ওয়ার্কার্স পার্টি প্রধান রাশেদ খান মেনন ‘বাংলা ট্রিবিউন’ নামক একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে গত ৮ জুন একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম, ‘উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান’। জনাব মেনন ছাত্রজীবনে রাজনীতি শুরু করেন সমাজতন্ত্র তথা কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি যখন ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, তখন বিশ্ব কমিউনিস্ট শিবির দুই ভাগে বিভক্ত হয়। দুই ভাগের দুই মোড়ল হয় সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং চীন। সমাজতন্ত্রের কথা বলা ন্যাপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একদল হয় পিকিংপন্থী ন্যাপ এবং মনি সিং-এর কমিউনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ হয় মস্কোপন্থী। এই বিভক্তির ঢেউ ছাত্র ইউনিয়নেও লাগে। ছাত্র ইউনিয়নের একভাগ মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে মনি-মোজাফ্ফরপন্থী তথা মস্কো পন্থী নামে পরিচিতি পায়। অন্য অংশ মেননের নেতৃত্বে ভাসানীপন্থী তথা পিকিংপন্থী নামে পরিচিতি পায়।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মতিয়া ও মেনন উভয়েই কমিউনিজম তথা সর্বহারার রাজনীতি ব্যাক বার্নারে ঠেলে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতাকে সামনের সিটে নিয়ে আসেন। আওয়ামী লীগও সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে নিয়ে আসে। মওলানা ভাসানী ও মনি সিং-এর ইন্তেকালের পর মস্কোপন্থী রাজনীতি স্তিমিত হয়ে আসে। এর আগেই মস্কোপন্থী মহিউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগে যোগ দেন। পরে মতিয়া চৌধুরীও আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং এমপি ও মন্ত্রী হন। মেনন ওয়ার্কার্স পার্টি গঠন করেন। তার রাজনীতি থেকে সর্বহারারা হারিয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতাকেই তাঁর রাজনীতির একমাত্র উপজীব্য করেন। এভাবে গড়াতে গড়াতে তিনি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীও হন। এখানে আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। মেনন ও মতিয়া- উভয়েরই দল মস্কো ও পিকিংয়ের খোলস ছেড়ে দিল্লীর চাদর গায়ে জড়ায়।
সেই মেনন সাহেব ‘উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেছেন। মেনন ঐ সুদীর্ঘ প্রবন্ধের এক স্থানে লিখেছেন, ‘পাক বাহিনীর হাতে পতনের পরদিন ৩ এপ্রিল, ১৯৭১, নরসিংদির ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ ঘুরে আমি ও বন্ধু সহকর্মী রনো মওলানা ভাসানীর কাছে তার বিন্নাফৈরের অবস্থানকালে পৌঁছি। ... তাকে আমরা ভারতে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি বলেন, ইন্দিরা জওহরলালের মেয়ে। জওহরলাল আমার বন্ধু ছিল। ভারতে গেলে ওরা আমায় মাথায় করে রাখবে। কিন্তু সুভাষ বোসের অবস্থা দেখনি? সে দেশে ফিরতে পারে নাই।
মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল থেকে নদীপথে সিরাজগঞ্জ হয়ে আসাম দিয়ে ভারত প্রবেশ করেন। সিরাজগঞ্জ থেকে সাথী হিসাবে ভাসানী ন্যাপের মুরাদুজ্জামান ও ওয়ালী ন্যাপের সাইফুল আলমকে নৌকায় তুলে নেন। মওলানা ভাসানী আসামে পৌঁছিলে আসামের কর্তৃপক্ষ তাকে সাদরে স্বাগত জানায়। ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও পরবর্তীতে ভারতের রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ সাহেব তাকে দিল্লী নিয়ে যান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাকে আর জনসমক্ষে আসতে দেয়নি। তারা তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে বিভিন্ন সময় ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাখেন। ... এভাবে মওলানা ভাসানীর বার্তা-বিবৃতি ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হলেও মওলানা ভাসানী কোথায় কীভাবে অবস্থান করছেন তা রহস্যজনকই রয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলীয় নেতা সিপিআই (এম) এর কমরেড জ্যোতি বসু এ ব্যাপারে ভারত সরকারকে বারবার প্রশ্ন করলেও জবাব পাননি।’
এরপর মেনন লিখেছেন, ‘এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখ জলপাইগুড়িতে বামপন্থী দলসমূহের এক বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ইতিমধ্যে দেরী হয়ে যাওয়ায় ১ মে কুমিল্লার চিওড়া হয়ে আগরতলা পৌঁছাই। পরে জানতে পারি যে, নির্ধারিত তারিখে বামপন্থীদের ঐ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও মওলানা ভাসানী সেখানে উপস্থিত হননি বা তাকে উপস্থিত হতে দেওয়া হয়নি।’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘ন্যাপ নেতা মশিউর রহমানকে তার বন্ধু পশ্চিমবাংলার উপমুখ্যমন্ত্রী ত্রিগুনা সেন কথা দিয়েছিলেন যে, তিনি ভারত সরকারকে বলে মওলানা ভাসানীকে ওই বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। মওলানা ভাসানী ওই বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যদিকে ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান তার ক’দিন পর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান ও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
এদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) সহায়তায় আমরা দেশের সব বামপন্থী দল ও গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট (এম-এল) যার নেতা ছিলেন মহম্মদ তোয়াহা-আবদুল হক-সুখেন্দু দস্তিদার, তারা চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) লাইন অনুসারে আগেই শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন গ্রহণ করেছিল। তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ওই সিপিআই (এম-এল) এর মূল্যায়ন অনুযায়ী ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ বলে অভিহিত করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। অপরদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন-আলাউদ্দিন) প্রথম দিকে পাবনা অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরোচিত লড়াই করলেও তারাও কিছু দিনের মধ্যে একই পথ নেয়।’
অন্যত্র মেনন লিখেছেন, ‘একদিকে ভারত সরকার বাম-কমিউনিস্টদের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা নিয়ে সন্দিহান ছিল, তাই তারা সর্বদা তাদের নজরদারিতে রেখেছিল। অন্যদিকে নকশালরা, যারা কলকাতার বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতো, তারা মুক্তিযুদ্ধের বৈরী ছিল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য পুস্তক ও প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হয়েছে। এটি খুব ভালো দিক। আবার সেখানে মওলানা ভাসানীর মত সর্বজনশ্রদ্ধেয় অসম্ভব জনপ্রিয় জননেতাকে নয় মাস অন্তরীণ রাখা হয়েছিল। কেন? কী জন্য? ইতিহাসবিদদের এটিও কর্তব্য, সেই রহস্য উদ্ঘাটন করা।
দুই
আমি কমলিকে ছাড়তে চাইলে কী হবে, কমলি যে আমাকে ছাড়ে না। কোনো একটি উপন্যাসের ডায়লগ এটি। কিন্তু এই ডায়ালগটি যে আমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে সেটি আগে ভাবিনি। করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী সংক্রমণকে বলা হচ্ছে প্যান্ডেমিক। এই প্যান্ডেমিক নিয়ে আমি বেশি লিখতে চাই না। কিন্তু দেখছি, লিখতে না চাইলেও করোনার ওপর লেখা আমার ঘাড়ে চাপছে। এর অর্থ এই নয় যে, করোনার ওপর লেখা কেউ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। আমি বছরের পর বছর ধরে প্রধানত রাজনীতির ওপর কলাম লিখে আসছি। কিন্তু এখন রাজনীতির ওপর কী লিখবো? দেশে কি কোনো রাজনীতি আছে? বিরোধী দল বলে কোনো কিছু কি দৃশ্যমান? সংবাদপত্রে বিবৃতি ঝাড়া, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং বন্ধ ঘরে গোল টেবিল বৈঠক ও সেমিনার সিম্পোজিয়াম ছাড়া বিরোধী দলসমূহের আর কোনো তৎপরতা আছে কি?
আর সরকারি দল? ওবায়দুল কাদেরের কাজ হলো ৩৬৫ দিনের প্রতিদিন বিএনপিকে চটকিয়ে বিৃবতি আকারে একটি বক্তব্য দেওয়া। রাজনীতির মাঠ সম্পূর্ণ ফাঁকা। সরকারি দল এক চেটিয়া গোল দিয়ে যাচ্ছে। অথবা বলতে পারেন একতরফা ব্যাটিং করে যাচ্ছে। মাঠে কোনো ফিল্ডার চোখে পড়ছে না। বিরোধী দলসমূহ বলছে যে, তাদেরকে মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। একথা যেমন সত্য, তেমনি একথাও সত্য যে নিয়ম কানুনের মধ্যে থেকে, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে তারা যে জোর করে মাঠে নামবে তেমন কোনো প্রচেষ্টাও লক্ষ করা যাচ্ছে না। ঐদিকে একটি পত্রিকার গত শুক্রবার প্রকাশিত খবরে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। খবরে বলা হয়েছে যে সরকার ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের নীল নকশা চূড়ান্ত করেছে। মনে হচ্ছে, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আন্দোলনে না গিয়ে শুধুমাত্র ইলেকশনে গিয়ে বিএনপির কি লাভ? নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি কি সরকার হঠাতে পারবে?
শুক্রবার শুনলাম যে, সোমবার ২৮ জুন থেকে সারাদেশে জারি করা হচ্ছে ‘কঠোর লাকডাউন’ তখন মনটা উল্লসিত হয়ে উঠলো এই ভেবে যে এবার স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে সরকার সত্যি সত্যিই কঠোর হচ্ছে। অতীত শিথিলতার পুনরাবৃত্তি এবার আর হবে না। জনগণ অতীতে দেখেছেন, যতবারই কাড়া নাকাড়া বাজিয়ে লকডাউন, শাটডাউন বা রেস্ট্রিকশন আরোপ করা হয়েছে ততবারই একটি শুভঙ্করের ফাঁক রাখা হয়েছে। গাড়ি-ঘোড়া চলেছে, ঠাসাঠাসি-গাদাগাদি করা যাত্রী বোঝাই বাস স্টিমার লঞ্চ চলেছে, কলকারখানা চলেছে, দোকানপাট খোলা রয়েছে। তাহলে আর বাকী থাকে কী? এবার সেই শুভঙ্করের ফাঁক থেকেই যাবে? জানি না। পত্র পত্রিকায় দেখলাম যে বিজিবি এবং পুলিশকে সাহায্য করার জন্য সেনাবাহিনীও নাকি মাঠে থাকবে। তবে শনিবারের খবরে দেখা গেল যে কঠোর লকডাউনের মধ্যে নাকি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীসমূহ খোলা থাকবে। তাহলে অন্তত একটি সেক্টরে ‘কাবাব মে হাড্ডি’ পাওয়া গেল।
জাতীয় পরামর্শক কমিটি কিন্তু একটানা ১৫ দিন শাটডাউনের পরামর্শ দিয়েছেন। জরুরি সেবা ছাড়া সব কিছু বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে। প্রতিবারের মতো এবারও একই ভুল করা হয়েছে। লকডাউন শুরু হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা আগেই তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ফলে লাখ লাখ মানুষ দেশের বাড়ি বা গ্রামের বাড়িতে ছুটছেন। ফলে ফেরিতে বা অন্যান্য যানবাহনে গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি দেখা যাচ্ছে। আর করোনা টেস্টের সংখ্যা এত কম কেন? কোনো দিন ৩০ হজার আবার কোনো দিন ১৭ হাজার। টেস্টের সংখ্যা মোতাবেক সংক্রমণের সংখ্যাও ওঠানামা করছে। ১৬ মাস ধরে আমাদের করোনার সাথে বসবাস। তারপরেও কি দৈনিক ১ লাখ টেস্টের ব্যবস্থা করা গেল না? ৬৪ জেলার মধ্যে ৪৬টি জেলায় আইসিইউ বেড নাই। মফস্বলের কয়টি হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা আছে? ১৬ মাসেও কি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিছু শিখবে না? এক সময় আমরা শুনতাম যে, ওয়াপদা নাকি শ্বেতহস্তি। এখন তো দেখছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়েছে।
লেখাটি শেষ করার পর দেখলাম যে, সরকার লকডাউনের ব্যাপারে তার অবস্থান থেকে আবার সরে এসেছে। এখন সোমবার থেকে সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন হবে না। সেটি নাকি হবে বৃহস্পতিবার থেকে। মধ্যের তিন দিন অর্থাৎ সোম, মঙ্গল ও বুধবার সীমিত লকডাউন থাকবে। সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তন দেখে দুটি বাগধারা মনে পড়ল। একটি হলো, ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’। আরেকটি হলো, ‘যত গর্জে তত বর্ষে না’।
Email: journalist15@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন