে পথও নির্বিঘœ ছিলনা এবং নেই। এই জট পেরুতে যে সময়ের অপচয় হচ্ছে তা মেটাতেই চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠে থাকতে পারে। সেই সাথে প্রাইভেট কারের ব্যাপারটিও এড়িয়ে যাবার নয়। কারণ, তারাও জটের শিকার। দক্ষ চালকের প্রসঙ্গটিও পুরনো। সরকারের একজন মন্ত্রীই এ ব্যাপারে উস্কে দিয়েছিলেন। চালকের দক্ষতার বিষয়টি অনেকাংশে মালিকের নিয়োগের উপর নির্ভরশীল। যে ধরনের চালক তিনি নিয়োগ দিতে চান সে ধরনের চালকই পাবেন। বলার অপেক্ষা রাখেনা, আমাদের দেশের চালকরা একদিকে যেমন বিদেশে সুনামের সাথে গাড়ী চালাচ্ছে তেমনি এদেশেও অনেকেই বিদেশীদের সাথে সুনাম ও দক্ষতার সাথে গাড়ী চালাচ্ছে। মূলত একথা স্বীকার করতেই হবে, এখাত যেভাবে নির্লজ্জ দলবাজির শিকার তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দুর্ঘটনার মধ্যদিয়ে। পরিবহন মালিক-শ্রমিক সব মিলে যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, তারই মাশুল দিচ্ছে জনগণ। একেবারে সড়ক পরিবহনের গাড়ী আমদানি থেকে শুরু করে সড়কে চলা পর্যন্ত সবকিছুই পরিচালিত হচ্ছে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। এখানে প্রশাসন অসহায়। আইন-কানুন যা কিছুর কথা বলা হচ্ছে, তা সবই লোক দেখানো। ব্যাপারটি যে কেবল এখাতে বা সড়কেই ঘটছে তা তো নয়। রেলের কথাই ধরা যাক, সেখানে ৮০ভাগ আসন দখল করে রেখেছে সরকারি লোকজন। সর্বত্রই চলছে লুটপাটের মচ্ছব। অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমন, জনগণের কথা বলে জনগণের ঘাড়ে চেপে সর্বত্রই চলছে লুটপাট। এর মূল কারণ দায়িত্বহীনতা এবং জবাবদিহিতার অভাব। অন্যদিকে এক ধরনের একাধিপত্যের প্রভাব।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীকে ধন্যবাদ, কারণ তিনি সত্য স্বীকার করেছেন। অনেকেই যখন দায় নিতে অস্বীকার করছে সে সময়ে তিনি অন্তত সত্য স্বীকার করেছেন। তবে এতটুকুই একদিকে যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনি এথেকে জনগণের উপকার পাবার মতও কিছু ঘটেনি। এটা সকলেই স্বীকার করবেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যান তারাতো চলেই যান, যারা জীবিত থাকেন তারা বাকি জীবন জীবনের দুর্বিষহভার বহন করে চলেন। এসব দুর্ঘটনায় যেসব পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে তাদের দেখার কেউ থাকে না। অথচ পূর্ব থেকে সতর্ক হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয়ত এসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো বা যেত। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এসব দুর্ঘটনায় কে বা কারা দায়ী সে সম্পর্কে কোন তথ্য জনগণ জানেনা। আইনের ফাঁক গলিয়ে দায়ীদের শাস্তি পাবারও কোন অবস্থা থাকে না। এক ধরনের অনৈতিক ঐক্য এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, অবৈধ অর্থের খেলাতেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যায়। প্রকৃত বিবেচনাতে দলীয়করণের বিষবৃক্ষই সবকিছু শেষ করে দেয়। এই বাস্তবতা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। রাষ্ট্রের সবকিছুই জনগণের জন্য। এসব থেকে যদি জনগণ কোন উপকার না পায় বা পাবার মত বাস্তবতা তৈরি না হয়, তাহলে জনগণের লাভ কি? কেবল দায় স্বীকার নয় বরং পরিস্থিতির উত্তরণে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ জরুরি হয়ে দেখা দিয়েছে। এটি কেবলমাত্র সড়ক ও সুনির্দিষ্ট কোন খাতের বেলাতেই নয় বরং সামগ্রিক অর্থে জনগণ যাতে কেবল কর প্রদানকারী হিসেবেই নয় বরং রাষ্ট্রীয়খাত থেকে সুবিধাদিও পেতে পারে তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন