শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কিভাবে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৮ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

মানবজীবনে অধিকার ও দায়িত্ব বলতে দুইটি বিষয় আছে। দুনিয়ায় চলার পথে একে অপরের সাথে পরস্পর মানবীয় ও সম্পর্কীয় বন্ধনে এগুলোর মাখোমুখি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না, যা যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। পরস্পরের অধিকার ও দায়িত্ব রূপে এগুলোর উত্তম পদ্ধতিতে আনজাম এবং শরীয়তের বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন করা উত্তম চরিত্রের একটি গরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলো সুচারুরূপে আদায় করার ওপর পরকালীন কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ভরশীল। ‘হুকুকুল ইবাদ’ বা বান্দার অধিকারসমূহের তাৎপর্য এই যে, যতক্ষণ না হকদার তার হক (অধিকার) ক্ষমা করবে, অধিকার হরণকারী ক্ষমার যোগ্য হবে না। বিষয়টি একটি হাদীস হতে স্পষ্ট হয়ে উঠে।


একবার হুজুর (সা.) সাহাবাগণকে জিজ্ঞাসা করলেন: ‘তোমরা কি অবগত আছ মোফলেস (অভাবী) কে?’ তারা আরজ করলেন, ‘আমাদের মধ্যে মোফলেস তাকেই বলা হয় যার নিকট অর্থ (টাকা পয়সা) কিছুই নেই, জিনিসপত্রও নেই।’ হুজুর (সা.) বললেন: ‘আমার উম্মতের মধ্যে মোফলেস সে ব্যক্তি, যে কিয়ামত দিবসে নামাজ, রোজা, যাকাত এবং বহু আমল নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু সে কাউকে গালি দিয়েছে, অপবাদ দিয়েছে, কারো মাল আত্মসাত করেছে, রক্তপাত করেছে, প্রহার করেছে তাহলে তার নেক কাজগুলো ভাগ করে মজলুমদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। যদি তার সমস্ত নেকি শেষ হয়ে যায় এবং তার জিম্মায় লোকদের হক বাকি থাকে, তাহলে মজলুমদের মন্দ কাজগুলো তার নামে লিখে দেয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম)

এসব অধিকারের মধ্যে (অর্থাৎ হুকুকুল ইবাদ) সর্ব প্রথম হচ্ছে পিতা-মাতার অধিকারসমূহ, সন্তানদের অধিকার ও তাদের তালীম-তারবিয়াত, শিক্ষাদীক্ষা, স্বামী-স্ত্রীর অধিকার, নিকট আত্মীয় স্বজনের অধিকার, প্রতিবেশীদের অধিকার, বিধবাদের অধিকার, এতীমদের অধিকার, অভাবীদের অধিকার, অসুস্থদের অধিকার, গোলামদের অধিকার এবং আরো বহু প্রকারের কথা কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এসব অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব যাদের, তাদের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্টরা যদি বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে, উপক্ষিত হয়ে থাকে তবে সৃষ্টি হয় নানা সংকট সমস্যার। এভাবে সমাজে দেখা দেয় হতাশা, অশান্তি, বিশৃংখলা, অস্থিরতা ক্ষোভ ইত্যাদি এবং বেড়ে যায় অপরাধ প্রবণতা।

সন্তানদের অধিকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, তাদের শিক্ষাদীক্ষা। এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘পিতা তার সন্তানদের যা প্রদান করে তার মধ্যে সর্বোত্তম দান হচ্ছে, তাদের উত্তম শিক্ষাদীক্ষা।’ (মেশকাত, জামেউল উসূল)

মুসলমান ছেলে-মেয়েদের দ্বীনের শিক্ষা দান করা স্বাভাবিক বিষয়। ইসলাম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর দ্বীনি শিক্ষা ফরজ করেছে। তাই ইসলামের মৌলিক প্রয়োজনীয় জ্ঞাতব্য বিষয়গুলো প্রত্যেককে জানতে হবে। রসূলুল্লাহ (সা.) মুসলিম শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপ বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন: ‘তোমরা সন্তানদেরকে সাত বছর বয়স হলে নামাজ পড়ার নির্দেশ দান কর এবং দশ বছর বয়স হলে নামাজ পড়ার জন্য (নামাজ না পড়লে) প্রহার কর এবং এ বয়সে পৌঁছলে তাদের বিছানা আলাদা করে দাও।’

এ হাদীসের মর্ম হচ্ছে এই যে, শিশুর বয়স সাত বছর হলে তাকে নামাজ পড়ার রীতিনীতি শিক্ষা দিতে হবে, নামাজ পড়ার নির্দেশ দিতে হবে এবং দশ বছর বয়স হওয়ার পর যদি নামাজ না পড়ে তা হলে লঘু শাসন করা যাবে অর্থাৎ তখন এ জন্য প্রহারও করা যাবে। তাদেরকে জানিয়ে দিতে হবে যে, তোমরা নামাজ না পড়লে আমরা অসন্তুষ্ট হব। এ সময় একাধিক শিশুকে এক সাথে একই বিছানায় শয়ন করা হতে বিরত রাখতে হবে তাদের সবার বিছানা আলাদা করে দিতে হবে।

যদি তার কোন নেক-সৎ ছেলে রেখে যায় তবে তার সাওয়াব পেতে থাকবে। যদি সে ছেলেকে প্রথম থেকে উত্তম শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে থাকে, যার ফলে সে ছেলে মোত্তাকি পরহেজগার হয়। যতদিন এ ছেলে দুনিয়ায় দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে সৎ জীবন যাপন করবে, সে সাওয়াব তার পিতা পেতে থাকবে। তাছাড়া ছেলে নেক-সৎ হওয়ার কারণে তার পিতার জন্য নেক দোয়া করবে।

রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘মানুষের পক্ষে নিজের সন্তানকে আদব শেখানো এক ছাঁ (এক ছাঁ প্রায় চার সের ওজন) পরিমাণ খয়রাত করা অপেক্ষা উত্তম।’ (মেশকাত)

এক ব্যক্তি আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! পিতামাতার সাথে উত্তম আচরণের এমন কোন জিনিস আছে কি, যা তাদের মৃত্যুর পর তাদের জন্য করতে পারি?’ হুজুর (সা.) বললেন: ‘তাদের জন্য দোয়া করা, তাদের মাগফিরাত কামনা করা, তাদের কৃত ওয়াদাগুলো পূরণ করা, তাদের কারণে রেশতাদারদের সাথে ভালো আচরণ করা এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান প্রদর্শন করা।’ (ইবনে মাজা, আবু দাউদ)

ইসলামে সকল প্রকার সমস্যার সমাধান রয়েছে। তবে সে সমাধান জানতে হবে এবং যথাযথ ও সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কিশোর অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টির পেছনে বাইরের কুভাব তখনই সৃষ্টি হয়, যখন পরিবার কিশোর-কিশোরীদের লাগামহীন ছেড়ে দেয় অথবা অধিক স্নেহ মমতা প্রদর্শন কিংবা উপেক্ষা-অবহেলা বশত তাদের প্রয়োজনীয় শাসন ও নিয়ন্ত্রণ হতে বিমুখ থাকে। পিতামাতা অশিক্ষিত, অজ্ঞ, মূর্খ হলে অথবা অভাবী-দরিদ্র হলে, তাদের কাছে সন্তানের সুশিক্ষার খুব কমই আশা করা যায়। তাদের সম্পর্কেই তো মনীষীরা বলেছেন, ‘খোদ গুমরাহ আস্ত, কেরা রাহবরি কুনাদ।’ অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেই পথভ্রষ্ট, সে কাকে পথ প্রদর্শন করবে। আবার এরূপ অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে যে নিজে অজ্ঞ-মূর্খ হয়েও অনেকে নিজেদের সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করে।

সন্তানের লালন পালনের দায়িত্ব মাতাপিতা, অভিভাবকের। মনীষীরা বলেছেন, মুরব্বী-অভিভাবক ব্যতীত শিশু জ্ঞানবান হতে পারে না। শিশু সন্তানের শৈশব-কৈশরকাল পরিবারে মাতাপিতা ও অভিভাবকদের সান্নিধ্যেই কাটে। এ সময় তার লালন-পালন ও বড় হবার পথে তাদের দায়িত্ব হয় প্রধান এবং সরাসরি ও প্রত্যক্ষভাবে সন্তান তাদের দ্বারাই প্রভাবিত হয় এবং তাদের সব কর্মকান্ডের অনুসরণ করে থাকে।

কিশোর অপরাধ প্রবণতার সয়লাব রোধ করতে হলে চিরাচরিত পুলিশি অভিযান ভিন্ন খাতে পরিচালনা করার কথা ভেবে দেখার সময় এসেছে, যা পুলিশ প্রশাসনকে নিশ্চিত শক্তি যোগাবে, তা এইভাবে যে, কিশোর গ্যাংদের ধরার অভিযান জোরদার করার পর ধৃত গ্যাং সদস্যদের কাছ থেকে তাদের গডফাদারদের নাম ঠিকানা যোগাড় করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সাক্ষীর প্রয়োজন হলে ধৃত গ্যাং সদস্যদের হাজির করা। অনুরূপভাবে কিশোর গ্যাংদের ধরার পর তাদের মা-বাবা, অভিভাবকদের তলব করে কৈফিয়ত চাওয়া। তাদের অপরাধী সন্তানদের সংশোধন করে সঠিক পথে রাখার মোচলেকা দিতে পারলে কিশোর অপরাধীদের তাদের বাবা-মা বা বৈধ অভিভাবকদের নিকট সমর্পণ করা এবং তাদের গতিবিধির প্রতি কড়া নজর রাখা। মোচলেকা দিতে অসমর্থ হলে কিশোর অপরাধীদের কারাগারে প্রেরণ করা। অবশ্য তাদের জন্য আলাদা কারাগার থাকা উচিত।

সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে উদ্বেগজনক ও ভয়ংকরভাবে কিশোর অপরাধ ছড়িয়ে পড়ার খবরাখবর ও ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে তা দমন করার একমাত্র উপায় ও সমাধান ধর্মীয় নৈতিকতা শিক্ষাই দিতে পারে। এ সত্য এখন দেশের বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞ মহলও স্বীকার করছেন এবং তারাও বলছেন, বাবা-মা, পরিবার ও অভিভাবকগণ সন্তান-কিশোরদের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখলে এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে সতকর্তা অবলম্বন করলে কিশোর গ্যাং তৈরির কোনো সুযোগই থাকবে না। তা না হলে কিশোর গ্যাং সয়লাবের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থেকেই যাবে। সুতরাং উদ্ভূত উদ্বেগজনক অপরাধ প্রবণতা নির্মূল অভিযান এইভাবে শুরু করা যায়: প্রত্যেক বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের বিশেষত কিশোর বয়সী ছেলে-মেয়েদের গতিবিধি কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে, পাড়া পড়শি ছেলে-মেয়েদের সেঙ্গ যৌক্তিক প্রয়োজন ছাড়া মেলা মেশা করতে দেয়া যাবে না। অকারণে রাস্তাঘাটে, এখানে সেখানে ঘোরাঘুরি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমনের নামে আর কোথাও সময়ক্ষেপণ করে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে।

পিতামাতা, পরিবারের অবাধ্য বিপথগামী সন্তান তথা ছেলে-মেয়েদের উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতার শোচনীয় পরিণতির খেসারত তাদেরকে এখন বহন করতে হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কলংক এখন তারা জাতীয় জীবনেও লেপন করে চলছে। ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে সর্বত্রই এক শ্রেণীর উচ্ছৃঙ্খল বিভ্রান্ত যুবক-তরুণ লজ্জা-শরমকে বিসর্জন দিয়ে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। আরেক শ্রেণীর প্রতারক চক্র চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে শত শত নির্বোধ পিতা-মাতার অবাধ্য ছেলে-মেয়েকে দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে এবং যৌন নির্যাতনসহ সমাজবিরোধী কাজে ব্যবহার করছে, অনেককে অপহরণ করে জিম্মি হিসেবে তাদের পিতা-মাতার কাছ থেকে বিপুল অংকের অর্থ আদায়ের কারবার করছে। আবার এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই, উঠতি বয়সের এক শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীকে জঙ্গী তৎপরতায় ব্যবহারের জন্য নানাভাবে প্রলুব্ধ করে ভাগিয়ে নেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের বরাতে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন হতে এরূপ আরো অদ্ভুত অজানা তথ্য জানা যায় এবং বহু অপরাধী পুলিশের হাতে ধরাও পড়ছে। এসব তথ্য বিবরণী একত্রিত করা হলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের এক বিশাল লজ্জাকর চিত্র ফুটে উঠবে। আর এসবের অন্তারালে প্রধান কারণটি ভেসে উঠবে তা হচ্ছে, প্রত্যেক বিভ্রান্ত সন্তানের পিতামাতা, অভিভাবক তথা পরিবার এবং অতঃপর অন্যান্য কারণ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Dadhack ৮ জুলাই, ২০২১, ৫:৩০ পিএম says : 0
মানুষ গাড়ি তৈরি করে. গাড়ি মানুষের গোলাম. গাড়িতে যদি স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয় ড্রাইভার ছাড়া তাহলে কি এক্সিডেন্ট হবে না ???????? আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছে এবং তার বিধান দিয়েছেন সে বিধান এর নাম হচ্ছে কোরআন.... কোরআন দিয়ে দেশ শাসন করা হলে দেশে কোন ধরনের দুর্নীতি পাপাচার খুন-গুম ধর্ষণ যিনা-ব্যভিচার চাঁদাবাজি ইভটিজিং অর্থ-সম্পদ পাচার করা সব বন্ধ হয়ে যেত.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন