শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

রাজধানীর খাল-জলাধার উদ্ধার করতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

রাজধানী থেকে একের পর এক খাল ও প্রাকৃতিক জলাধার উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে প্রভাবশালীদের কারসাজি। খালগুলো এখন স্থানীয় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের কব্জায়। তারা খালগুলো ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করে সেখানে বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন ব্যবসা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। খালের হিসাব নেই কোনো সংস্থার কাছেই। কেউ বলছে ৫১টি, কেউ বলছে ৪৬টি, কেউ বলছে ৩২টি খাল। ঢাকার অন্তত ১০টি খালের এখন অস্তিত্বই নেই। নন্দীপাড়া-ত্রিমোহনী খালটির অস্তিত্ব কেড়ে নিতে সক্রিয় দখলদাররা। ঘোপদক্ষিণ খালেরও এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

শাহবাগ থেকে বেগুনবাড়ী খালের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী পরীবাগ খালটি এখন কালভার্ট। ধানমন্ডি সার্কেলে রামচন্দ্রপুরের বিভিন্ন খাল দখলে রেখেছে খালখেকো প্রভাবশালীরা। রাজধানীর অন্যসব খাল ও জলাশয় দখলের ক্ষেত্রেও এলাকার মস্তান নামধারী কিংবা রাজনৈতিক টাউটদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। গত ৩২ বছরে ঢাকা মহানগরী থেকে উধাও হয়ে গেছে ৩৯টি খাল। রাজধানীতে এ মুহূর্তে ১৫টি খাল থাকলেও এর চারটি বর্তমানে লেক। অন্যগুলো ভরাট-দখলে সংকুচিত হয়ে নর্দমার আকৃতি পেয়েছে। ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই নগরীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫৪টি খালের অস্তিত্ব ছিল। এসব খালের সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া প্রধান চারটি নদ-নদীর সঙ্গে। রাজধানীর এসব খাল ও অন্যান্য জলাশয় এখন বিস্মৃত অতীত মাত্র। খাল-বিল-জলাশয় যথেচ্ছভাবে দখলের পরিণতিতে বর্ষা হলেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতার অভিশাপ নেমে আসে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের যে সামান্য অংশ টিকে আছে তা দখল-দূষণে স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়েছে বহু আগেই। এগুলো কার্যত মশা উৎপাদনের কারখানা। চলতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার অস্বস্তিকর থাবা নাগরিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে খালসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের বিলুপ্তি তাদের জন্য কী অভিশাপ সৃষ্টি করছে। জলাবদ্ধতার অবসান শুধু নয়, রাজধানীতে শ্বাস নেওয়ার মতো পরিবেশ বজায় রাখতে দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার ও তা পুনঃখননের উদ্যোগ নিতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে রাজধানীর খাল উদ্ধার ও পানিনিষ্কাশনের দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ) কাছে ন্যস্ত করার পর উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে। আগে ঢাকা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার এবং প্রতিবছর এ খাতে কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও খালগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছিল, বর্ষা মৌসুমে দেখা দিচ্ছিল জলাবদ্ধতা। এ অবস্থায় গত ৩১ ডিসেম্বর দুই সিটি করপোরেশনের ওপর খাল উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ইব্রাহিমপুর খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, গোদাগাড়ী খাল, রূপনগর খাল, সাগুফতা খালসহ ১৪টি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ করেছে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির করপোরেশন জিরানী খাল, মান্ডা খাল, শ্যামপুর খাল, কদমতলা খাল, কমলাপুর খালসহ দুটি বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ করেছে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ঢাকায় ৭৩টি খাল আছে। ২০১৬ সালে করা ঢাকা জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, খালের সংখ্যা ৫৮টি। সে সময় জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উল্লিখিত খালের ৩৭টিতেই দখলদার রয়েছে। দখল ও দূষণের কারণে খাল স্বাভাবিক প্রবাহ হারিয়েছে। কোনো কোনোটি পুরোপুরি ভরাট হয়ে গেছে।

বর্ষার আগেই যাতে খালগুলো দখলমুক্ত করা যায়, সে ব্যাপারে দুই সিটি রপোরেশনকে তৎপর থাকতে হবে। বর্ষার সময় খাল উদ্ধারের কাজ করা যাবে না। খাল দখলের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীরাই যুক্ত। ওয়াসা সরকারি প্রতিষ্ঠান। সিটি করপোরেশন নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের পক্ষে প্রভাবশালীদের উচ্ছেদ করা সহজ। আবার ভয়ও আছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি তথা কাউন্সিলররা যদি এসব খাল দখল ও দূষণের কাজে ব্যস্ত থাকে, তাহলে সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।

খাল দখলদারের মধ্যে বেশিরভাগই স্থানীয় প্রভাবশালী। খালের জমি ভরাট করে তারা ধীরে ধীরে বাড়িঘর, কলকারখানা নির্মাণ করেছে। অনেক খালের ওপর দিয়ে চলে গেছে রাস্তা। সেখানে কোনোদিন খাল ছিল তা ধারণা করাও এখন কঠিন। খাল দখলে সর্বত্রই অনুসৃত হয়েছে অভিন্ন কৌশল। প্রথমে স্রোতস্বিনী খালের পানিতে খুঁটি পুঁতে মাচান বানিয়ে শত শত বস্তিঘর বানানো হয়। এরপর আবর্জনা, উচ্ছিষ্ট ফেলে ভরাট করা হয়। ছোট ছোট বাঁধ দেওয়ারও নজির রয়েছে। একপর্যায়ে গড়ে তোলা হয় পাকা স্থাপনা ও অট্টালিকা। খাল-নালা দখল ও নিশ্চিহ্ন করার ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া রাজধানী জুড়েই শুরু হয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বর্ষা মৌসুমে। জলাবদ্ধতায় নাকাল হচ্ছে নগরবাসী। রাজধানীর পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাটের অবিমৃষ্যকারিতা। রাজধানীতে এখনো যেসব জলাশয় রয়েছে তার অস্তিত্ব রক্ষায় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। নদ-নদী, খাল-লেক অপদখল ও দূষণের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে জনসচেতনতা। রাজধানীবাসীর সচেতনতাই খালখেকো-নদীখেকোদের লকলকে জিহ্বাকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। নদী-খাল দখল-দূষণ দেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে যে যেভাবে পারে এই দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনও এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্বিকার ভূমিকা পালন করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দখলদাররা এতটাই প্রভাবশালী থাকে যে, তারা আইন-প্রশাসন সবকিছুকে বৃদ্ধাঙ্গগুলি দেখায়। অথচ নদ-নদীর টিকে থাকার সঙ্গে বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক অস্তিত্বের সম্পর্ক জড়িত।

পরিবেশ সচেতনতার এ যুগে খালের অপমৃত্যু হবে আর সবাই চেয়ে চেয়ে দেখবে, এটা হতে পারে না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া দখল বন্ধ করা যাবে না। দখলে নিয়জিত চক্রকে ভাঙতে হবে। প্রশাসনের কোনো গাফিলতি থাকলে সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজধানীর হৃদপিন্ড হিসেবে বিবেচিত খালগুলো বাঁচাতে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা জরুরি। শুধু উচ্ছেদ অভিযান চালালেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। সেগুলোকে পুনরায় দখল-দূষণের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে ওয়াকওয়ে, ড্রাইভওয়ে নির্মাণ ও গ্রিন বেল্ট গড়ে তুলতে হয়।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সদস্য এফবিসিসিআই, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ১৪ জুন, ২০২১, ৫:৫১ পিএম says : 0
যতদিন পর্যন্ত আমাদের দেশ আল্লাহর আইনে চলবে না ততদিন পর্যন্ত আল্লাহদ্রোহী সরকার এগুলো করে যাবে.
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন