বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি জোরদার করতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ৮ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ভূতাত্ত্বিক ও ভূমির গঠন অনুসারে বাংলাদেশ ভূ-কম্পনপ্রবণ অঞ্চল। বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে একটি হয়েছিল ১৮৬৯ সালে সিলেট অঞ্চলের কাছার এলাকায়। রিখটার স্কেলে এ কম্পনের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬। ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প, ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল, ১৯২৩ সালের দুর্গাপুরের ভূমিকম্পের জন্য বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল আগে থেকেই ভীষণ ঝুঁকিতে। ভূমিকম্পের কারণে সিলেটে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়, যা এখনো রয়েছে। ফাটলগুলো সুপ্ত অবস্থায় আছে।

সম্প্রতি সিলেটের জৈন্তাপুরে এবং জগন্নাথপুরে কম মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এক ঘণ্টার মধ্যে চার দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে সিলেটজুড়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি মানে এই নয় যে, এখানে আর বড় ভূমিকম্প হবে না। তাই এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমানে আমাদের প্রস্তুতি খুবই কম। মাঝারি ও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে দেশ বহুগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মূল কারণ, আমাদের ভবনের সংখ্যা বাড়ছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে চলা। কিন্তু কেবল বিল্ডিং কোড থাকলেই হবে না, প্রয়োজন এর সফল ও সঠিক প্রয়োগ। ২০০৬ সালের বিল্ডিং কোডের সঠিক প্রয়োগ দেশে হয়নি। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মিত হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য তেমন কোনো কর্তৃপক্ষ ছিল না। প্রতিবার বিল্ডিং কোডের নতুন সংস্করণ বের করতে অনেক সময় চলে যাচ্ছে। ভূতত্ত¡বিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে যে কোনো সময় মাঝারি কিংবা উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর পর ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতে আঘাত হানে ৮.৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’। এটা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ-সহ বহু দূরের অঞ্চলে। এতে ঢাকায় প্রায় ৪৫০ জন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এর পর দেশে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল। ১৯৩০ সালের ২ জুলাই ভারতে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে হয় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৫৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের মণিপুরে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভারতের অসমে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সিকিমে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে বাংলাদেশেও তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর, চট্টগ্রামে ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালি দ্বীপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর কাছে ভূমিকম্প হলে তা সাম্প্রতিককালের অন্য সব বিপর্যয়কে ম্লান করে দেবে।’ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎসস্থল থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।

ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের না আছে সচেতনতা, না আছে প্রস্তুতি। বাড়িঘর তৈরিতে কোনো নিয়ম-নীতি মানা হয় না। এমন অনেক বহুতল ভবন তৈরি হয়, যেগুলো ভূমিকম্প ছাড়াই হেলে বা ধসে পড়ে। ভূমিকম্প হলে এসব ভবনের অবস্থা কী হবে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। ডোবা-নালা ভরাট করে প্রয়োজনীয় ভিত্তি ছাড়াই ভবন তৈরি করা হয়। ভূমিকম্পের মতো বড় বিপর্যয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলে। বড় বড় শহরে অপরিকল্পিতভাবে এমন সব গলি-ঘুপচিতে বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে, যেখানে উদ্ধারকারী যন্ত্রপাতি পৌঁছানো যাবে না। যাদের এসব তদারকি করার কথা ছিল তারা কিছুই করে না। তার ওপর রয়েছে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ এবং মাথার ওপর অপরিকল্পিত বিদ্যুতের লাইন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বড় কোনো শহরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবনধসে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডে। তার পরও আমাদের নগর সম্প্রসারণে সঠিক পরিকল্পনা নেই। জানা যায়, ২০১৯ সালে এক জরিপের মাধ্যমে সিলেট শহরের ২৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে সিসিকের মালিকানাধীন কালেক্টরেট ভবন ও লালদীঘির দক্ষিণ পারের পৌর বিপণিকেন্দ্র ভেঙে ফেলে সিসিক। বাকি ২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন এখনো বিদ্যমান।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার যে মানচিত্র রয়েছে তাতে সিলেট ও চট্টগ্রাম উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল। ডাউকি ফল্ট লাইনে থাকা সিলেট অঞ্চলে এর আগে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওপরে থাকা সেই ভূমিকম্পে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কাজেই সিলেট অঞ্চলে নগর পরিকল্পনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে সব ভবনের ভূমিকম্প-প্রতিরোধী সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি আরো শক্তিশালী করতে হবে।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ৮ জুন, ২০২১, ১:৫৩ পিএম says : 0
We need to rule our country by Qur'an and give up all sins then take appropriate precautions then Allah will protect us from natural calamities. InshAllah
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন