শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অর্থ পাচারের রাস টানা যাচ্ছে না

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

শোনা যায়, বাংলাদেশি অনেকের টাকা সুইস ব্যাংকে রয়েছে। অনেকের বিলাসবহুল বাড়িঘর রয়েছে উন্নত দেশে। আমেরিকা, লন্ডনের বাঙালিপাড়ায়, অস্ট্র্রেলিয়া, কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ায় সাহেবপাড়ায় কাদের বিলাসবহুল বাড়িঘর রয়েছে, এর একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে হাইকোর্ট তলব করেছেন। জানা মতে, দুদক এখনো সেই তালিকা পেশ করতে পারেনি। করলে সে তালিকায় কাদের নাম রয়েছে তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের কত টাকা জমা রয়েছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। বিভিন্ন সূত্রের খবর মতে, ২০২০ সালে এ অর্থের পরিমাণ ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক, বাংলাদেশি মুদ্রায় যা পাঁচ হাজার ২৯১ কোটি টাকা। সুইজারল্যান্ডে ২৫৬টি ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমাকৃত আমানতের বছরওয়ারি একটি হিসাব এ রকম : ‘২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের স্থিতি ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাংক। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে যা ছিল ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৮ সালে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৭ সালে ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৬ সালে ৬৬ কোটি ১৯ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৫ সালে ৫৫ কোটি আট লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৪ সালে যা ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১৩ সালে ৩৭ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০১২ সালে ছিল ২২ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০১১ সালে ছিল ১৫ কোটি ২০ লাখ ফ্র্যাংক। তবে স্বর্ণালঙ্কার, শিল্পকর্ম এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র জমা রাখলে তার আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে আমানতে যোগ হয় না। এ ছাড়াও ২০১০ সালে ছিল ২৩ কোটি ৬০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৯ সালে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৮ সালে ১০ কোটি ৭০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৮ সালে ২৪ কোটি ৩০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৬ সালে ১২ কোটি ৪০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৫ সালে ৯ কোটি ৭০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৪ সালে চার কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক, ২০০৩ সালে তিন কোটি ৯০ লাখ ফ্র্যাংক এবং ২০০২ সালে ছিল তিন কোটি ১০ লাখ ফ্র্যাংক। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের প্রায় সমান। একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার দেশীয় মুদ্রায় যা প্রায় এক লাখ কোটি টাকা সুইজারল্যান্ডে পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারটি প্রক্রিয়ায় এ অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডি ও অন্য মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন এবং ভিওআইপি ব্যবসায়।’

অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঁজি বিদেশে পাচার অর্থাৎ মুদ্রা পাচার হচ্ছে। পুঁজি দেশে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণ বাংলাদেশের আইন এবং দ্বিমুখীভাবে আইনের প্রয়োগ। যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার তাঁবেদার তারা পুঁজি বিনিয়োগে সরকারের যে আনুক‚ল্য পায়, ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্য তা একেবারে উল্টো। সরকারি দলের লোকেরাও বিদেশে মুদ্রা পাচার বেশি করছে, ক্ষমতা হারালে ভবিষ্যতে যাতে দুদকের মামলার আসামি হতে না হয়। দেশের মানুষ ইনকাম ট্যাক্স দিতে চায়, কিন্তু ওই অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই ট্যাক্স আদায়ে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক। কারণ ইনকাম ট্যাক্স অফিসের পিয়ন, কেরানি থেকে শুরু করে কর্মকর্তারা ইনকাম ট্যাক্সের দালালি করে। সরকারের ঘরে যে ট্যাক্স জমা না পড়ে তার চেয়ে বেশি টাকা জমা পড়ে দুর্নীতিবাজ ইনকাম ট্যাক্স অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিরত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে চেম্বার খুলে ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিস করছেন, যা আইনসম্মত নয়।

বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। যে ছিল একশ’ বিঘা জমির মালিক সে হয়েছে ৫০০ থেকে এক হাজার বিঘা জমির মালিক, পক্ষান্তরে যে ছিল পাঁচ থেকে ১০ বিঘা সম্পত্তির মালিক সংসারের ঘানি টানতে টানতে সে নিঃস্ব হয়ে ঢাকার বস্তিতে অবস্থান নিয়ে রিকশা চালায় বা দিনমজুরের কাজ করছে। দেশের বিত্তশালী মানুষগুলো হচ্ছে অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক এবং মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তরা দিন দিন নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বিত্তশালীরা আরো ধনকুবেরে পরিণত হওয়ায় সব ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হচ্ছে। বাংলাদেশের ২২টি রাষ্ট্রীয়করণ জুট মিলকে সরকার প্রথমে বিরাষ্ট্রীয়করণ করে। তখন সরকার থেকে বলা হয়েছিল, জুট মিলগুলো লাভ করতে পারছে না। এটি অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা। সরকার ব্যর্থতা ঘোচানোর পরিবর্তে এখন ধনীদের আরো ধনী করার সুযোগ করে দিয়েছে। সরকার ১৭টি জুট মিল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার জন্য আবেদনপত্র আহবান করেছে। তার মধ্যে ১৪টি জুট মিল লিজ নেয়ার জন্য ৫১টি আবেদন জমা পড়েছে। কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ এখন ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়ার সুযোগ সরকার নিজেই করে দিলো। রাষ্ট্রীয় সম্পদ পানির দরে এখন হস্তান্তর হবে।

বাংলাদেশে বর্তমানে যাদের টাকা নেই তাদের জন্য দুনিয়া অন্ধকার। তারা হাভাতে দিন কাটাচ্ছে, সুচিকিৎসার অভাবে হাসপাতালের বারান্দায় কাতরাচ্ছে, সুশিক্ষার অভাবে সন্তানরা হচ্ছে বেকার ও বখাটে। অন্য দিকে যাদের টাকা আছে সুখে শান্তিতে আমোদফুর্তিতে দিন কাটিয়েও টাকা যখন উপচে পড়ছে তখন তারা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে গড়ে উঠা রিক্রিয়েশন ক্লাবগুলোতে মদ, জুয়া ও অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত। অথচ সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে মদ, জুয়া, গনিকাবৃত্তিসহ অনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে: ‘১. জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষত আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ২. গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেবেন।’

শিক্ষা বিস্তারের উন্নতি সাধন করা হচ্ছে বলে সরকার গলা ফাটিয়ে বলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, ঢাকার অলিতে গলিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়ে সরকার শিক্ষা প্রসারে জয়জয়কার ভাব দেখাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার পাশাপাশি যদি নৈতিকতা না থাকে তবে সে শিক্ষায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রোফাইল ভারী হতে পারে, কিন্তু দেশ ও জাতির কোনো কল্যাণে আসে না।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Dadhack ৫ জুলাই, ২০২১, ১২:৪৭ পিএম says : 0
আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কখনো বলে না যে মূল কারণ কি মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছে এবং তার জন্য একটা বিধান দিয়েছে সে বিধান এর নামকরা নদীতে মুসলিমরা কোরআন দিয়ে দেশ শাসন করতে বলে তারা পরাশক্তি ছিল শুধু তাই নয় তারা সায়েন্স এবং টেকনোলজি তে বিশ্বের মধ্যে সেরা ছিল আর এখন আমরা বিশ্বের মধ্যে সবথেকে পাপী ব্যক্তি
Total Reply(0)
Tuhin ৫ জুলাই, ২০২১, ৩:৩১ পিএম says : 0
প্রচুর টাকা বিদেশে পাচারকরা হচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নাই। সারা দেশের বেসরকারী চাকুরিজীবীদের যতদিন রেজিষ্ট্রেশন করতে পারবে না ততদিন পর্যন্ত অর্থপাচার ঠেকাতে পারবে না। সব হিসাববিদদের রেজিষ্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে। মানি এক্সচেন্জ দোকানগুলোর কঠোর মনিটরিং করতে হবে। তাহলে মুল হোতাদের আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন