রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন সংখ্যালঘুরা
শৈলকুপা উপজেলা সংবাদদাতা : ঝিনাইদহের শৈলকুপা পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আশরাফুল আজমের ছোট ছেলে কাজী রাজিব হাসান ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এলাকাবাসী। চাঁদার টাকা গুণতে গুণতে হিমশিম খেতে হচ্ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের। বিশেষ করে শহরের কবিরপুর এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের ওপর চলছে নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার। বাধ্য হয়ে প্রতি রাতে পালা করে সংঘবদ্ধভাবে পাহারা দিয়ে বাস করতে হচ্ছে তাদের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী প্রায় ৩০ জন কিশোর ও যুবককে নিয়ে গড়ে উঠেছে রাজিবের বাহিনী। স্থানীয়ভাবে যা মেয়র বাহিনী নামেই পরিচিত। প্রতিদিন সকাল ৮টার মধ্যে শহরের কাজীপাড়ায় মেয়রের বাড়ির সামনে জড়ো হয় তারা। সকাল ৯টার মধ্যে অন্তত ২০টি মোটরসাইকেলে করে মেয়রের গাড়িকে গার্ড দিয়ে পৌরসভা ভবনে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচি। মেয়র পৌরসভায় প্রবেশ করার পর মেয়রপুত্র রাজিবের নেতৃত্বে চলে দিনভর শহর চষে বেড়ানোর পালা। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী-সমর্থক ছাড়াও প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দেখলেই তাদের ওপর চড়াও হয়ে মারধর এবং লাঞ্ছিত করে বাজার গরম করে বাহিনীর সদস্যরা। আর বাজার গরম হলেই লাভ। চলতে থাকে নীরব চাঁদাবাজি। সাধারণ পান বিক্রেতা থেকে শুরু করে সার ব্যবসায়ী, গমের ডিলার এমনকি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদেরও নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় মেয়র বাহিনীকে। বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এমনকি খোদ আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও মেয়র বাহিনীর ভয়ে তটস্ত থাকেন। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে অপহরণ-ধর্ষণ, এমন কোন অপকর্ম নেই যেখানে মেয়র বাহিনীর নাম নেই।
চলতি বছরের মে মাসের শেষের দিকে রাজিবের নেতৃত্বে মেয়র বাহিনীর সদস্যরা শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক মামুন আল মাহামুদের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। তিনি টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে জুন মাসের শুরুতে শহরের কবিরপুর থেকে তাকে অপহরণ করে নতুন বাজারের একটি গুদাম ঘরে আটকে রাখা হয়। পরবর্তীতে ডাক্তার মামুনের পরিবার পৌরসভায় গিয়ে রাজিবকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। মেয়র বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে ডাক্তার মামুন এখন বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
গত জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শহরের কবিরপুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ষষ্টিবর সাহা ও তার ভাইয়ের কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে মেয়রের ছেলে। টাকা না পেয়ে গত ৩ আগস্ট রাতে বাড়িতে ‘তুই রেডি হ আমরা আসছি’ শিরোনামে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। বিষয়টি নিয়ে ষষ্টিবর সাহা নিজের নিরাপত্তা চেয়ে শৈলকুপা থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন। কবিরপুর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যবসায়ীকে একই ধরণের চিঠি পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
মেয়র বাহিনীর ক্যাডারদের হাত থেকে বাঁচতে কবিরপুর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখন রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। গত বছরের ২০ ডিসেম্বর পৌরসভা নির্বাচনের সময় উপজেলার চতুরা গ্রামে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী খলিলুর রহমানের মালিকানাধীন ইটভাটায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট চালায় মেয়রপুত্র কাজী রাজিব। নির্বাচনের দিন বিএনপি প্রার্থী আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ভোটবর্জনের সময়ও মেয়রপুত্রের ভোট ডাকাতির বিষয়ে অভিযোগ করেন সাংবাদিকদের কাছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের কাজীপাড়ায় নিজ বাড়ির পাশের একটি ঘরে এক কলেজছাত্রীকে তুলে এনে ধর্ষণের চেষ্টা করে রাজিব। এসময় ওই ছাত্রীর চিৎকারে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে তাকে উদ্ধার এবং মেয়রপুত্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে তার বিচার দাবি করে। পরে মেয়র আশরাফুল আজম পুলিশ নিয়ে এসে ক্ষুব্ধ জনতার হাত থেকে রাজিবকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
রাজিবের অপকর্মের সহযোগী আব্দুর রহিম গত মে মাসে শৈলকুপা থানার এক কনস্টেবলকে কিল, ঘুষি ও লাথি মারেন। এনিয়ে শহরে তোড়পাড় সৃষ্টি হয়। রহিমকে আটক করার সময় পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনেন মেয়র। শুধু তাই নয় এই রহিমের বিরুদ্ধে শহরের রামগোপালপাড়ায় এক প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।
মেয়রপুত্রের ক্যাডার রাসু কাজী ওরফে রাসু মামু এক ব্যবসায়ীর স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে। পরে ওই ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে সে।
সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতেও মেয়রপুত্র তৎপর। গত পৌরসভা নির্বাচনে পরিস্থিতির ওপর সংবাদ প্রকাশ করায় মেয়রপুত্রের রোষে পড়েন স্থানীয় এক সাংবাদিক। মেয়র বাহিনীর ভয়ে প্রায় গত এক বছর ধরে তিনি এলাকায় আসতে পারেন না। গত ২৮ জুলাই পৌরসভার গোপন একটি টেন্ডার নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় হকারদের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকা কেড়ে নিয়ে শহরের চার রাস্তার মোড়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয় মেয়র বাহিনীর সদস্যরা। গত ২৬ আগস্ট শৈলকুপা প্রেসক্লাবের নির্বাচনের আগের দিন নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রেসক্লাব দখলে নেয়ার চেষ্টা করে রাজিব কাজী। তবে শৈলকুপার সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় পিছু হটতে বাধ্য হয় মেয়রপুত্র। শৈলকুপা প্রেসক্লাবের প্রচার সম্পাদক এ এস এম আলীমুজ্জামান জানান, মেয়রপুত্রের কারণে প্রেসক্লাবের ৪৪ বছরের ইতিহাসে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের দুইজন নেতা জানান, ২০১৪ সালের আগে পর্যন্ত মেয়রপুত্র ছিল অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের দিন থেকেই প্রকাশ্যে আসেন কাজী রাজিব হাসান। ওই নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা নায়েব আলী জোয়ার্দারের সমর্থকদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দিয়ে ভোট কেটে আলোচনায় আসে মেয়রপুত্র। এরপর থেকেই গড়ে তোলে নিজস্ব বাহিনী। যার প্রভাবে গত পৌর নির্বাচনে নিজের পিতার পক্ষে ব্যাপকভাবে ভোট ডাকাতি করে। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ দলীয় হাই কমান্ড। তার এই অপকর্মের দায় নিতে চান না স্থানীয় আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতারা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই দীর্ঘদিন ধরে দলে নিস্ক্রিয় রয়েছেন উপজেলা ও পৌর আওয়ামীলীগের অনেক ত্যাগী নেতা।
তবে পুত্রের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ পৌর আওয়ামীলীগের সভাপতি ও মেয়র কাজী আশরাফুল আজম। তিনি বলেন, সম্প্রতি জঙ্গি সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। এ কারণে তার নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত পরিবারসহ দলীয় নেতাকর্মীরা। মেয়রের নিরাপত্তার স্বার্থেই বাড়ি থেকে পৌরসভায় আসার সময় রাজিবসহ নেতাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে তার সঙ্গে আসেন। বিএনপি, জামায়াত ও নিজ দলীয় প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে রাজনৈতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করতেই ছেলের নামে কুৎসা রটাচ্ছে বলে দাবি করেন কাজী আশরাফুল আজম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন