বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ঋণের ৭০ ভাগ পাচার

প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের ও সোহাগ খান : অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি চক্র দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। এভাবে ওই চক্রের সদস্যরা প্রতিবছর ব্যাংকিং খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মূলত পণ্য আমদানির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ভুয়া এলসি খুলে এবং অস্তিত্বহীন প্রকল্পের মাধ্যমে অসাধু চক্রটি ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ নিচ্ছে।
দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এ কাজে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বেছে নিয়েছে চক্রটি। কারণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যক ব্যাংকগুলোর চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা চুক্তিকালীন সময়ে হাজারো অনিয়ম করলেও চুক্তি শেষে তাদের কোন দায় থাকে না। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বেসিক ব্যাংকের কাজী ফখরুল ইসলাম, সোনালী ব্যাংকের হুমায়ন কবির, অগ্রণী ব্যাংকের আব্দুল হামিদ ও রূপালী ব্যাংকের ফরিদ উদ্দিন। নতুন চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও পাচারকারী সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে এসেছেন বলে ব্যাংকপাড়ায় গুঞ্জন উঠেছে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়ার বিষয়টি পুরো-পুরিই প্রতারণামূলক জালিয়াতি। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কাজে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। আর ব্যাংকের চুক্তিভিত্তিক প্রধান নির্বাহীরা জেনে বুঝেই এসকল কাজে মদদ দেন। মাঝে কিছু এগ্রেসিভ ব্যাংকার বলির পাঁঠা হন।
সূত্র মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ পাচারের ঘটনার সাথে ব্যাংকেরই এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। আর পাচার করা অর্থের বেশিরভাগই ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডা, থাইল্যান্ড, আরব আমিরাত, ও সিঙ্গাপুর চলে গেছে। এসব দেশ বিদেশী বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দেয়ায় পাচারকারীর বেছে নিচ্ছে দেশগুলোকে। সেখানে আবাসিক ভবন, জমি ক্রয়, হোটেলসহ বিভিন্ন ব্যবসায় এসব টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তাছাড়া যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতেও অর্থ পাচারের ধুম পড়ে গেছে। আর এসব অর্থ পাচারকারীদের বাঁচাতে ঋণগুলোকে খেলাপি বানাতে মরিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ঋণ প্রদানকারী ব্যাংক। এসব ঋণ খেলাপিতে পরিণত করে পুনঃতফসিল করা হচ্ছে ১৫ থেকে ৩০ বছরের জন্য। গ্রেস পিরিয়ড দেয়া হচ্ছে ৮ থেকে ১০ বছর। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক কোন সুদ ও ঋণের কিস্তি নেবে না। গ্রেস পিরিয়ডের সময়ে ব্যাংক আর গ্রাহককে খুঁজছে না। এই সুযোগে তারা দেশ থেকে সব নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাদার টেক্সটাইলের কথা। ব্যাংকের হিসাবেই ৩১৬ কোটি টাকা (অতি মূল্যায়িত) জামানতের বিপরীতে রূপালী ব্যাংক থেকে গ্রুপটির ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এই ঋণ খেলাপি হয়েছে তিনবার। অর্থাৎ তিনবার ঋণটি পুনঃতফসিল করা হয়েছে। ব্যাংকটি এই ঋণের ২২২ কোটি টাকা টাকা সুদ মওকুফ করে দিয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেয়া হয়েছে গ্রেস পিরিয়ড।
এই ঋণ বারবার খেলাপি হওয়ার কারণ হিসেবে জানা যায়, ঋণের পুরো অর্থ কানাডায় পাচার করেছেন মাদার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ। এই টাকা পাচারের কথা স্বীকারও করেছেন সুলতান। এত কিছুর পরও মাত্র ৪ কোটি টাকার সম্পদ জামানত দিয়ে আরও ১শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি।
ঋণের অর্থ যে পাচার হচ্ছে তার প্রমাণ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণেও পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর এই ৬ মাসে ব্যাংকগুলোয় হঠাৎ করে বেড়ে গেছে শিল্পঋণ বিতরণের পরিমাণ। এ ঋণের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানিতে। ওই সময়ে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১২ দশমিক ২৬ শতাংশ।
তবে এই ঋণের তথ্য বিশ্লেষণে একটি অদ্ভুত বিষয় সামনে এসেছে। ওই সময়ে মেয়াদি ঋণ বিতরণ ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কমলেও চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রচলিত নিয়মে, মেয়াদি ঋণ বাড়লে চলতি মূলধন ঋণ বিতরণও বাড়ে। মেয়াদি ঋণ বিতরণ কমলে চলতি মূলধন ঋণ বাড়ার কোন যুক্তি নেই- এমন মত অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের। ওই সময়ে একদিকে যেমন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে, তেমনি দেশের কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেড়েছে। এসব সূচকই অর্থ পাচার হয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করছে।

বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে এলসি নামের ঋণের প্রায় দেড় হাজার কোটি লোপাটের ঘটনা খতিয়ে দেখছে দুদক। এরমধ্যে মতিঝিলে অবস্থিত ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে জাহাজ আমদানির নামে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার সত্যতা পেয়েছে। একটি শাখা থেকে ভুয়া কার্যাদেশের মাধ্যমে ৯৭ কোটি আত্মসাৎ করেছে আরেকজন বিএনপিপন্থী ঠিকাদার যার অনুসন্ধান করছে সংস্থাটি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধানও শেষ হয়েছে। ঋণ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকা পাচারের সুযোগ করে দেয়ার পেছনে রূপালী ব্যাংকের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। চলতি সপ্তাহেই এদেরকে চিঠি দিয়ে কারণ দর্শাতে বলবে দুদক। সন্তোষজনক জবাব না পেলে যেকোন মুহূর্তে এদের আটক করবে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়বেন ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হাসনে আলম। তার বিভাগের মাধ্যমেই অধিকাংশ অর্থ পাচার হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে সংস্থাটি।
রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকেও ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ব্যাংকটির রমনা করপোরেট ও লোকাল অফিস থেকে ভুয়া কোম্পানির নামে ঋণ দেখিয়ে ৩৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, অর্থপাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য রাষ্ট্রায়ত্ত ৫টি ব্যাংক থেকে গত ছয়মাসে অন্তত ১১শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশ চলে গেছেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পাচারের ঘটনা আরও প্রকট। জানা গেছে, সোনালী ব্যাংক থেকে এমন একজন বিদেশীকে ঋণ দেয়া হয়েছে যার কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট না নিয়েই ওই বিদেশীর নামে অনিয়ম করে ঋণপত্র দেখানো হয়। আর প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর পিএডি দায় সৃষ্টি করা হয়। ঋণের এই পুরো টাকাই বিদেশ পাচার হয়ে গেছে। তাছাড়া ফরেন বিল পারচেজ নেগোসিয়েশনের নামে বিদেশে পণ্য পাচার, গ্রাহকের সাথে ব্যাংক শাখা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অনিয়মিত এলসির মাধ্যমে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একইভাবে অপর্যাপ্ত জামানতের বিপরীতে অতিরিক্ত ঋণ সৃষ্টি করে ব্যাংকটির বিপুল অংকের টাকা ঝুঁকিপূর্ণ দায় সৃষ্টি করা হয়েছে।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে বছরে গড়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিদেশ পাচার হয়েছে। ব্যাংক ঋণের নামেই বেশির ভাগ অর্থ পাচার হয়েছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাাতিক একটি গবেষণা সংস্থার মতে, পাচারকৃত অর্থের ৯৯ ভাগই ব্যাংক ঋণের। আর ঋণের অর্থের ৭০ ভাগ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যক ব্যাংকের। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের যে ১৫০টি উন্নয়নশীল দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর হয়েছে সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম, আর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয়।
ব্যাংক ঋণের টাকা বিদেশ পাচার প্রসঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেছেন, ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। ভুয়া এলসির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু ব্যাংকের এলসি বিল পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু শিপমেন্ট কিভাবে হলো বা এটা আদৌ হয়েছে কিনা তা সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। যদিও এ ধরনের পর্যবেক্ষণ খুবই জটিল। পুলিশি ব্যবস্থা ছাড়া এ জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কমিটেড হতে হবে। একই সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও আরো সতর্কভাবে কাজ করতে হবে।
ড. ইব্রাহিম খালেদ বলেন, মূলত বেনামী প্রকল্প এবং ভুয়া এলসির মাধ্যমেই ব্যাংক ঋণের টাকা বিদেশ পাচার হচ্ছে। তবে বিদেশী এলসির ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না, স্থানীয় এলসির ক্ষেত্রেই এ ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেশি হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ বন্ধ না করলে, এ জালিয়াতি বন্ধ করা যাবে না। জালিয়াতি করে অর্থ পাচার বন্ধ না করা গেলে খুব শীঘ্রই ব্যাংকিং খাতে ধস নামবে। এলসি জালিয়াতিতে জড়িতদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারলে হয়তো অর্থ পাচার কিছুটা বন্ধ হতো। কিন্তু এ ধরনের অপরাধ তদন্তে দুদকের যে পরিমাণ সক্রিয় ভূমিকা থাকার কথা তা না থাকায় টাকা পাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন