সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের এই পৃথিবী মারাত্মক কোভিড-১৯ মহামারিতে জর্জরিত। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সতের কোটি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ৩৭ লক্ষের বেশী মানুষ মৃত্যুবরন করেছেন। কিন্তু এ বৈশ্বিক অতিমারিতে নূতন আতংক হিসেবে দেখা দিয়েছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ রোগ। ভারত থেকে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের বেশ কিছু কোভিড-১৯ রোগীর দেহে এ ফাঙ্গাসের সংক্রমণ ঘটেছে এবং রোগীদের মারাত্মক পরিণতি পরিক্ষিত হয়েছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগটি কি?
বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যার নাম- ‘মিউকোরমাইকোসিস’। চলতি ভাষায় এটি ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ নামে পরিচিত। এটি প্রধানত সুবিধাগত (অপুরচুনিস্টীক) সংক্রমন যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি কমে গেলে হয়ে থাকে। যাদের ডায়াবেটিস আছে, বিশেষত, ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ ভালো নয়; ক্যান্সার বা এইচআইভি/এইডস যাদের আছে, কিংবা কোন রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম এই মিউকোর থেকে তাদের সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, কম্পোস্ট সার, গোবর এবং পচন ধরা ফল ও সবজিতে। এটা মাটি এবং বাতাসে এমনিতেই থাকে। এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিস্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্তকরে। তবে চিকিৎসকদের কথায় মিউকোরমাইকোসিস থেকে মৃত্যুর আশংকা ৫০%। তাদের ধারণা স্টেরয়েডের অতি ব্যবহার থেকে এই সংক্রমণ শুরু হতে পারে।
কোভিড-১৯-এর রোগীরা কেন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের শিকার হচ্ছেন?
কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত এবং ভীষণভাবে কমে যায় এবং এতে করে বিভিন্ন সুবিধাভোগী রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। করোনা ভাইরাসের হানায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে চলেছে ফুসফুস, মস্তিষ্কও। এরই মধ্যে শরীরে ঢুকে পড়ছে এক ধরনের ছত্রাক। সম্প্রতি দিল্লির একটি হাসপাতালে কিছু করোনা রোগীর মধ্যে মারাত্মক ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ছত্রাকের সংক্রমণের অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। কোভিড-১৯এ গুরুতরভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসায় তাদের জীবন বাঁচাতে এখন স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের ফুসফুসের প্রদাহ কমাতে স্টেরয়েড ওষুধ দিতেই হচ্ছে। স্টেরয়েডের ব্যবহার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ফলে সেক্ষেত্রে এই রোগ চলে আসছে অজান্তেই।
লক্ষন বা উপসর্গসমূহ ঃ
গুরুতর লক্ষণগুলি হল- বন্ধ নাক, নাক দিয়ে পানি পরা, গালে হাড়ে ব্যথা, মুখে ফোলাভাব, শুকনো কাশি, দাঁতে ব্যথা, ফুসকুড়ি, চোখে ঝাপসা দেখা, বুকে ব্যাথা। মৃদু লক্ষণ- চোখ এবং নাকের চারপাশে ব্যথা এবং লালভাব, জ্বর, মাথা ব্যথা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, বমি।
যাদের করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে (উচ্চ মাত্রায় বা দীর্ঘসময় ধরে) তাদের মধ্যে এই ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবিটিস যাদের তাঁদেরও সচেতন থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। বহুদিন ধরে যাঁরা আইসিইউ-তে থেকেছেন বা কো-মর্বিডিটি রয়েছে তাঁদের এই ইনফেকশনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানা গেছে।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেতে হলে করনীয়?
১. ধুলোবালি রয়েছে এমন জায়গায় গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন,
২. চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিফাংগাল বা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ শুরু করুন,
৩. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে,
৪. সঠিক পরিমাণে স্টেরয়েডের ব্যবহার করতে হবে,
৫. উপসর্গ দেখলেই সাবধান হতে হবে,
৬. চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সতর্কতা:
১) সাইনাসাইটিস নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া বা নাকে সর্দি জমা, নাক দিয়ে সর্দি বের হওয়া (কালচে/রক্তসহ), চোয়ালের হাড়ে ব্যথা।
২) মুখের এক দিকে ব্যথা, অসাড় হয়ে আসা বা জ্বালা করা।
৩) নাকের আগায় বা চার পাশে কালচে হয়ে গিয়ে ত্বকের রং বদলে যাওয়া।
৪) দাঁতে ব্যথা, দাঁত আলগা হয়ে আসা, চোয়াল আটকে যাওয়া।
৫) চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়া বা দু’টো করে দেখা ও চোখে ব্যথা, জ্বর, ত্বকে জ্বালা, থ্রম্বোসিস ও নেক্রোসিস।
৬) বুকে ব্যথা, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়তে থাকা।
করণীয়:
১. হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
২. কোভিড-১৯-র চিকিৎসার পর ছাড়া পেয়েও ডায়াবেটিসে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দেখে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
৩. সঠিক ভাবে স্টেরয়েড ব্যবহার করতে হবে, সঠিক সময়, সঠিক ডোজ ও কোর্স পূর্ণ করতে হবে।
৪. অক্সিজেন থেরাপির সময় পরিস্কার ও জীবানুমুক্ত পানি, মাস্ক ও সিলিন্ডার ব্যবহার করা।
৫. সঠিক ভাবে জেনে ছত্রাক সংক্রমণ প্রতিরোধকারী/অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে হবে।
বর্জনীয়:
১) এই সংক্রমণের উপসর্গ অবহেলা করবেন না।
২) নাক বন্ধ হওয়ার ঘটনাকে ব্যাকটেরিয়াজনিত সাইনোসাইটিস বলে অবহেলা করবেন না, বিশেষত যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম।
৩) ছত্রাক সংক্রমণ হচ্ছে কি না, জানতে বিশেষ পরীক্ষা করাতে দ্বিধা করবেন না (কেওএইচ স্টেইনিং ও মাইক্রোস্কোপি, কালচার, এমএএলডিআইটিওএফ)।
৪) মিউকরমাইকোসিসের চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে একটুও সময় নষ্ট করবেন না।
ব্যবস্থাপনা:
১. ডায়াবেটিস ও ডায়াবেটিক কেটোঅ্যাসিডোসিস নিয়ন্ত্রণ করা।
২. স্টেরয়েডের ব্যবহার সীমিতকরণ ।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উপর প্রভাব ফেলে এমন ওষুধ বন্ধ করা।
৪. পচনশীল উপাদান বাদ দেওয়ার জন্য অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হলে তা অবশ্যই করান।
৫. কোন রকম অ্যান্টি-ফাংগাল প্রফিল্যাক্সিস নয়।
চিকিৎসাঃ
১) শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে,
২) এন্টিফাঙ্গাল বা অ্যাম্ফোটেরিসিন বি ব্যবহারের আগেই নরমাল স্যালাইন চালু রাখা,
৩) অ্যান্টিফাঙ্গাল হিসাবে কমপক্ষে ৪-৬ সপ্তাহ অ্যাম্ফোটেরিসিন বি ব্যবহার করতে হয়, যা খুবই ব্যয়বহুল।
৪) এই ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরও উপরের চোয়ালের অংশ এবং কখনও কখনও চোখও ফেলে দিতে হয়।
৫) রুগী স্ট্যাবল হলে এই চোয়াল ও চোখের প্রোস্থেটিক অপারেশন করা যায়।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন