শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

উত্তরায় দখল চাঁদাবাজি

রাজউকের ১৮টি প্লট দখল করে গড়ে উঠেছে ফার্নিচার মার্কেট : খাল ভরাট করে বানানো হয়েছে বস্তি

ইয়াছিন রানা | প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

রাজধানীর উত্তরায় রাজউকের বিস্তীর্ণ জায়গা দখল করে চলছে চাঁদাবাজির রমরমা ব্যবসা। রাজউকের প্লট দখল করে মার্কেট বানানো, খাল ভরাট করে বস্তি বানিয়ে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো থেকে শুরু করে কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় চলছে এ চাঁদাবাজি। পুরো উত্তরায় মাসে কোটি টাকার উপরে চাঁদা ওঠে। কাউন্সিলর, রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তাদের সমঝোতায় নীরবে চলছে এ চাঁদাবাজি। একেকজন নেতা একেক রাস্তা, মার্কেট, বাজার, রিকশা, টেম্পোর চাঁদা তোলার কাজ ভাগাভাগি করে নিয়েছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, ১১ নং সেক্টরের জমজম টাওয়ারের পাশে রাস্তার দুই পাশের রাজউকের ১৮টি প্লট দখল করে বানানো হয়েছে ফার্নিচার মার্কেট। উত্তরার ১২ নং সেক্টরের কবরস্থানের পেছনে খাল ভরাট করে বানানো হয়েছে বস্তি। খালপাড় থেকে দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের প্লট দখল করে বসানো হয়েছে গাড়ির টায়ারের দোকান, ট্রাকের স্ট্যান্ড।

উত্তরার ১২ নং সেক্টরের কবরস্থানের পেছনে খাল ভরাট করে বানানো বস্তিতে রয়েছে ছাপড়া ঘর, ভাঙারির দোকান, রিকশার গ্যারেজ, বাঁশের পট্টি। কেন্দ্রীয় মসজিদ খালপাড় থেকে দিয়াবাড়ির দিকে যেতে রাস্তার দুই পাশের রাজউকের প্লট দখল করে বানানো হয়েছে গাড়ির টায়ারের দোকান। আর মোড়ের মধ্যে বানানো হয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড। মসজিদের সামনে ও খালপাড় ব্রিজের উপরে অর্ধশতাধিক ফলের দোকান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এই এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন ৫৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন, ৫১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফুর রহমান, তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক নূর হোসেন, তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান শফি, তুরাগ থানা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতি হান্নান ঢালী, যুবলীগের ৫৪ নং ওয়ার্ডের নেতা তইবুর। এই নেতারা তাদের নেতাকর্মী ও লাইনম্যান দিয়ে চাঁদা তোলেন। এরপর তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন।

কাউন্সিলর নাসির উদ্দিনের তত্ত্বাবধানে চলে কবরস্থানের পেছনের বস্তি। এর থেকে মাসে ভাড়া তোলা হয় দুই লাখ টাকা। রাস্তার উপরের কাঁচাবাজার থেকে টাকা তোলা হয় দিনে আট হাজার। খালপাড় মোড়ের ব্রিজের উপরে রয়েছে প্রায় ৫০টি ফলের দোকান। দোকানপ্রতি প্রতিদিন ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এই টাকা তোলে মিরাজ, মোস্তফা, কবির, হযরত ও বিল্লাল।

রাজউক মাঝে মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালালেও আবারও দখল হয়ে যায় এই জায়গা, গড়ে উঠে বস্তি। এ বিষয়ে কাউন্সিলর নাসির ইনকিলাবকে বলেন, রাজউক উচ্ছেদ চালায়, আবার এই জায়গা দখল হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, আমার নামে কে চাঁদা তোলে বা কারা আমার নাম বলে তাদের আমার কাছে নিয়ে আসেন, আমি দেখব। তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক নূর হোসেনের দখলে রয়েছে ট্রাকস্ট্যান্ড। এই স্ট্যান্ডে দেড় থেকে দুইশত ট্রাক অবস্থান করে। প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি ১২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। ট্রাকস্টান্ডের টাকা তোলে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক লীগের সভাপতি তুরাগ থানার ফারুক খান ও যুবলীগের হারুন।

১২ নম্বর মোড় থেকে দিয়াবাড়ি পর্যন্ত রাজউকের প্লটের উপরে প্রায় ৪০টি গাড়ির চাকার দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানের ভাড়া ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। দোকানগুলোর অর্ধেক নূর হোসেনের দখলে, আর বাকি অর্ধেক তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শফিকুর ইসলামের দখলে। এছাড়া ওই এলাকার টেম্পো ও রিকশার চাঁদা নিয়ন্ত্রণ করেন শফিক ও তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হাসান।

১১ নং সেক্টরের জমজম টাওয়ারের পাশে রাজউকের প্লট দখল করে গড়ে ওঠা ফার্নিচার মার্কেট হলো উত্তরার সবচেয়ে বড় চাঁদাবাজির স্থান। এই এক মার্কেট থেকে প্রতি মাসে চাঁদা তোলা হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় প্রভাবশালীর কয়েকটি গ্রুপ রাজউকের ১৮টি প্লট অবৈধভাবে দখলে নিয়ে ফার্নিচার মার্কেট তৈরি করেছে। প্রতিটি দোকান থেকে অগ্রিম নেয়া হয়েছে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা। সেখানে দোকান আছে ৮০টি। প্রতিটি দোকান থেকে মাসে ভাড়া আদায় করা হয় ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা করে। ফার্নিচার মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করেন ৫১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শরীফুর রহমান, যুবলীগ নেতা কবির হাসান। এখানের পর্দা মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগ নেতা মিন্টু। কাউন্সিলর শরীফ তার নিজের লোকজনকে একেকটি প্লট ভাগ করে দিয়েছে। ১১ নং সেক্টরের ২০ নং রোডের দক্ষিণ পাশের ভাঙারি মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করে মরহুম আবুল হাসেম চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল হাসান। হাউজ বিল্ডিং থেকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল পর্যন্ত ফুটপাথের চাঁদা তোলে উজ্জল আর রাস্তার উত্তর পাশের চাঁদা তোলে জজ মিয়া।

এ বিষয়ে রাজউকের এস্টেট ও ভূমির উপ-পরিচালক নাদিমুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, খালের জায়গা দখল করে বস্তি গড়ে উঠেছে। আমরা কয়েকবার উদ্ধার অভিযান চালিয়েছি। আবারও অভিযান চালাব। ফার্নিচার মার্কেটের বিষয়ে তিনি বলেন, এই মার্কেট উচ্ছেদ করতে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই মার্কেটটি উচ্ছেদ করে প্রকৃত মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দেয়া হবে। করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে দেরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে আব্দুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত রাস্তাটিও চাঁদার খনি। এই পুরো এলাকার চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ ৫৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজের হাতে। স্লুইস গেট থেকে কামারপাড়া পর্যন্ত ফুটপাথের টাকা পশ্চিম থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনের তত্ত্বাবধানে কালেকশন করে রাকিব নামের এক ব্যক্তি। স্লুইস গেট সাহেব আলী মাদরাসা মোড়ে টাকা তোলে মিন্টু, শাহীন, সোহেল, জাহিদ, আলামিন ও নাসির। অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে টাকা সংগ্রহ করে বাচ্চু ও জাদুঘর। এরা সবাই ৫৪ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর হোসেন যুবরাজের চাচা বাবুল মিয়ার লোকজন। আব্দুল্লাহপুর থেকে বেড়িবাঁধের সব পরিবহন থেকে টাকা তোলা হয় কাউন্সিলর যুবরাজের নামে। এই টাকা তোলেন বাবুল মিয়া। প্রতি গাড়ি থেকে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা তোলা হয়। কামারপাড়া থেকে স্লুইস গেট পর্যন্ত সুমন হাজী, মহিত হাজী চাঁদা তোলেন। স্লুইস গেটের কাঁচাবাজারের টাকাও তোলে এরা।

আব্দুল্লাহপুর মাছ বাজারের টাকা তোলেন উত্তরা পশ্চিম থানা মৎসজীবী লীগ সভাপতি রামচন্দ্র দাশ। উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক নুরুলের নিয়ন্ত্রণে ঢাকা-টাঙ্গাইল হাইওয়ের সকল গাড়ি। টাঙ্গাইলের প্রতিটি গাড়ি থেকে ১৫০ টাকা তোলা হয়। টাকা তোলে হাসান ও রসুল দুই ভাই। আব্দুল্লাহপুর থেকে বেড়িবাঁধের পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে তাজুল ইসলাম তাজু। প্রত্যেক গাড়ি থেকে মাসিক ১০ বা ২০ হাজার টাকা নেয়া হয়। অবৈধ তেলের দোকানও রয়েছে তার। তেলের দোকান নিয়ন্ত্রণ করে সাজ্জাদ ও নাসির। দোকানগুলোর মালিক হচ্ছে শরিফ, লোকমান, কুদ্দুসসহ কয়েকজন।
মরহুম আবুল হাসেম চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল হাসানের নিয়ন্ত্রণে কামারপাড়া চেকপোস্ট এলাকা। তার নিজের প্লটের পাশে একটি প্লট দখল করে বসিয়েছে তুরাগ সুপার মার্কেট কাঁচাবাজার। সবজির দোকানের প্রতি বিড থেকে ৪৫০ টাকা তোলা হয়। এই এলাকার রিকশা প্রতি রিকশা ২০ টাকা এবং ট্রাকস্ট্যান্ডের প্রতিটি ট্রাক থেকে ১৫০ টাকা করে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হয় নাজমুলের নামে।

আজমপুরের ফুটপাথ থেকে টাকা তোলে নবী, আমিন, আতিক, সান ও রাসেল। জসিমউদ্দিন টু পাকারমাথা, আজমপুর টু রবীন্দ্র সরণির টাকা তোলে আনোয়ার, মেহেদী, মানিক, ফরহাদ, প্রিন্স মামুন, চায়না মার্কেটের সামনে মাসুদ, রাজলক্ষ্মী মার্কেটের সামনে ফারুক, সায়মনসহ অন্যরা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (12)
মোঃ+দুলাল+মিয়া ৩ জুলাই, ২০২১, ১২:৫০ এএম says : 0
সবাই ভারতীয় বাংলা সরকারের লোক,বাংলাদেশী কেউ নেই।
Total Reply(0)
MD Anowar Hussain ৩ জুলাই, ২০২১, ৩:৫৬ এএম says : 0
ঢাকা থেকে চাঁদাবাজি ও দখলমুক্ত করা কোন সরকারের পক্ষে মনে হয় সম্ভব হবে না কারোন দখলদারিত্ব করে তারাই সরকারের লোক
Total Reply(0)
Hossin Monjur ৩ জুলাই, ২০২১, ৩:৫৬ এএম says : 0
মনে হয় সব ভুমি দস্যু জামায়াতে এবং বিএনপির
Total Reply(0)
MD Rakayed Haque Nafij ৩ জুলাই, ২০২১, ৩:৫৭ এএম says : 0
রাজউক ঘুমায় এই দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করে লাভ কি মাসে মাসে তো টাকা আসতেছে। দরকারে খাল ভরাট এর পাশাপাশি নদী ভরাট সমুদ্র ও ভরাট কইরা ফেলুক খালি মাসে মাসে মাল দিলেই হইবো
Total Reply(0)
Abulkalam Ador ৩ জুলাই, ২০২১, ৩:৫৮ এএম says : 0
দেশ এখন মাফিয়াদের
Total Reply(0)
Rayhan Miah ৩ জুলাই, ২০২১, ৪:০২ এএম says : 0
যেকোন মূল্যে এই খাল উদ্বার করতেই হবে।তানাহলে আবারও জলাবদ্ধতায় পড়তে হবে
Total Reply(0)
Sopner Arif ৩ জুলাই, ২০২১, ৪:০৩ এএম says : 0
এতো দিনে বুজলাম ঢাকা কেন পানির নিচে, গারির রাস্তা কেন নোকা রাস্তা ওহ ডিজি টাল,
Total Reply(0)
MD Z Alam ৩ জুলাই, ২০২১, ৪:০৩ এএম says : 0
ঢাকা শহরের আশে পাশে ঘুরলেই দেখা যায়, ক্ষমতাশীন লোকে'রা যাকে যেভাবেই ম্যানেজ করে, ভুমি দখল করে বিশাল সাইন বোর্ড লাগিয়ে বসে আছে। এক সময় দেখা যাবে এ'দেশে বাস করার মতো কোন পরিবেশই থাকবে'না।
Total Reply(0)
MD Zahid Hasan Roni ৩ জুলাই, ২০২১, ৪:০৪ এএম says : 0
বাংলাদেশ নদী রক্ষা মিশন যেমন সিরিয়াস ভাবে শুরু হয়েছে তেমনি করে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি খাল উদ্ধার করা হোক। বিশেষ করে ঢাকার খালগুলো, আশুলিয়ার বাইপাইলের খাল ও গ্রাম অঞ্চলের যে সকল খালগুলোর পানির উপর নির্ভরশীল কৃষি জমি। এই ধরনের খালগুলো অতি দ্রুত উদ্ধার করা হোক। এবং খাল ভরাট এর সাথে সংশ্লিষ্ট যারা তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
Total Reply(0)
Kabir ৩ জুলাই, ২০২১, ২:৫৫ পিএম says : 0
বিএনপি জামায়াতের ষড়যন্ত্র নাতো!
Total Reply(0)
Dadhack ৩ জুলাই, ২০২১, ১০:০৯ পিএম says : 0
আল্লাহ এই জালিম সরকারের হাত থেকে আমাদের বাঁচাও আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আজকে যদি সাহাবারা বেঁচে থাকতেন তাহলে উনারা আমাদের এই দেশ আক্রমণ করে আল্লাহর কুরআন দিয়ে দেশ শাসন করত তাহলে আমরা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারতাম ও আল্লাহ জালেমদেরকে ধ্বংস করে দাও করো না দিয়ে
Total Reply(0)
মাসুদ ৪ জুলাই, ২০২১, ৪:২৯ এএম says : 0
প্রতিবেদন খুবই সুন্দর - একশন কত সুন্দর এবং কতটুকু স্থায়িত্ব হয় সেটিই দেখার পালা!!!
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন