শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস রোধে সুন্দরবনের সুরক্ষা আরো নিশ্চিত করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সুন্দরবনের মানুষ ২০০৯ সালের ২৭মে তারিখটি যেমন ভোলেনি, তেমনই ভুলতে পারবে না ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর তারিখটা। ২০০৯ সালের ২৭মে দুপুর দেড়টা নাগাদ সুন্দরবনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ‘আয়েলা’। আর ঠিক দশ বছর পাঁচ মাস বারো দিন পর সুন্দরবনে আঘাত হানে আবারও এক অতি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’। অতি সাম্প্রতিক কালে ‘ইয়াস’ও বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। আয়েলা নাকি বুলবুল নাকি ইয়াস বা অন্য কোনো নামের ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের বেশি ক্ষতি করেছে তার হিসাব-নিকাশ বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু ক্ষতির প্রকৃতিতে কিছু পার্থক্য থাকলেও এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সব ঘূর্ণিঝড়ই আতঙ্কের।

আয়েলার উৎপত্তি হয়েছিল ২১মে, ২০০৯ কলকাতা থেকে প্রায় ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে উত্তর ভারত মহাসাগরে একটা ছোটো নিম্নচাপ হিসাবে। তারপর তা ক্রমশ ঘনীভূত হতে শুরু করে এবং ২৩মে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়। ক্রমশ শক্তি বাড়িয়ে তা এগিয়ে আসতে থাকে সোজা উত্তরে ভারত-বাংলাদেশ উপকূলের দিকে। ২৭মে যখন আয়েলা ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে আছড়ে পরে তখন তার ব্যাস ছিল ২৫০-৩৫০ কিলোমিটার। ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে আয়েলা আঘাত হানে। আবহাওয়া দপ্তরের রিপোর্টে দেখা গেছে, তিন মিনিটের জন্য আয়েলার গতি হয়েছিল ঘন্টায় ১১০ কিলোমিটার, আর এক মিনিটের জন্য সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার। আছড়ে পড়ার পর আয়েলা সোজা উত্তরে এগিয়ে যায় দক্ষিণ ও উত্তর ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমানের ওপর দিয়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ সুন্দরবন অঞ্চল।

ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাংলাদেশের সুন্দরবনও। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মৃত্যু হয় ৩৩৯ জনের, যাদের মধ্যে ১৪৯ জন ভারতে বাকীরা বাংলাদেশে। দুই দেশ মিলিয়ে গৃহহীন হয় ১০ লক্ষ মানুষ। এর মধ্যে শুধু পশ্চিমবঙ্গে গৃহহীনের সংখ্যা ১ লক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে ধ্বংস হয় ৪০ হাজার বাড়ি, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ লক্ষ ৩২ হাজার বাড়ি। ভারতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ওড়িশাতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বাংলাদেশে আয়েলার দাপটে গাছপালা উপড়ে বা ভেঙে, ইলেকট্রিকের পোস্ট উপড়ে এবং বিপুল সংখ্যক কাঁচাবাড়ি ভেঙে ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি নদীবাঁধ প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অংশের। যে সময় আয়েলা আছড়ে পরে সেই সময় সমুদ্র ও নদীতে ছিল ভরা জোয়ার। ফলে পানির উচ্চতা ২-৭ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যায়। প্রবল পানিস্ফীতি ও ঝড়ের ধাক্কায় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ নদীবাঁধ শতাধিক জায়গায় ভেঙে যায়। নোনা পানি প্লাবিত হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। শুধু সুন্দরবনেই পানিবন্দি হয়ে পড়েন ৪ লক্ষ মানুষ। ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। নষ্ট হয়ে যায় সমস্ত ফিশারি। নোনা পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে যায় মিষ্টি পানির সমস্ত মাছ ও পুকুর। নষ্ট হয়ে যায় পানীয় পানির নলকূপ। অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়া, আন্ত্রিক ও কলেরায় আক্রান্ত হয়। কিছুদিন পর নোনা পানি নেমে গেলেও মাটির লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় আমন ধানের চাষ সম্ভব হয়নি। জমির স্বাভাবিকতা গত দশ বছরে এখনও সম্পূর্ণ ফিরে আসেনি। আয়েলার সেই ক্ষত সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই এবার আঘাত হানল বুলবুল। তবে বুলবুলের জন্ম কিন্ত আয়েলার মতো স্বতস্ফূর্ত নয়। ‘মাতমো’ নামে এক তীব্র ক্রান্তীয় ঝড়ের গর্ভে জন্ম হয়েছে বুলবুলের। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ পালাউ’র কাছে ২৮ অক্টোবর জন্ম নেয় যে নিম্নচাপ তা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে তীব্র সাইক্লোন ‘মাতমো’তে পরিণত হয়। মাতমো ৩০ অক্টোবর ঘন্টায় ৯৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে ভিয়েতনামে। প্রচন্ড বৃষ্টি ও বন্যা হয় এর প্রভাবে। জোর প্রভাব পড়ে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডেও।

তারপর ক্রমশ দুর্বল হয়ে মাতমো দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলো অতিক্রম করে ২ নভেম্বর প্রবেশ করে উত্তর ভারত মহাসাগরে। তারপর সে পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করতে শুরু করে এবং ৫ নভেম্বর পরিণত হয় নিম্নচাপে। পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে প্রবল শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছড়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও বকখালিতে। উত্তর ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট নথিবদ্ধ ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে শক্তির বিচারে ‘বুলবুল’কে চতুর্থ স্থান দেওয়া হয়েছে। যে বিপুল পরিমাণ ধ্বংসাত্মক শক্তি বুলবুলের মধ্যে ছিল তা ১৯৬০ সালের পর কোনও ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে দেখা যায়নি। ৯ নভেম্বর সন্ধা সাড়ে আটটা নাগাদ বুলবুল যখন সাগরদ্বীপ ও বকখালিতে ল্যান্ডফল করে তখন তার গতিবেগ ঘন্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। সবচেয়ে জোরে ধাক্কা দেয় যে সময় সেই সময় তার গতিবেগ হয়েছিল ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার। আয়েলা’র থেকে বুলবুলের ধ্বংসাত্মক শক্তি যেমন ছিল বেশি, তেমনই স্থায়িত্বও ছিল বেশি। সুন্দরবনবাসীরা প্রায় সবাই সন্ধা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করেছিল বুলবুলের ধ্বংসলীলা। রাত সাড়ে আটটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত ঝড়ের প্রাবল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাগরদ্বীপের দক্ষিণ অংশ, মৌসুমী দ্বীপ, বকখালি, নামখানা ও জি-প্লট। সরকারি হিসাবে প্রায় ৩০০০ বাড়ি সম্পূর্ণ ও ২৬ হাজারের বেশি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২ লক্ষ ৪৩ হাজারের বেশি। প্রায় ৫ ঘণ্টার তাগুবে উপড়ে, ভেঙে পড়েছে অসংখ্য গাছ আর কয়েক হাজার ইলেকট্রিকের পোস্ট। ফলে সুন্দরবন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারই মধ্যে বুলবুল কেড়েছে ১০টি প্রাণ। তা-ও বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবন অঞ্চলের সামগ্রিক বিপর্যয় হয়েছে আয়েলা’র চেয়ে কম। এর কারণ মূলত তিনটি। প্রথমত, বুলবুল যখন আছড়ে পড়ে তখন সমুদ্র-নদীতে শুরু হয়ে গিয়েছিল ভাটা। ফলে ঝড়ের দাপটে সমুদ্র ও নদীতে খুব বেশি পানিস্ফীতি হয়নি। ফলে কয়েকটি জায়গা ছাড়া নদীবাঁধে ভেঙে বা ছাপিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়নি। তিন দিন পরে পূর্ণিমা থাকায় নদীতে জোয়ারের পানিস্ফীতি হওয়ার কথা যথেষ্টই। যদি জোয়ারের সময় বুলবুল আঘাত হানত তখন পরিস্থিতি আয়েলা’র মতো হওয়ার একটা আশঙ্কা থাকত। দ্বিতীয়ত, আয়েলা’র অভিমুখ ছিল উত্তর দিকে। ফলে পুরো ঘূর্ণিঝড়টাই স্থলভাগে প্রবেশ করেছিল এবং তা দুর্বল হতে হতে মিলিয়ে যাওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙ পর্যন্ত পৌছে গিয়েছিল। ফলে আয়েলার প্রভাবে দার্জেলিঙে প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল, এমনকি ধসও নেমেছিল। বুলবুল কিন্তু সাগরদ্বীপ ও বকখালিতে আছড়ে পুরোটা স্থলভাগে প্রবেশ করেনি। এর অভিমুখ ছিল উত্তর-পূর্বে। ফলে সাগর থেকে বাংলাদেশের পটুয়াখালি পর্যন্ত বুলবুলের একাংশ ছিল বঙ্গোপসাগরে। বুলবুলের সেই অভিঘাত অনেকটাই রুখে দিয়েছে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য। আর তাই বুলবুলের হানা সুন্দরবন ছাড়া অন্য এলাকায় বেশি করে অনুভূত হয়নি। তৃতীয়ত, আয়েলা’র ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, থেকে প্রশাসন ও সুন্দরবনবাসী অনেক বেশি সচেতন, সতর্ক ও সক্রিয় ছিল। আবহাওয়া দপ্তরের নিখুঁত পূর্বাভাস প্রশাসনকে মানুষের জীবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করেছে এবং মানুষও নিরাপদ স্থানে আগে থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করেছে।

সাম্প্রতিক ইয়াসও আশঙ্কার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। বনের তেমন ক্ষতি না হলেও এবং প্রাণহানি কম হলেও জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার, মাছের ঘের ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি অথবা বাঁধে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।

জোয়ার ভাটা নাকি কোন সময় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনও প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই। তাই আভাস দেওয়া যায় যে আছড়ে পড়ার সময় জোয়ারে নাকি ভাটা থাকবে। আবার সবসময় যে আভাস মিলবে তারও নিশ্চয়তা নেই। ঘূর্ণিঝড়ের চরিত্র বড়ই খামখেয়ালি। অন্যদিকে সুন্দরবনের অন্যতম চরিত্র হল, এ বড্ড দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস-এই দুই ভয়ঙ্কর বিপদকে সঙ্গী করেই সুন্দরবনে মানুষের বাস। যেহেতু প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রোধ করার প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই, তাই প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যবস্থা করাই আমাদের আশু লক্ষ্য।

ভুললে চলবে না সুন্দরবনের অধিকাংশ দ্বীপে বসতি গড়ে উঠেছিল দ্বীপের গঠন সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই। দ্বীপাঞ্চলে জোয়ারের পানির প্রবেশ রোধ করা হয়েছিল দ্বীপের চতুর্দিকে বাঁধ দিয়ে। এদিকে বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের পানিতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সেই সব বাঁধের উপর পানির চাপ বেড়েছে। পলকা বাঁধগুলোর তীব্র জোয়ার বা পানিস্ফীতিজনিত প্রবল চাপ সহ্য করার ক্ষমতা নেই। ফলে নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী বাঁধ ভেঙে প্রায়শই প্লাবিত হচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। এখন এই বাঁধ রক্ষা করা খুবই কঠিন, কারণ বাঁধ শক্তপোক্ত করা গেলেও দ্বীপের তলদেশের মাটি ক্ষয়ে গিয়ে বাঁধ সমুদ্র কিংবা নদীগর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। তবুও বোল্ডার ফেলে বাঁধের স্থায়িত্ব বাড়াতেই হবে। প্রয়োজনে মূলে বাঁধের পেছনে অতিরিক্ত বাঁধও তৈরি করা দরকার। আর মাটি ধরে রাখার জন্য প্রচুর পরিমাণে লবণাম্বু উদ্ভিদ সমুদ্রতট ও নদীর তীরে লাগানো দরকার। এতে বাঁধ ও জমি তলিয়ে যাওয়া যেমন দীর্ঘায়িত হবে, তেমনই এইসব উদ্ভিদ তীব্র ঝড়ের প্রাথমিক ধাক্কাকে সামাল দিতে পারবে।

তবে বিধ্বংসী ঝড়ের তীব্র অভিঘাত থেকে সুন্দরবনকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম যে একমাত্র বাদাবন অরণ্য তা বারবার প্রমাণিত। ২০০৯ সালর আয়েলার সময় দেখা গিয়েছিল বসতি এলাকার অসংখ্য গাছ ভেঙে বা উপড়ে গেলেও বাদাবনের কোনো ক্ষতি হয়নি। এবারে বুলবুলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখা গেছে। সাগরদ্বীপ, বকখালি, মৌসুমী ও জি-প্লটে কোনো বাদাবনের অরণ্য নেই। ফলে ওইসব এলাকায় বুলবুলের তীব্র ধাক্কা সরাসরি জনপদের উপর এসে পড়েছে। আর তাই ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে ব্যাপক। সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের প্রধান দুটো অর্থকরী ফসল হল ধান ও পান।

শিষ বেরনোর সময় ঘুর্ণাবর্তের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিতে যেমন ধানের ক্ষতি হয়েছে, তেমনই ঝড়ের অভিঘাতে সুন্দরবন অঞ্চলের অধিকাংশ পানের বরোজ নষ্ট হয়ে গেছে। তা ছাড়া ওইসব এলকায় অধিকাংশ মাটির বাড়ি ধসে গেছে। খড়ের, টালির, টিনের ও অ্যাসবেস্টরের চালা গেছে উড়ে। বাড়ির উপর গাছ উপড়ে গাছ ভেঙে গেছে বহু বাড়ি। সড়কপথের দু’পাশে লাগানো ঝাউ, আকাশমণি, ইউক্যালিপ্টাস, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, কদম, ছাতিম ইত্যাদি গাছ উপড়ে বা ভেঙে পড়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। গ্রামের মধ্যে ইটের বা কংক্রিটের রাস্তার দু’পাশে লাগানো গাছ ইট বা কংক্রিটসহ উপড়ে যাওয়ায় অধিকাংশ রাস্তা হয়ে গেছে চলাচলের অযোগ্য। এইসব রাস্তাকে আবার চলাচলের উপযুক্ত করে তুলতে প্রচুর শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন।

সুন্দরবনের বাদাবনের বন কেটে প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে এখানে গড়ে উঠেছিল জনবসতি। তারপর থেকে সুন্দরবনের জনসংখ্যা যত বেড়েছে ততই সঙ্কুচিত হয়েছে সুন্দরবনের বাদাবন। কিন্তু এ কথা তো প্রমাণিত সত্য যে, সুন্দরবনের লবণাম্বু উদ্ভিদ সামুদ্রিক ঘূণিঝড় মোকাবিলার জন্য চমৎকারভাবে অভিযোজিত। সুন্দরবনের জনবসতিকে ঝড়ের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে গেলে বাদাবনের অরণ্যের বিস্তার করা ছাড়া দ্বিতীয় পথ নেই। এজন্য বর্তমান বাদাবন অরণ্যকে রক্ষা করার পাশাপাশি সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী এলাকায় লবণাম্বু উদ্ভিদের বনসৃজন করতে হবে। আর রাস্তার পাশে ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরিষ ইত্যাদি ভঙ্গুর ও স্বল্প গভীরে বিস্তৃত শেকড়ওয়ালা বৃক্ষ না লাগিয়ে যদি লবণাম্বু বৃক্ষ যেমন পরশ, ধুন্দুল, পশু, কেওড়া ইত্যাদি গাছ লাগানো হয় তবে ঝড়ের তীব্রতা যেমন প্রতিহত হবে, তেমনই সহজে ভেঙে বা উপড়ে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দেবে না পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ফলজ গাছপালা লাগালে এর থেকে স্থানীয় অধিবাসীরা উপকৃত হবে। সরকারকেই এ কাজ করতে হবে।

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভয়াবহ সুনামি সেদিন আছড়ে পড়েছিল অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাডুর উপকূলে। ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল অসংখ্য ঘর-বাড়ি। কিন্তু অদ্ভুতভাবে তামিলনাডুর পিছাভরম ও থুমুপেট অঞ্চলে সুনামি সেভাবে ক্ষতি করতে পারেনি, কারণ খুঁজলে দেখা যাবে ওই দুই অঞ্চল ছিল বাদাবনে ঘেরা। সুন্দরবন এলাকা এমনিতেই সুনামিপ্রবণ এলাকা হিসাবে চিহ্নিত । ভবিষ্যতে কখনও যদি সুন্দরবনে সুনামি তার থাবা বসাতে আসে তবে বাদাবন অরণ্যই পারবে তার সাথে মোকাবিলা করতে। সামুদ্রিক ঝড় হোক কিংবা সুনামি সুন্দরবনের একমাত্র প্রাকৃতিক ঢাল হল বাদাবন। সুন্দরবনের দীপাঞ্চল এবং তার জনবসতি, অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য বাদাবনের অরণ্যের ঢালকে রক্ষা করতে হবে। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার সঙ্গে লড়তে হবে প্রাকৃতিকভাবেই। যান্ত্রিকভাবে এর মোকাবিলা প্রায় মোটেই সম্ভব নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন