প্রতিদিন খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ বুলালেই দেখা যায় একাধিক নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার খবর। মা-বোনদের শ্লীলতাহানির খবর এখন প্রায় ট্র্যাডিশন হয়ে গেছে। লেখালেখি করে কোনো পরিবর্তন আসেনা বলে প্রতিবাদী লেখকরা ক্লান্ত। অগনিত পীর দরবেশ আর আউলিয়াদের এ পূণ্যভূমি আজ অপরাধের স্বর্গভূমিতে পরিণত হয়েছে, অপরাধ দমনে আজ প্রতিবাদীরা ব্যর্থ। হত্যা, কেলেঙ্কারি ইত্যাদির সঙ্গে এখন সমান তালে পাল্লা দিচ্ছে নারী নির্যাতন। কোথাও কিশোরীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হচ্ছে। কোথাও মা-বাবার সামনেই মেয়েকে লাঞ্চিত করা হচ্ছে ! আগে এসব হচ্ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে এখন কিন্তু একেবারে প্রকাশ্য রাজপথে। নরপশুরা কেড়ে নিচ্ছে মা-বোনদের সম্মান। নারীকে উলঙ্গ করে রাজপথে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কখনও রাস্তায় ভিডিও ক্যামেরার লেন্সের সম্মুখেই যুবতীর বস্ত্রহরণ করে নিজেদের পাশবিক যৌনপিপাসা মেটাচ্ছে একদল নরপশু। আমরা কী করছি? যে মায়ের ঘর থেকে জন্ম নিলাম, সেই মা কিংবা বোনদের সতীত্ব রক্ষায় আজ আমরা ব্যর্থ, এর থেকে লজ্জা ও দুঃখের ব্যাপার আর কী হতে পারে?
ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানটির মতে আমাদের দেশে নারী নির্যাতন মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ধর্ষণ শ্লীলতাহানি ও বধূহত্যা বেশী। আমরা কী করছি? আসুন, আমরা বুকে হাত দিয়ে নিজের বিবেককে একবার প্রশ্ন করি, আমরা কি কোনো মহিলার ছেলে বা ভাই হওয়ার যোগ্য? কিশোরীকে ধর্ষন করে নির্মমভাবে হত্যা! আমরা প্রতিবাদ করেছি ? সরকারের কাছে অপরাধী গ্রেফতারের দাবি তুলেছি এবং একই সঙ্গে নিন্দা করেছি প্রশাসনিক ব্যর্থতার। মাত্র ক’বছর আগে দিনাজপুরে দিন দুপুরে উলঙ্গ করে এক ছাত্রীকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল একদল নরপশু। সেদিন মানবতার পূজারি ও সভ্যতাগর্বী আমাদের মতো অনেক নরই রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার সাটার টিপছিলেন ও মজা দেখছিলেন। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেননি একজনও। পরে এদেরই মধ্যে অনেকে পুলিশকে দায়ী করে অপরাধী গ্রেফতারের আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন।
এই দেশে আজ থেকে ১০/১৫ বছর আগে প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা ছিল আজকের চেয়ে হাজার গুণ দুর্বল। কিন্তু তখনকার দিনের দেশের ক্রাইম রেকর্ড খুলে দেখুন, আজ এই দেশে রোজ যতটা ধর্ষণের কান্ড সংঘটিত হচ্ছে তখনকার দিনে বছরেও এতটা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ । কেন? নরপশুরা তো আর এখন হঠাৎ করে আকাশ থেকে আসেনি। আমরা কি ভেবে দেখেছি নরেরা অতিমাত্রায় পশুতে রূপান্তরিত হওয়ার নামে নগ্নতা বা প্রায় নগ্নতাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন। স্বাধীনতার নামে অনেকেই এখন ডিস্কো, বিয়ার বার ইত্যাদিতে গিয়ে করছেন বেলেল্লাপনা। ১০/১৫ বছর আগের নারীরা তা কল্পনা করতে পারেননি। ডিস্কোতে যাওয়া তো দূর, তখনকার নারীরা রাতের বেলা কোথাও একা যাওয়ার সাহস করতেন না । আজ অতিমাত্রায় নিজেকে আধুনিক করতে গিয়ে আমাদের বেশিরভাগ নারীই নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে ভূলে গিয়ে আঁকড়ে ধরেছেন ভিন দেশীয় অপসংস্কৃতিকে। যে ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে আমাদের নারীরা ফ্যাশন বলে আঁকড়ে ধরেছেন তার মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘যতটা দেখাবেন ততটাই টিকবেন।’ এই দেখানো বা নগ্নতা নামক ফ্যাশনের বদৌলতে ইউরোপের নারীদের যে কী অবস্থা তা আর কাউকে নতুন করে বলার আছে বলে মনে করি না। জারজ সন্তান জন্ম দিতে যে দেশগুলো বিশ্বসেরা, ওই জারয সন্তানদের জন্মরোধে যেসব দেশের মায়েদের নিজের কিশোরীটির ব্যাগে, ‘কন্ডোম’ দিতে হচ্ছে সেই দেশগুলোর চাল-চলন গ্রহণ করছি আমরা। বলুন তো, আমাদের অবস্থাটা কেমন হবে? পাশ্চাত্য দেশগুলোর প্রশাসন কি সক্রিয় নয়? তারা কি আমাদের দেশের প্রশাসনের চেয়ে দুর্বল? তারা কেন পারছে না লাগাম টানতে? ক্ষুধার্ত শেয়ালের সামনে দিয়ে যদি খোলা এক টুকরো মাংস নিয়ে আপনি আসা-যাওয়া করেন আর শেয়ালটি যদি তা কেড়ে নেয় তবে দোষটা কার? শেয়ালের না আপনার? সুতরাং এই মুহুর্তে আন্দোলন প্রশাসন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে নয়, আন্দোলন করতে হবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে।
আসুন, আমরা আরব বিশ্বের দিকে একটু চেয়ে দেখি। ওসব দেশের নারীরা বাজার-হাট করা থেকে শুরু করে অফিস আদালত সবখানেই চলাফেরা করছেন কিন্তু ক’টা ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনা সংগঠিত হচ্ছে? ওদের ক্রাইম রেকর্ডের পরিসংখ্যান খুলে দেখুন- এমন অনেক বছরই খুঁজে পাওয়া যাবে যে বছরগুলোতে ধর্ষণ তো দূর কোনো মহিলাকে কেউ দুটি অশ্লীল শব্দ বলার দুঃসাহস করেনি বা সুযোগই পায়নি। কেন? ওসব দেশের নরদের মধ্যে যৌন চেতনা নেই? ওসব দেশের যুবতীদের সঙ্গে কি পুলিশকে গার্ড হিসাবে নিয়োগ করা হয়? নিশ্চয় না। তবে এই আকাশ-পাতাল তারতম্যের কারণ কী? কারণ হচ্ছে দুটি, প্রথমত, ওসব দেশের মহিলারা নিজেকে খুব ঢিলা বা কালো রঙের একটি বোরখায় আপাদমস্তক আবৃত করে চলাফেরা করেন। এজন্য ওই মহিলাদের রূপ-সৌন্দর্য বা উত্তেজক দেহের গঠন সবসময় পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টির আড়ালে থাকে। যেহেতু ওদের রূপ বা দেহের গঠন সম্পর্কে কোনো ধারনাই পাওয়া যায় না কাজেই তাকে নিয়ে পুরুষদের মনে কোনরূপ উত্তেজনারও সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ ওই মহিলাদের শ্লীলতাহানি করার জন্য পুরুষ মনে যতটা উত্তেজনার প্রয়োজন সেই উত্তেজনা থেকে ওসব দেশের মহিলারা যুবকদের বঞ্চিত করে দেন সামান্য এই বোরখা নামক পোশাকটির মাধ্যমে। ফলে সে সব দেশের নরেরা নর হয়েই থাকেন, নরপশু হওয়ার সুযোগই পান না। আমার এই যুক্তিটির সত্যতা প্রমাণে মনোবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই, রাস্তায় বেরোলেই পেয়ে যাবেন। একজন বোরখা পরিহিতা ও একজন স্বল্পবসনা আধুনিক যুবতীর দিকে তাকিয়ে দেখুন, নিজের বিবেকই আমার যুক্তির সত্যতা প্রমাণ করে দেবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সে দেশের কঠোর শাসন ব্যবস্থা। অসতর্ক মুহুর্তে কোনো নরাধম যদি নারীর সতীত্বে হস্তক্ষেপ করেন বা করার দুঃসাহস দেখান তবে সেই নরাধমকে পাকড়াও করে প্রকাশ্যে দেশের প্রতিটি মানুষের সম্মুখে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে ফাঁসি দেওয়া হয়। এতে সেই নারীর সতীত্ব ফিরে আসে না ঠিকই তবে আর কোনো নরাধমের নারীর সতীত্বে হাত দেওয়ার মতো দুঃসাহস পায় না।
প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে যেসব দেশে নারীর এই রক্ষাকবজ বোরখাকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, সেই দেশগুলোতে দেখুন নারী নির্যাতনের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে। (চলবে)
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন