শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

রাব্বি জিদনি ইলমা

মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর | প্রকাশের সময় : ১১ জুন, ২০২১, ১২:০৪ এএম

ইলম মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য অনুগ্রহ ও মহাদান। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের মূলেই রয়েছে জ্ঞান তথা ইলম। কেবলমাত্র মানবজাতি বাকশক্তি সম্পন্ন, তারা কথা বলতে পারে, যে কোন বিষয় সাবলীলভাবে বর্ণনা করতে পারে। একজনের কথা অপরজন স্বাভাবিকভাবে বুঝতে পারে। মানুষের এই বিস্ময়কর ক্ষমতা মহান আল্লাহ প্রদত্ত মহা নেয়ামত। তিনি মানুষকে জ্ঞানবান করে সৃষ্টি করেছেন, তাঁর স্মরণ শক্তিকে প্রখর করে দিয়েছেন। স্মৃতি শক্তির বিবেচনায় মানুষ অজানাকে জেনে স্মরণ রাখতে পারে। কদাচিৎ স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা হেতু মানুষ স্মরণযোগ্য বিষয়কেও ভুলে যায়। মানুষের এ ভুলে যাবার প্রবানতাও এক ধরণের আপদ, আরবী প্রবাদে আছে, ‘আফাতুল ইলমি আন নিসইয়ান’ জ্ঞানের বিপদ ভুলে যাওয়া। মানুষকে জ্ঞানের এ আপদ থেকে পরিত্রান পেতে দোয়া শিক্ষা দেয়ার জন্য রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উপলক্ষ্য করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন, ‘ (বলো) হে আমার প্রভু, আমার ইলম বৃদ্ধি করে দাও। (সূরা ত্ব-হা : আয়াত: ১১৪)। আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা কুরতুবী রাহ. বলেন, ইলমের চেয়ে অন্য কোনো আমল যদি আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় হতো তবে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেটা বৃদ্ধির জন্যই দুআ করতে নির্দেশ দিতেন। কুরআনে কারিমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইলম ছাড়া অন্য কোনো জিনিস বৃদ্ধির জন্য দুআ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়নি।

ইলমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি উৎসাহ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম দান করা হয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন। (সূরা মুজাদালাহ: আয়াত: ১১)। তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘মুমিনদের সকলের একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়, তাদের প্রত্যেক দলের এক অংশ বহির্গত হয় না কেন, যাতে তারা দ্বীন সম্বন্ধে জ্ঞানানুশীলন করতে পারে এবং তাদের সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে, যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসবে। যাতে তারা সতর্ক হয়। (সূরা তাওবা: আয়াত: ১২২)।
হযরত সাফওয়ান ইবনে আস্সাল রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকের কাছে আসলাম। তখন তিনি মসজিদে বসে ছিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি এসেছি ইলম শিক্ষা করার জন্য। তিনি বললেন, তালেবে ইলমকে মারহাবা। নিশ্চয় তালেবে ইলমকে ফিরিশতাগণ বেষ্টন করে রাখে এবং তাঁদের ডানা দিয়ে তাকে ছাঁয়া দিতে থাকে। অতঃপর তাঁরা সারিবদ্ধভাবে প্রথম আসমান পর্যন্ত মিলে মিলে দাঁড়িয়ে যায়। এসব কিছু তাঁরা সে যা অন্বেষণ করছে তার ভালবাসায় করে। (আখলাকুল উলামা, আর্জুরী ১/৩৭; তবারানী কাবীর, হাদীস ৭৩৪৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫৫০)
প্রখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা কুরতুবী রাহ. বলেন, কুরআনের এই আয়াতটি ইলম অন্বেষণ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে একটি বড় দলীল। তিনি আরো বলেন, ইলম অন্বেষণ করা এমন মহা সম্মান ও মর্যাদার বিষয়, অন্য কোনো আমল যার সমকক্ষ হতে পারে না। (তাফসীরে কুরতুবী ৮/২৬৬, ২৬৮)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনী অধ্যয়ন করলে স্পষ্টভাবেই বুঝে আসে, তিনি ইলমকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং বিরাট সওয়াবের কাজ হিসেবেই অবলম্বন করেছিলেন এবং এভাবে অবলম্বনের জন্যই উম্মতকে জোর তাকিদ করেছেন। ইলমের প্রতি এত উৎসাহ দিয়েছেন এবং এত অধিক ফযীলত বর্ণনা করেছেন যে, বৃদ্ধদের মাঝেও ইলম তলবের অদম্য স্পৃহা জেগে উঠেছে। শুধু তা-ই নয়, ইলমের প্রতি অনীহা প্রকাশকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
ইলমের প্রতি কোনো এক সম্প্রদায়ের অনাগ্রহের কথা জানার পর তিনি ইরশাদ করেন- ‘ওই সম্প্রদায়ের কী হল যে, তারা প্রতিবেশীদেরকে দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ দান করে না; দ্বীন শিক্ষা দেয় না, দ্বীনের বিষয়াবলী বোঝায় না, তাদেরকে সৎ কাজের আদেশ করে না, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে না? ওই সম্প্রদায়েরই বা কী হল যে, তারা প্রতিবেশী থেকে দ্বীন শেখে না, দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ নেয় না, দ্বীনের বিষয়াদি বুঝে নেয় না?
আল্লাহর কসম! হয়ত তারা তাদের প্রতিবেশীদেরকে দ্বীন শেখাবে, দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ দান করবে, দ্বীনের বিষয়াদি বোঝাবে, সৎ কাজের আদেশ করবে, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে আর যারা জানে না ওরা তাদের থেকে শিখবে, সঠিক বুঝ গ্রহণ করবে, দ্বীনের বিষয়াদি ভালোভাবে বুঝে নেবে নতুবা আমি তাদেরকে দুনিয়াতেই নগদ শাস্তি দিব। (আলমুজামুল কাবীর, তবারানী; মাজমাউয্ যাওয়ায়েদ ১/১৬৪)।
জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য আমরা স্বভাবতঃ এ দোয়া পড়ে থাকি, রাব্বি জিদনি ইলমা, রাব্বিস রাহলি সাদরি ওয়া ইয়াসসিরলি আমরি ওয়াহলুল ওকদাতাম মিন লিসানী ইয়াফকাহু কাওলি, রাব্বি ইয়াস্সির ওয়ালা তোয়াস্সির ওয়াতাম্মিম আলাইনা বিল খাইর’। অর্থ্যাৎ ‘ হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন, আমার সকল কর্ম সহজ করিয়া দিন, আমার জিহবার জড়তা দুর করিয়া দিন, হে আমার প্রভু আমার জন্য সহজ করে দিন আর আপনি আমার জন্য কঠিন করবেন না, আর আমাদের শেষ পরিনতি কল্যানময় করুন।
এ দোয়ার প্রতিধ্বনি পবিত্র কুরআনে রয়েছে, মূসা বলিল, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বক্ষ প্রশস্ত করিয়া দাও। এবং আমার কর্ম সহজ করিয়া দাও। আমার জিহ্বার জড়তা দূর করিয়া দাও। যাহাতে উহারা আমার কথা বুঝিতে পারে। (সুরা ত্বহা: আয়াত: ২৫-২৮)।
রাসুুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতদেরকে দোয়া করার পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করে ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর নিকট এভাবে দোয়া করবে, ‘হে আল্লাহ আপনি যা সহজ করে দেন তা ব্যতিত কোন কিছুই সহজ নেই। আর আপনি চাইলে পেরেশানীযুক্ত কাজও সহজ করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান: হাদিস নং: ৯৭৪)।
ইলম বৃদ্ধির জন্য কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ দোয়া : বেশি বেশি ‘রাব্বি জিদনি ইলমা’ পড়া। ‘রাব্বি জিদনি ইলমান নাফেয়া ওয়া ফাহমান কামেলা ওয়াকিনান সাদেক্বা’ অর্থ্যাৎ ‘ হে আমার রব আমাকে উপকারী জ্ঞান বাড়িয়ে দিন, পরিপূর্ণ বুঝ দান করুন, নিশ্চিত সত্যজ্ঞান দান করুন। ‘আল্লাহুম্মাফতাহলী আবওয়াবা হিকমাতিক, ওয়ানশুর আলাইয়্যা মির রাহমাতিক’ অর্থ্যাৎ ‘হে আল্লাহ আমার জন্য প্রজ্ঞার দ্বার খুলে দিন, আমার উপর আনার রহমত ছড়িয়ে দিন’। আল্লাহুম্মা যাক্কিরনি মা নাসিতু, ওয়াহফায আলাইয়্যা মা আলিমতু, ওয়া জিদনি ইলমা’ অর্থ্যাৎ ‘ হে আল্লাহ আমি যা বিস্মৃত হয়েছি তা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিন, যা জেনেছি তা হেফাজত করুন, আমার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে দিন। ‘আল্লাহুম্ম ফাক্কিহনি ফিদ্দিন’ অর্থ্যাৎ ‘হে আল্লাহ আমাকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন’। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা কুওয়াতাল হিফজ, ওয়া সুরআতিল ফাহাম, ওয়া সাফায়িয যেহেন’ অর্থ্যা’ হে আল্লাহ আমাকে আপনি মুখস্ত করার ক্ষমতা, দ্রুতভাবে বুঝার ক্ষমতা ও স্বচ্ছ মেধা দান করুন’। ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফেয়া, ওয়া রিযকান তাইয়েবা, ওয়া আমালান মুতাকাব্বেলা’ অর্থ্যাৎ ‘ হে আল্লাহ আমি আপনার কাছে উপকারী জ্ঞান, উত্তম রিযিক, কবুল হওয়া আমল প্রত্যাশা করছি’। ‘আল্লাহুম্মানফাআ’না বিমা আল্লামতানা, ওয়া আল্লিমনা মা ইয়ানফাউনা, ওয়া জিদনি ইলমা’ অর্থ্যাৎ ‘হে আল্লাহ আপনি যা আমাদের শিখিয়েছেন তাতে উপকার দান করুন, আর আমাদের উপকারী জ্ঞান দান করুন, আর আমার জ্ঞানকে বৃদ্ধি করে দিন।
পরিশেষে এ কথা বলা যায়, জ্ঞান মহান আল্লাহপাকের মহা অনুগ্রহ ও মহা নেয়ামত তিনি যাকে পছন্দ করেন তাকে তা দান করেন, যাকে পছন্দ করেন, তাকে হিকমত দান করেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁরই সন্তুষ্টি লাভের নিমিত্তে জ্ঞান অর্জনের তাওফিক দান করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
HOSSIN ২১ জুন, ২০২১, ৫:২৪ পিএম says : 0
এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন
Total Reply(0)
হামিদ হাজারী ১ জুলাই, ২০২১, ৯:০০ এএম says : 0
আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও হে প্রভু
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন