শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ভয়ঙ্কর ‘ভালোবাসার’ ফাঁদ

চট্টগ্রামে বাড়ছে কৌশলে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২১, ১২:০০ এএম

ব্যবসায়ী মনজুর আলমের সাথে ফেইসবুকে পরিচয় হয় তরুণী শারমিন আক্তার লিজার। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। এরপর বাসায় দাওয়াত দেন লিজা। বাসায় যেতেই তাকে হাত-পা বেঁধে জিম্মি করা হয়। চার লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে শুরু হয় মারধর। কেড়ে নেয়া হয় পকেটে থাকা ৫০ হাজার টাকা। মানিব্যাগে থাকা ক্রেডিট কার্ড ও পিন নাম্বার নিয়ে বুথ থেকে তুলে নেয় এক লাখ টাকা। বিকাশে থাকা সাত হাজার টাকাও নিয়ে নেয় তারা।
এরপর প্রায় অচেতন অবস্থায় রাস্তায় ফেলে দেয়া হয় মনজুর আলমকে। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর তিনি বুঝতে পারেন লিজার ওই ভালবাসার আড়ালে ছিল ভয়ঙ্কর প্রতারণার ফাঁদ। পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ ওই ঘটনায় জড়িত এক দম্পতিসহ তিনজনকে চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থেকে পাকড়াও করে।
মনজুর আলমের মতো এমন ভয়ানক ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন অনেকে। কেউ থানা-পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন, প্রতিকারও পাচ্ছেন। অনেকে আবার লোকলজ্জায়, মান-সম্মানের ভয়ে ঘটনা চেপে যাচ্ছেন। নগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মহানগরীতে এমন প্রতারক তথা অপরাধী চক্রের সংখ্যা অনেক। তাদের সাথে রয়েছে নারী সদস্যরাও। সুন্দরী নারীদের ছবি দিয়ে ফেইসবুকে আইডি খুলে প্রথমে বন্ধুত্বের আহ্বান। এরপর টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলা হয়। একান্তে দেখা করার কথা বলে বাসায় এনে জিম্মি করে আদায় করা হয় মুক্তিপণ।
আবার কৌশলে রাস্তা থেকে তুলে কিংবা অপহরণ করে লোকজনকে তাদের আস্তানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে চক্রের নারী সদস্যদের সাথে আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, তরুণীদের চাকরি দেয়ার নাম করে এনে এ ধরনের অপরাধী চক্রে ভেড়ানো হয়েছে। কয়েকজনকে টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়ার তথ্য-প্রমাণও পেয়েছে পুলিশ। নগরীর কয়েকটি এলাকায় পেশাদার অপরাধীরা নেপথ্যে থেকে এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী মিলেও এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে অনেকে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাও এমন ফাঁদ পেতে মুক্তিপণ আদায় করছে।
সম্প্রতি সংঘটিত কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে নগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, উঠতি ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ব্যাংক কর্মকর্তা এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন। কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও এদের শিকার হচ্ছেন। আবার অনেককে কৌশলে ডেকে নিয়ে জিম্মি করা হচ্ছে। কোথাও আবার এ চক্রের সদস্যরা পুলিশ-সাংবাদিক পরিচয়ে লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারানোর পরও অনেকে থানায় অভিযোগ দিচ্ছেন না। এর ফলে বেশিরভাগ ঘটনাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র।
গত শনিবার ব্যবসায়ী মনজুর আলমকে জিম্মি করার ঘটনায় শারমিন আক্তার লিজা (৩০), রিমা আক্তার (২২) ও তার স্বামী মো. কায়ছারকে (২৭) গ্রেফতার করে বাকলিয়া থানা পুলিশ। এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে লোকজনকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। এর আগে নগরীর মৌলভীপাড়ায় এক আইনজীবীকে জিম্মি করে মারধর ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় জোবাইদা সুলতানা হীরা সোনিয়া (২১) ও মো. ইমরান (৩২) নামে দুইজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আইনজীবী হাবিবুর রহমান আজাদকে আইনি সহায়তার কথা বলে বাসায় ডেকে আনে সোনিয়া। ডবলমুরিং থানার ওসি মোহাম্মদ মহসীন বলেন, সোনিয়ার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ এ অপরাধী চক্র বিভিন্ন সময়ে লোকজনকে আটকে অশ্লীল ছবি তুলে মারধর ও টাকা আদায় করে। ২০১৩ সালে এভাবে এক ব্যক্তিকে আটকে মারধরের কারণে ওই লোক মারা যান। সে মামলায় সোনিয়া দুই বছর কারাগারেও ছিলেন। সোনিয়া ছাড়াও ওই এলাকায় রুনা নামে এক নারীর অধীনে বেশ কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে পুলিশ।
ফেইসবুকে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে এক কলেজ ছাত্রীকে জিম্মি করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির ঘটনায় সম্প্রতি ঢাকা থেকে এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। গাবতলীর একটি আবাসিক হোটেলে তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় ওই ছাত্রীকে। ছাত্রীর বাসা নগরীর আকবরশাহ এলাকায়। সাভার উপজেলার বাসিন্দা সাইদুল বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক। এর আগেও সে এভাবে অনেক তরুণীকে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করেছে।
এ ধরনের অপরাধী চক্রে তরুণীকে জোর করে ভেড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। গত মাসে নগরীর মোগলটুলি থেকে এমন দুই তরুণীকে উদ্ধার করে পুলিশ। শহরে ভালো বেতনে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাদের গ্রাম থেকে এনে বিক্রি করা হয়। যুবতীদের জিম্মি করে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর ঘটনায় ছয়জনকে পাকড়াও করে পুলিশ।
নগরীর হালিশহরের একটি বাসা থেকে দুই যুবককে জিম্মি করে টাকা দাবির ঘটনায় মাসুদ রানা (৩৫), লক্ষ্মী রানী দাশ (৩৪) ও নার্গিস আক্তার (২১) নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে মাসুদ নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বাসা ভাড়া নেয়। বিভিন্ন সময়ে যুবকদের প্রেমের ফাঁদ পেতে বাসায় আনা হত। এরপর মাসুদ নিজেকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে নার্গিস ও লক্ষ্মীর সাথে আপত্তিকর ছবি তুলে তাদের গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করত।
এ ধরনের অপরাধে কিশোর গ্রুপের সদস্যরাও জড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এক কিশোরীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে কৌশলে তাকে নগরীর আকবরশাহর দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গণধর্ষণ করে একদল কিশোর। ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। পরে চক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ফেইসবুকে সমকামী গ্রুপ খুলে প্রতারণার ঘটনায় নগরীর কাজির দেউড়ি এলাকা থেকে তিন কিশোর স্কুল ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, এ চক্রটি ওই গ্রুপের মাধ্যমে লোকজনকে টার্গেট করে। সম্পর্কের পর দেখা করার কথা বলে নির্ধারিত স্থানে ডেকে নিয়ে টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। কখনো আবার মুক্তিপণও আদায় করা হয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
মোঃ+দুলাল+মিয়া ১৬ জুন, ২০২১, ২:৩৫ এএম says : 0
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অটোপাশ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কে কবরে পরিনতি করতেছে।
Total Reply(0)
মোঃ+দুলাল+মিয়া ১৬ জুন, ২০২১, ২:৩৭ এএম says : 0
যে দেশে শিক্ষার ক্ষেত্রে দাম নেই,আবার ভালো বাসা ।
Total Reply(0)
Year Ali Sikder ১৬ জুন, ২০২১, ৫:৩৪ এএম says : 0
বিভিন্ন জায়গায় এরকম চক্র তৈরি হয়েছে
Total Reply(0)
তিনা ১৬ জুন, ২০২১, ৫:৩৪ এএম says : 0
সন্তানদের ব্যাপারে পিতামাতোদেরকে এখন আরও বেশি সচেতন হতে হবে।
Total Reply(0)
কামাল রাহী ১৬ জুন, ২০২১, ৫:৩৫ এএম says : 0
ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র।
Total Reply(0)
Md.+Shahjalal ১৬ জুন, ২০২১, ৭:০০ এএম says : 0
এ ধরণের অপরাধ চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন