শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

ইসলাম ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে রক্তদান

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২১, ১২:০৬ এএম

ক. খাদ্য হিসেবে রক্ত নিষিদ্ধঃ আল্লাহ তা’আলা প্রবাহিত রক্ত অর্থাৎ শিরা ও ধমনীর টাটকা রক্ত খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:

তিনি তোমাদের জন্য হারাম করেছেন মৃত জীব, প্রবাহিত রক্ত (কাঁচা বা রান্না করে) শূকর এবং যেসব জীব-জন্তু আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান।
তিনি আরও বলেন, তুমি বলে দাও, আমার কাছে যে ওহী পাঠানো হয়েছে তার মধ্যে এমন কোন হারাম জিনিস আমি পাচ্ছি না যা একজন ভোজনকারী মানুষ সচরাচর খেয়ে থাকে; কিন্তু মৃত বা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের মাংস নিষিদ্ধ। কেননা এসব অপবিত্র- অথবা বা অবৈধ আল্লাহ ছাড়া অন্যের নাম নেওয়ার কারণে। তবে কেউ যদি অবাধ্য না হয়ে এবং সীমালংঘন না করে তা গ্রহণে বাধ্য হয়, তাহলে তোমার প্রতিপালক অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন মৃত, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত এবং এমন জানোয়ার যার ওপর আল্লাহ তা’আলা ছাড়া অন্য কারো নাম নেয়া হয়েছে, কিন্তু যদি কাউকে বাধ্য করা হয়, সে যদি সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।
খ. নিষিদ্ধ খাদ্য দ্বারা চিকিৎসা নিষিদ্ধঃ ইসলামী শরী’আতে যেসব খাদ্য ও পানীয় নিষিদ্ধ তা ঔষধ হিসেবে গ্রহণও নিষিদ্ধ। আবুদ দারদা রা. বলেন, রাসূল স. বলেন, নিশ্চয় রোগ ও ঔষধ আল্লাহ প্রদত্ত দুটি জিনিস। তিনি প্রত্যেক রোগের নিরাময় ব্যবস্থা করেছেন; সুতরাং তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ কর; তবে হারাম কোন কিছু দ্বারা চিকিৎসা নিও না।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ রাসূল স. অপবিত্র ঔষধ থেকে নিষেধ করেছেন। নিষিদ্ধ জিনিসের মধ্যে আরোগ্য দানের ক্ষমতা নেই। ইসলামী শরীয়তে মদ একটি হারাম পানীয়। স্বাভাবিকভাবে তাই মদ দিয়ে ঔষধ গ্রহণও হারাম। এ সম্পর্কে তারেক বিন সুয়াইদ রা. বলেন, রাসূল স. কে মদ ব্যবহার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি তা ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। তখন প্রশ্নকারী বলল, আমিতো এটা ঔষধ হিসেবে তৈরি করেছি। তখন রাসূল স. বললেন, মদ কখনো ঔষধ হতে পারে না, বরং সে নিজেই রোগের উপাদান।
গ. আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের যুক্তিঃ ইসলামী শরীয়া কর্তৃক শরীরের অভ্যন্তরে খাদ্য হিসেবে অপবিত্র বস্তু প্রবেশ নিষিদ্ধ করার স্বপক্ষে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান স্বীকৃত যৌক্তিক কারণও রয়েছে। সাধারণত খাদ্য পাকস্থলীতে পরিপাক হয় এবং এর সারাংশ রক্তের মাধ্যমে শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে ধমনী বা শিরায় কোন কিছু প্রবেশ করানোর পর তা সরাসরি রক্তের মাধ্যমে দ্রুত ও সহজেই শরীরের সর্বত্র পরিচালিত হয়। এভাবে রক্তের মাধ্যমে জানা ও অজানা বিভিন্ন রোগের জীবাণু একজনের দেহ থেকে অন্যের দেহে প্রবেশ করতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে জানা যায় যে, প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেও হেপাটাইটিস-বি ও সি, এইডস ও আরও অনেক জানা অজানা প্রাণঘাতী রোগ সংক্রমিত হয় এবং মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। কোন প্রাণী জবাই করার পর যে রক্ত বের হয়ে আসে তাতে বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান, জমাট বাঁধার উপাদান (Heparin), Toxin ও বিভিন্ন Pathogenic micro-organism থাকে। এগুলো প্রাণীদেহের ভিতরে থাকা অবস্থায় প্রাণীদেহের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু এসব পদার্থ খাদ্য হিসেবে খুবই ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা রক্ত খাওয়া নিষিদ্ধ করেছেন।
মূলত আল্লাহ তা’আলা এসব বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়ার জন্যই পশু-পাখি জবাই করে রক্ত বের করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। খাদ্য হিসেবে রক্ত নিষিদ্ধ হওয়ার এ বৈজ্ঞানিক কারণটি অনেক গবেষণার পর সুস্পষ্ট হয়েছে। তাই রক্ত সংস্পর্শের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে ডিম্পোসিবল্-সিরিঞ্জ ব্যবহৃত হচ্ছে। একজনের ব্যবহৃত সুঁচ যেন অন্যের দেহের সংস্পর্শে না আসে সেজন্য সেমিনার, ব্যানার, পোস্টার ও লেখালেখির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলা হচ্ছে।
দুই. রক্তদান বৈধঃ বর্তমান সময়ের অধিকাংশ আলিম ও ফিকহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত মতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তদান ও পরিসঞ্চালন বৈধ। এমত পোষণকারীদের মধ্যে রয়েছে, মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাতওয়া কমিটি, সৌদী আরবের বিদগ্ধ আলিমগণের সংস্থা “হাইয়াতু কিবারিল উলামা”, রাবিতাতুল আলাম আল-ইসলামী অধিভুক্ত ফিকহ কমিটির সিদ্ধান্ত।
তাদের দলীল ও যুক্তিগুলো হলো-
ক. জীবন রক্ষা একটি গুরুত্ব দায়িত্বঃ ইসলামী শরীয়ার একটি প্রধান লক্ষ্য হল ‘হিফজুন নাফ্স’ বা জীবন রক্ষা করা, যা চিকিৎসা বিদ্যার প্রাথমিক এবং মৌলিক উদ্দেশ্য। পবিত্র কুরআন মানুষের জীবন রক্ষাকে এক গুরু দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন- কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো লোককে হত্যা করে, যে লোক কাউকেও হত্যার অপরাধে অপরাধী নয়, কিংবা পৃথিবীতে বিপর্যয়ও সৃষ্টি করেনি; সে (হত্যাকারী) যেনো পুরো মানব জাতিকেই হত্যা করলো। আর যে তাকে বাঁচিয়ে রাখে সে যেনো পুরো মানব জাতিকে বাঁচালো।
পবিত্র কুর’আন এ আয়াতে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে পুরো মানবজাতির জীবন রক্ষার সমকক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। অন্যকথায় কোনো মানুষ যদি মানুষের জীবন রক্ষার জন্য চেষ্টা করে তাহলে সে পুরো মানব জাতিকে জীবিত রাখার কাজ করে।
খ. সংকট নিষিদ্ধতাকে বৈধ করেঃ ইসলামী শরীয়া জীবন নাশের হুমকি মোকাবিলায় সংকটময় সময়ের জন্য যে কোন নিষিদ্ধতাকে সাময়িকভাবে বৈধ করেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে ‘ক্বাওয়ায়িদ আশ-শরীয়ায়’ বর্ণিত জরুরি’ অবস্থায় মৃত প্রাণীর গোশত খাওয়ার অনুমোদনের সাথে তুলনা করা যায়। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার বিধান অন্য স্বাভাবিক অবস্থায় নিষিদ্ধ বা নিরুসাহিতকৃত পদ্ধতিকেও অনুমোদন করে।
তাই গুরুতরভাবে অসুস্থ ও দুর্বল কোন রোগীর জীবন রক্ষার্থে কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেই রোগীর শরীরে রক্ত সরবরাহ অর্থাৎ ব্লাড ট্রান্সফিউশন করা অত্যন্ত জরুরি বলে পরামর্শ দিলে সংকটকালীন রক্তদান বৈধ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
কিন্তু যদি কেউ নিরুপায় হয়ে পড়ে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে সীমালংঘনকারী না হয়, তাহলে তার কোন অপরাধ হবে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়াবান।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন