স্টালিন সরকার : কাশ্মীর শব্দের অর্থ যদিও শুষ্ক ভূমি; কিন্তু কাশ্মীরকে বলা হয় পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ। সপ্তদশ শতাব্দীতে কাশ্মীর নামকরণ করেন মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর। কাশ্মীরের নৈসর্গিত দৃশ্যে অভিভূত হয়ে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছেন ‘সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূ-স্বর্গ/ দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে/ ডেকেছে রৌদ্রকে/----/ পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর/----/ গলে গলে পড়ছে বরফ/ আন্দোলিত শাল পাইন আর দেবদারু’। মোগল বাদশাহ হুমায়ুন কাশ্মিরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন ‘দুনিয়াতে কোথাও যদি স্বর্গ থাকে/ তবে এই খানে, এই খানে এই খানে’। কাশ্মীরের নৈসর্গিত দৃশ্যের উপমা ভূ-স্বর্গ, স্বর্গের উপত্যাকা কোনো অভিধায় পূণাঙ্গতা পায় না। এমন নয়নাভিরাম কাশ্মীর জ্বলছে দুই মাসের বেশি সময় ধরে। সর্বত্রই বারুদের গন্ধ। স্বাধীকার আন্দোলনে বুলেটের মরছে মানুষ; রক্ত আর রক্ত। ধ্বংসস্তুপে বিপন্ন মানবতা। যখন-তখন গর্জে উঠছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র। সবুজ প্রকৃতি পুরে বিবর্ণ হচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে তরুণ-শিশু-বৃদ্ধ। অথচ বিশ্ববিবেক নীরব! বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে গোটা বিশ্বে যখন রণহুংকার চলছে; মানবতার জয়গান ও জঙ্গী দমনের নামে যখন প্রতিনিয়ত নীতিকথার ‘ছবক’ দেখা হচ্ছে; তখন কাশ্মীর জ্বলছে। পুরছে ঘরবাড়ি, মাঠঘাট শহরবন্দর। বিবর্ণ হয়ে উঠেছে ভূ-স্বর্গের মাটি। মধ্যপ্রাচ্যে আত্মঘাতি বোমা হামলায় দু’জন মানুষ নিহত হলে যারা হায় হায় করে ওঠেন; বিবেকের তাড়নায় সে খবর গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় ছড়িয়ে দেন পৃথিবীব্যাপী। তারা ভারতের কর্তৃপক্ষের নিষ্ঠুর নীতিতে দু’মাসে জম্মু-কাশ্মীরের শতাধিক মুসলিম হত্যা এবং শত শত মুসলিমকে মারাত্মকভাবে আহত করার ‘খবর’ প্রকাশে কুণ্ঠিত হন। জম্মু-কাশ্মীরে মুসলিম নর-নারীর প্রতি হিং¯্র অত্যাচারের খবর প্রচারে এতো কার্পন্য কেন? কাশ্মীরে যদি মুসলিমরা আন্দোলন না হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীরা আন্দোলন করতেন তাহলে কি মিডিয়াগুলো নীরব থাকতো? বিশ্ববিবেকের মুখে তালা ঝুলানো থাকতো! অবশ্য ভারতের ১৭ সেনা নিহত হওয়ার পর কারো কারো সম্বিত ফিরছে।
ইতিহাসে দেখা যায় হরি সিং ১৯২৫ সালে কাশ্মীরের রাজা হন। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা চলে যাওয়ার সময় পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কাশ্মীরের শাসক। ১৯৪৭ সালে ভারত বর্ষ ভাগের অন্যতম শর্ত ছিল ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজারা নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবেন। চাইলে তাঁরা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকাজ চালাতে পারবেন। ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর পাকিস্তান সমর্থিত আদিবাসীরা কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করে। নেহারুর তল্পিবাহক হরি শিং লড় মাউ- ব্যাটেনের মধ্যস্ততায় ১৯৪৭ সালের ২৫ অক্টোবর কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন। বিরোধের সুত্রপাত এখানেই। মুসলমানদের আধিক্য থাকার পরও হরি সিং এর কারণে দুইভাগে বিভক্ত হলো কাশ্মির। আজাদ কাশ্মির এবং জম্মু-কাশ্মির। আজাদ কাশ্মির আন্তর্জাতিক মহলের কাছে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত হিসেবে পরিচিত। বাকী অংশ ভারত নিয়ন্ত্রিত। পাকিস্তানের দাবি আজাদ কাশ্মির স্বাধীন দেশ। আর জম্মু ও কাশ্মির ভারতের দাবি অনুযায়ী তাদের রাজ্য। জম্মু নিয়ে বিতর্ক নেই। যত বিতর্ক কাশ্মিরের শ্রীনগর উপত্যকা নিয়ে। এই ভুখ-ের মানুষ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে মত প্রকাশের সুযোগই পায়নি। ভারত ভাগের পর বসবাসরত মুসলমানরা সামরিক বুটের তলে অধিকার হারিয়েছে। জাতিসংঘ ভারত ভাগের প্রাক্কালে কাশ্মিরের জনগণ মতামত জানতে গণ ভোটের প্রস্তাব করে। দিল্লী সেটা মেনেও নেয়। কিন্তু সে ভোট আর হয়নি। তখন কাশ্মিরের শাসন ছিলেন রাজা হরি সিং; অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা ইসলাম ধর্মের অনুসারী। বাধ্য হয়েই নিয়োগ দেয়া হয় মুসলিম প্রধানমন্ত্রী। তখন থেকেই ভারত-পাকিস্তান দু’পক্ষের সৈন্যরা যেখানে মুখোমুখি হয় সীমান্তরেখায়।
এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে নয়নাভিরাম জনপদের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর অন্যতম। অথচ ভারত অধিকৃত কাশ্মীরবাসীর স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে উত্তপ্ত। যেন অগ্নিগিরির আগুন জ্বলছে। স্বাধীনতাকর্মীদের আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যপক রক্ত ঝড়েছে প্রাণহানি ঘটেছে। কাশ্মীরের মুসলমানদের অধিকার আদায়ের আখাঙ্কাকে দমিয়ে রাখতে না পারলেও হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘৃণা-লজ্জা ও বেঈমানীর তিলক একে দিয়েছে দিল্লীর শাসকদের কপালে। সর্বশেষ গত ৮ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর গুলিতে হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ালি নিহত হওয়ার পর সমগ্র পশ্চিম ও উত্তর কাশ্মীর জুড়ে পুলিশ-জনতার মধ্যে সোয়া দুই মাস ধরে চলছে ব্যাপক সংঘাত-সংঘর্ষ। এতে প্রায় শতাধিক প্রাণহানি এবং ১২ হাজার মানুষ আহত হয়। ওই অঞ্চলের প্রধান মসজিদগুলো বন্ধ এবং ১০ জেলায় কার্ফিউ জারি করেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়নি। বরং সময়ের বিবর্তনে পরিস্থিত জটিল থেকে আরও জটিলতর করে করছে। কাশ্মীরের শিক্ষিত তরুণ-যুবকরা রক্ত দিয়েও এখন আন্দোলনমুখী। তাদের একটাই দাবি-কাশ্মীরের আজাদী। এর আগেও ২০১০ সালেও দীর্ঘ ৪ মাসের আন্দোলনে এ অঞ্চলে ১১০ জন তরুণ নিহত হয় ভারতীয় বাহনীর গুলিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তান্ডব ও দিল্লীর শাসকদের নিষ্ঠুর নীতির প্রতিবাদ করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছেন তারিক হামিদ কারা নামে এক এমপি। কাশ্মীরে মুসলমানদের ওপর অব্যাহত জুলুম-নির্যাতনের ভারত সরকারের নীতিকে ‘নিষ্ঠুর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর মধ্যেই গত ১৭ সেপ্টেম্ব পাকিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া উত্তর কাশ্মীরের বারামুলার উরি সেক্টরের সেনা ব্রিগেডের সদর দপ্তরে হামলায় ভারতের ১৭ সেনা সদস্য ও ৪ হামলাকারী নিহত হয়। কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর নির্যাতনকারী ভারতের সৈন্য নিহত হওয়ার পর কারো কারো কানে পানি গেছে। ভারত কার্যত যুদ্ধের দাদামা বাজাচ্ছেন। পাল্টা জবাব দিয়েছে পাকিস্তানও। কাশ্মীরের বারুদের উত্তপ্ত বাজার এখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।
১৯৪৭ সাল থেকেই কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থান করলেও সৈন্য সংখ্যা ব্যাপক ভাবে বাড়ানো হয় ১৯৮৯ সালে। কাশ্মীরের শাসক সিকিমের শাসক লেন্দুপ দর্জির মতো দিল্লী মুখী হওয়ায় তখন থেকেই শেখ আব্দুল্লাহ পরিবারের প্রভাব হ্রাস পায়; তীব্রতর হয় স্বাধীনতার দাবী। সে দাবী এখন প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আর আন্দোলন ঠেকাতেই ভারতীয় সৈন্য সংখ্যা বাড়ছেই। কাশ্মীর জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান অথচ হিন্দুরাজা হরি সিং মুসলিম নাগরিকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতে যোগ দিয়ে অগ্নিগর্ভ করে তোলেন নয়নাভিরাম কাশ্মীর উপত্যাকা। কাশ্মীরের ঘরে ঘরে এখন দুর্গ। নির্যাতিত মানুষ চায় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। উপত্যাকা নিয়ন্ত্রণে ভারতের এখন মুল ভরসা বুলেট, মিশিন গান, ট্যাংক, হেলিকপ্টার গানশিপ ও সাঁজোয়া গাড়ি। ভারত বিশ্বজুড়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ প্রচার করলেও কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার শক্তি দিয়ে দাবিয়ে রাখছে নিষ্ঠুরভাবে। কাশ্মীরীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদ ও তাদের স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়ামস চমস্কি ও ভারতের জনপ্রিয় লেখক অরুন্ধতী রায়। শুধু তারাই নন, ভারতের নাককরা ৫২ জন বুদ্ধিজীবী খোলা চিঠি লিখে কাশ্মীরের জনগণের ওপর জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অরুন্ধতী রায় নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসন চলছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরের মানুষকে। কাশ্মীরে বর্তমানে যে সংকট চলছে তার সামাধানের একমাত্র পথ তাদের স্বাধীনতা। নোয়াম চমস্কিসহ বিশ্বের ৫২ বুদ্ধিজীবী কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনী নির্যাতনের প্রতিবাদ করে খোলা চিঠি দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন দুঃখজনক হলো কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইরত তরুণদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করছে ভারত সরকার। ভারতের দাবি কাশ্মীরে যারা লড়াই করছে তারা সবাই জঙ্গী। কার্যত পাকিস্তানে পাকিস্তানপন্থীদের তৎপরতা থাকলেও সেখানে সরাসরি কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইকারীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতের একজন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছে। কিন্তু আন্দোলনকারীদের বিপরীতে কড়া জবাব দেবার মতো সামরিক শক্তি এবং পরিকল্পনা তৈরি করেনি নরেন্দ্র মোদির সরকার।
১৭ সেনা সদস্য নিহত হওয়ার পর দিল্লীর নীতিনির্ধারকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে উপস্থিত ভারতের প্রতিনিধিরা উরি হামলার জন্য পাকিস্তানকে দোষারোপ করলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন মন্ত্রীদের। তবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ কাশ্মীরে ভারত সরকারের ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ প্রতিরোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আবার যুদ্ধ ছাড়া কাশ্মীর ইস্যু সমাধান সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের হিজবে ইখতেলাফের প্রধান খুরশিদ শাহ। তিনি বলেন, কাশ্মীর ইস্যু সমাধানের জন্য কূটনৈতিক মহলকে যে করেই হোক সফল হতে হবে।
কাশ্মীর ইস্যুতে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠলো পাকিস্তান ও ভারতের রাজনীতি। পাকিস্তান ও ভারতের বিদেশ নীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি সবকিছু কার্যত কাশ্মীর কেন্দ্রীক দীর্ঘদিন থেকেই। তাদের সবকিছু নির্ধারিত হয় কাশ্মীর ইস্যু প্রাধান্য দিয়ে। আবার দেশ দুটির পাশাপাশি চীন, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপের নানা দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের কূটনৈতিক ও সমরনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করছে কাশ্মিরের সংঘাত ও পরিস্থিতি মাথায় রেখেই। কাশ্মীরে এখন শুধু ভারত ও পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের তৎপরতা নয়; পরাশক্তি আমেরিকা, রাশিয়ার গোয়েন্দা তৎপরতাও সেখানে ব্যপক। এসব তৎপরতা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপন্ন করে তুলেছে। এশিয়ায় পাকিস্তান ও ভারত দু’দেশই পরাশক্তি। তবে পশ্চিমাদের চীন ঠেকাও নীতির সুযোগ নিয়ে ভারত উদীয়মান বিশ্বশক্তির দাবিদার।
দক্ষিণ এশিয়ার ভৌগলিকগত কারণেই সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক শক্তি ভারত। ভারত মহাসাগরে দেশটির দাপট বাড়ছে ক্রমান্বয়ে। ইরান-ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্ক এবং ইরানের বন্দর ও অবকাঠমোতে ভারতের বিনিয়োগ আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে গেছে। ইরান-ভারত বন্ধুত্ব নিবীর হয়েছে। বিপরীতে চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব অতি পুরনো। এটা পশ্চিমের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে গেছে। আন্দামান-নিকোবর পর্যন্ত ভৌগলিক বিস্তৃতি মহাসাগরে ভারতকে কৌশলগত সুবিধার পাশাপাশি সামরিক ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা দিয়েছে। ইরানের বন্দরে ভারতের উপস্থিতি পারস্য উপসাগরে ভারতের অধিগম্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে মিত্রতা মধ্য এশিয়ায় অধিগম্যতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে চীন এখন আর পীত সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর এবং জাপানের পার্শ্ববর্তী প্রশান্ত মহাসাগর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। শিল্পে সমৃদ্ধ চীনের অর্থনীতি আরো বাজার চায়। নতুন বাজারগুলোতে প্রবেশের লক্ষ্যে ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি চীনের জন্য জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে চীনের কাছে খুবই জরুরি হলো মিয়ানমার ও পাকিস্তান বন্ধুত্ব রক্ষা। এই দুটো দেশ দিয়ে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে চীন। এ জন্যই পাকিস্তানের প্রতি চীনের পক্ষপাত ও আগ্রহ সব সময় ছিল আছে এবং থাকবে। বেলুচিস্তানের বন্দরে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে পারস্য উপসাগরে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। আর চীন-পাকিস্তান অবকাঠামোগত সম্পর্কের জন্য কাশ্মীর জরুরি ভূখ-। ফলে ভারত মহাসাগরে প্রাধান্যবিস্তার ও উপস্থিতির প্রতিযোগিতার কেন্দ্র থেকে সরছে না কাশ্মির। এ জন্যই পশ্চিমের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির কাছে কাশ্মীর বিশেষ ইস্যু। এই বিষয়টি অনুধাবন করলে বুঝা যায় চীন-ভারত, চীন-পাকিস্তান, রুশ-ভারত, রুশ-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান এবং অন্য ইউরোপীয় ও এশীয় দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সামরিক। জনকেরি ও সুষমা স্বরাজের দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতে সামরিক ঘাটি ব্যবহারসহ সবকিছুই করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া পেতে দিল্লী চুক্তির মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্বের মুসলেকা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যতই কাছাকাছি আসুক কাশ্মীর ইস্যুতে কখনো যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পক্ষ্যে একচোখা নীতি অবলম্বন করবে এটা যারা ভাবেন তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
কাশ্মীর জ্বলছে। নিত্যদিন গুলির শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। তারপরও স্বাধীকার আন্দোলন চলছে। কাশ্মীরের এই স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘আইকন’ হয়ে উঠেছেন বুরহান ওয়ানি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে তাঁর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কাশ্মীর উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও এর কারণ আরও গভীরে। ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার কাশ্মীরের চালচিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে-‘কাশ্মীর কেবল প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ এ তিনটি বিষয় ভারতের হাতে তুলে দিয়ে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল। তবে কাশ্মীরের তরুণ প্রজন্ম তাদের পূর্বসূরিদের চেয়ে একধাপ এগিয়ে গেছেন। তারা এখন স্বাধীনতা চান, নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি নিজেরাই প্রণয়ন করতে চান। তারা বস্তুত সার্বভৌমত্বের দাবি তুলেছেন, তা অন্য যেকোনো দেশের স্বাধীনতার সমতুল্য। আর এ দাবিই মানতে নারাজ কেন্দ্র (দিল্লী)। কেননা ভূ-রাজনৈতিক দিকে থেকে পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশের কাছেই কাশ্মীর সমান গুরুত্ব বহণ করে আসছে। এ অবস্থায় কাশ্মীরিদের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।’ বর্তমান কাশ্মীরের বাস্তবতায় ভারতের নাগরিক কুলদীপ নায়ার যা লেখেননি তা হলো কাশ্মীরের দাবি মেনে নিলে ভারতের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। সেভেন সিস্টারর্সখ্যাত দেশটির ৭ রাজ্যসহ আরো কয়েকটি রাজ্যর স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি আরো জোড়ালো হয়ে উঠবে। যা ঐক্যবদ্ধ ভারতের সার্ভভৈৗমত্বের প্রতি হবে চরম হুমকি। এমনকি ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাশিয়ার হওয়ার ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। সে শঙ্কা থেকে কাশ্মীরের আন্দোলন ঠেকাতে নিষ্ঠুরনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সে আশঙ্কা থেকে দিল্লী সরকার কাশ্মীরের জনগণের ওপর কামান-বন্দুকের নলের মুখে রাখতে বদ্ধপরিকর। ভারতের এই ন্যাক্কারজনক নিষ্ঠুর মানবতাবিরোধী নীতির প্রতিবাদ করছে না কেউ। অথচ কয়েকদিন আগে কাশ্মীরে দায়িত্বপালনরত ভারতের আর্মির সর্বোচ্চ কমান্ডার লে: জেনারেল হুদা বলেছেন কাশ্মীর সমস্যা বন্দুকের নল দিয়ে সমাধান সম্ভব নয়। এটা রাজনৈতিক ভাবে সমাধান করতে বৈঠক জরুরী। আমরা যদি সবাই সমস্যাটা স্বীকার করি এবং একসঙ্গে বসে এটা মেনে নিই যে এর সমাধান খোঁজা প্রয়োাজন তাহলে হয়তো এর উত্তর পেলেও পেতে পারি। প্রশ্ন হলো কাশ্মীর ‘সমস্যা’ জেনারেল, ভারতের আর্মির সর্বোচ্চ কমান্ডার লে: জেনারেল হুদা, নোয়াম চসস্কি, অরুন্ধতী রায়, অজয় শুক্লারা বুঝতে পারছেন অথচ নরেন্দ্র মোদী ও ভারতের রাজনীতিকরা বুঝতে পারছেন না? কাশ্মীরের তরুণরা কার্যত স্বাধিকারের দাবিতে মুক্তিকামী। ৭০ বছর ধরে তারা রক্ত দিচ্ছেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন,‘মুক্তিকামী মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায় না’। কাশ্মীরের মুক্তিকামী তরুণদের ভারত কিভাবে দাবিয়ে রাখে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন