মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নির্ভর করছে গণতন্ত্রের মুক্তির উপর : সংবাদপত্রের কালোদিবস গোলটেবিলে মির্জা ফখরুল

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০২১, ৬:২০ পিএম

জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই সরকার পরীমনির ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘‘আমরা কি বুঝি না যে, আপনার(সরকার) আবার সেই ডাইভারসান, আবার সেই অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া। প্রতি মুহুর্তে জনগণকে বিভ্রান্ত করা, প্রতারণা করা, মিথ্যাচার করা -এটাই হচ্ছে কিন্তু ওদের (ক্ষমতাসীন) মূল কাজ। তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, মানুষকে ভুলপথে নিয়ে যাবে।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো দিবস। এদিন তৎকালীন চরম কর্তৃত্ববাদী একদলীয় বাকশাল সরকার তাদের অনুগত ৪টি সংবাদপত্র সরকারিভাবে প্রকাশ করে এবং বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়ে গোটা জাতিকে নির্বাক করে দেয়। মঙ্গলবার দুপুরে এক গোল টেবিল আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘‘এই যে দেখেন সাংবাদিক ভাইয়েরা- খুব লাফালাফি হচ্ছে এখন। ইস্যুটা হচ্ছে পরীমনি। হু ইজ পরীমনি?” জনগণকে বিভ্রান্ত করার কারণ তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘ এখন আপনার যখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, তার মুক্তি নিয়ে কথা ‍উঠছে, যখন দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা উঠছে, যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একেবারে চরম ব্যর্থতা, কোভিড যখন চরমে উঠছে তখন আবার একটা এদের নিয়ে ডাইভারসান করা হচ্ছে।”এই ধরনের যে.. মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা, এই যে খেলা- এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব। একরকম কৌশল করেই তারা সমস্ত জাতিকে দমন করে রাখছে। তারা প্রতারক সরকার, জনগণের সাথে প্রতারণা করেই এভাবে ক্ষমতায় বসে আছে।”

চিত্র নায়িকা পরীমনির দায়েরকৃত মামলা প্রসঙ্গ টেনে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ আমি জানি না কত দূরে কি সত্য, কী ঘটনা, না ঘটনা আমি জানি না। কিন্তু কালকে এই ঘটনাটা দেখে মনে হয়েছে যে, এভরি থিং ইজ পোসেবেল ইন দিস কান্ট্রি। মামলা করলো একটা আর আরেক ঘটনার অপরাধের দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে ৮দিন রিমান্ডে। আমি বুঝিনি, সত্যি বলছি আমি বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা। আপনারা মামলা করলেন ধর্ষণ এবং হত্যার চেষ্টায় একটা জায়গা। আর তাকে (আসামী) যখন নিয়ে যাচ্ছেন রিমান্ডে কী জন্য যে, তার কাছে মাদক পাওয়া গেছে। যেখান থেকে তাকে অ্যারেস্ট করেছে সেই বাড়িটিও তার নয়, এটা আরেক জনের বাসা। আমার কাছে এসব বোধগম্য নয়, আমি বুঝি না এগুলো। আজকে অনেক প্রশ্ন এসেছে তাহলে কী শুধুমাত্র ক্ষমতাসীনরা, ক্ষমতাধারীরা যা চাইবেন তাই হবে? এই প্রশাসন যাকে ইচ্ছা, যাকে খুশি তাকেই তুলে নিয়ে যাবে। তার সম্মান, ইজ্জত, তার পরিবারের কাছে ইজ্জত, সমাজের কাছে ইজ্জত সমস্ত কিছু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।”

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘ আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন যে, বিএনপির সঙ্গে এক সঙ্গে বাস করা যায় না। তার এই বক্তব্যে তাদের আসল যে চরিত্র, তাদের আসল যে মানসিকতা সেটা বেরিয়ে এসেছে। তারা শক্তিশালী বিরোধী দল তো দূরের কথা, কোনো বিরোধী দলই চায় না। তার এই বক্তব্য থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।”তিনি বলেন, ‘‘ আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপি কারো দয়ার দল না, বিএনপি কারো দয়াতে টিকে নাই। বিএনপি সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছে জনগণের ভালোবাসা ও জনগণের সমর্থন নিয়ে। এই কথাটা অবশ্যই সরকারকে মনে রাখতে হবে।”

‘আজকে যে অবস্থাটা সরকার তৈরি করেছে। এই যে মানুষের অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে, এই যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার মূল চেতনা গণতন্ত্র তাকে যে ধ্বংস করেছে, হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, গুম করেছে, খুন করেছে, ৩৫ লাখ গণতন্ত্রকামী মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।” ‘‘ এজন্য অবশ্যই আওয়ামী লীগের নিঃসন্দেহে একদিন বিচার হবে, জনগণই তাদের বিচার করবে।’ সারাদেশে সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের জন্য সরকার ও প্রশাসনকে অভিযুক্ত করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ বয়স্ক সম্পাদক দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা হয়েছিলো, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী সাহেবকে প্রায় ৮ মাস যাবত আটক করে রাখা হয়েছে, শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের মতো সম্পাদক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আপনারা হিসাব দিলেন যে, প্রায় ৬০ জনের বেশি সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুধু জীবনের ভয়ে।”

আর যারা দেশে আছেন তারা লিখতে পারেন না। লিখতে না পারার জন্য কখনো আমি তাদের দোষারোপ করি না। কারণ, যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যে সেলফ সেন্সরশিপ নিজেদেরকে আরোপ করে নিতে হয়েছে তা হচ্ছে একমাত্র জীবনের ভয়ে, জীবিকার ভয়ে, সন্তান হারানোর ভয়ে, মামলার ভয়ে। কারণ, ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, কিভাবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ের ভেতরে নির্যাতন করা হলো।’এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে প্রস্তুতি নেওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ আমাদেরকে সকলকে জেগে উঠতে হবে। তরুণ যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে। আজকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সংবাদ কর্মীদের নিরাপত্তা, তাদের মুক্তি সব কিছুই নির্ভর করছে গণতন্ত্রের মুক্তির উপর। গণতন্ত্র যদি মুক্তি না হয়, তাহলে কখনোই কারো মুক্তি সম্ভব নয়, কারো মুক্তি সম্ভব নয়।”

জাতীয় প্রেস ক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বিএনপির স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে ‘১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস’ উপলক্ষে এই গোল টেবিল আলোচনা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশে চারটি পত্রিকা রেখে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয় সরকার। এদিনটিকে প্রতিবছর বিএনপি সংবাদপত্রের কালো দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘‘ দেশে একটা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলছে, দেশকে একটা নেতৃত্ব শূন্য করার প্রক্রিয়া চলছে- এখান থেকে কোনো একটা প্রতিষ্ঠা কিংবা জাতির কোনো একটা অংশ বাদ যাচ্ছে না।”যদি বিরাজনীতিকরণ ও নেতৃত্ব শূন্য না করা হয়, এদেশের যে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এটাকে যারা বিকিয়ে দিতে চায় তাদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য আজকে পরিকল্পিতভাবে বিরাজনীতিকরনের এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশকে খুব খারাপ অবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। এটাকে রুখতে হলে আমাদেরকে সব বিভক্তি ভুলে এক হতে হবে।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র বলেন, ‘‘ আমি বলতে চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চেয়ে সাংবাদিকের স্বাধীনতা বেশি প্রয়োজন। যেটা সাংবাদিকদের বাক স্বাধীনতা বা লেখার স্বাধীনতা। কারণ, মালিকের স্বাধীনতা আছে। মালিক আর সরকার জয়েন্ট ভ্যানঞ্চারে চলে। কখনো মালিক সরকারকে ব্ল্যাক মেইল করে, কখনো সরকার মালিকদের ব্ল্যাক মেইল করে। কারণ তারা নানারকম ব্যবসা করে। আর সংবাদপত্রে যারা লেখালেখি করে তারা চাকুরী করে, যা দেয় তা করে। তাদের স্বাধীনতা নেই, তাদের স্বাধীনতা দিতে হবে। এটা ভবিষ্যতে আমার মনে হয়, সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘‘ আজকে ১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস। আবার আজকে দিনটা হলো আন্তর্জাতিক গৃহ শ্রমিক দিবস। কিভাবে নিয়ে গেলো এটি ওই দিনটার কাছে আমি জানি না। সবার কাছে আমার বিনীত নিবেদন থাকবে যে, সংবাদপত্রের দলনের যে দিনটা সেদিন সংবাদপত্রের যারা কর্মী ছিলো তাদেরকে সরকারের অধীনস্থ করে গৃহশ্রমিক বানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সেই দিনটাকে একটা কলংকের দিন হিসেবেই আমরা যেন বিবেচনা করি। সেখানে থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য, সেখান থেকে মুক্তি লাভের জন্য এবং সেই অমর্যাদা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সংবাদপত্র-মিডিয়া-সাংবাদিক তাদের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে মিডিয়া কর্মী ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আমরা সবাই এক সাথে কাজ করব- এই শপথ আজকে ঘোষণা করছি।”

জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ বলেন, ‘‘ আমি বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, মিডিয়ার স্বাধীনতা বাকস্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন হবে এই আন্দোলন গণতন্ত্রের আন্দোলনের থেকে পৃথক কোনো আন্দোলন নয়। একই সমন্বিত আন্দোলন করতে হবে। আমি আশা করব যে, ভবিষ্যতে যখন বিএনপি সরকার গঠন করবে আমরা একটা প্রেস কমিশন গঠন করতে চাই। যে কমিশনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের পুরো পরিস্থিতির একটা বিশ্লেষণমূলক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যে কারা মিডিয়ার মালিক হয়েছে, কিভাবে মালিক হয়েছে, সাংবাদিকদের অবস্থা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবস্থা, সংবাদপত্র যে কালো আইনগুলো ঘিরে রেখেছে সেই কালো আইনগুলোর পর্যালোচনা-সব কিছুর রিপোর্ট আমরা চাই এই প্রেস কমিশনের মধ্য দিয়ে। এই দাবি আমি আজকে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে কাছে রাখছি।”

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের(বিএফইউজে) সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘‘ আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতাসীন হয়েছে তখন প্রথমেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন পড়েছে সেটা কী ‘৭৫, কী ’৯৬, কী ২০০৯। তাদের প্রত্যেকটি শাসনে তাদের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছে গণমাধ্যম। আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে যে, গত ১২ বছরে ৪২ সাংবাদিক হত্যা হয়েছে। সর্বশেষ সাংবাদিক মোজাক্কির যেটা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বসিরহাটে। গত বছর ২০২০ সালে ১৬৯জন সাংবাদিক নিগৃত হয়েছেন। আর ১২ বছরে নিগৃহতের সংখ্যা দেড় হাজার সাংবাদিক। আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে, সেই পরিসংখ্যান বলছে যে, ৯০ ভাগ সাংবাদিকই নিগৃত হয়েছেন সরকারি দল ও প্রশাসনের হাতে। আর ১০% নিগৃত হচ্ছেন সমাজের পেশী শক্তির হাতে।”

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘‘যখনই্ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় আমরা একটা জিনিস দেখেছি তখনই সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চলে, গণতন্ত্রের ওপর আঘাত আসে, ভোটাধিকার হরণ হয়।বাংলাদেশের মানুষ কেউ ভালো নেই। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে, মিডিয়ার যদি স্বাধীনতা চান, গণতন্ত্র যদি চাই তাহলে এই ফ্যাসিবাদী সরকারকে ‘না’ বলতে হবে। আমি সবাইকে আহবান জানাব, যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”

স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও মিডিয়া উপ-কমিটির সদস্য সচিব শ্যামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় গোল টেবিল আলোচনায় দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুল হাই শিকদার, দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এমএ আজিজ ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বক্তব্য রাখেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন